Saturday, August 11, 2012

আরব বসন্তের নানা কথা


আরব বসন্ত থেকে অনেক দূরে সৌদি আরব
আরব বিশ্বে গত দেড় বছরের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের তেমন কোন প্রভাব এখন পর্যন্ত পড়ছে না সৌদি আরবে। তা সত্ত্বেও দেশটি আঞ্চলিক রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রভাব বজায় রেখে চলেছে।
আরব বিশ্বে গত দেড় বছরের বেশি সময় আগে যে বসন্তের শুরু, তার জের এখনও চলছে। তিউনিসিয়া এবং মিসরে স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে, এসেছে গণতান্ত্রিক সরকার। লিবিয়াতে কর্নেল গাদ্দাফির পতনের পর সেখানে নির্বাচন হয়েছে সিরিয়াতে এখনও চলছে গৃহযুদ্ধ যার শুরুটা হয়েছিল আসাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের উত্তাল বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে । মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও এই আরব পুনর্জাগরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তবে সৌদি আরব যেন একেবারেই ব্যতিক্রম। সৌদি আরবের অর্থনীতির মূল ভিত্তি তাদের খনিজ তেল। প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের তেল রফতানি করে দেশটি শুধু নিজের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করেনি, বিভিন্ন দেশে তাদের প্রভাবও বিস্তার করেছে। এই প্রভাব ধর্মীয়, অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিতেও। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সামরিক বাহিনীকে আর্থিক সহায়তা দেয় সৌদি সরকার। যদিও সেসব দেশে রয়েছে স্বৈরশাসক। মিসরে হোসনি মুবারকের সময় সামরিক বাহিনীর অন্যতম বন্ধু ছিল এই সৌদি রাজপরিবার। এই সম্পর্কে জার্মানির রাজনীতি বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের গবেষক গিডো স্টাইনবের্গ বলেন, ‘‘সৌদি আরব আর্থিক সহায়তা বা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই ক্ষেত্রে মিসর খুব ভাল উদাহরণ। দেশটিতে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীকে সৌদি আরব সাহায্য দিয়ে আসছে। আর এর মাধ্যমে দেশটির পররাষ্ট্র নীতির একটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়, তা হলো সেই অঞ্চলে যে শাসন পদ্ধতি চলে আসছে, সেই স্বৈরশাসনকে রক্ষা করা।”আরব দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই সৌদি সরকারের এই মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। একদিকে তারা তিউনিশিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলি, ইয়েমেনের পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। অন্যদিকে বাহরাইনে মানুষের বিক্ষোভ দমনে সেদেশে সেনা পর্যন্ত পাঠিয়েছে। এমনকি নিজ দেশে শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ বিক্ষোভের প্রতিও কঠোর মনোভাব দেখিয়ে যাচ্ছে দেশটির রাজপরিবার।
কেবল রাজনীতি নয়, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সৌদি আরবের প্রভাব দেখা যায় । হজ পালনের জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলিম দেশটির দুই পবিত্র শহর মক্কা এবং মদিনাতে আসেন। দেশটির রাজপরিবার নিজেদের এই দুই পবিত্র শহরের রক্ষক বলেও দাবি করে। এই ধর্মীয় ঢালকে তারা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। তবে আরব বসন্ত তাদের মনে ভয় এনে দিয়েছে বলে মনে করেন জার্মান গবেষক গিডো স্টাইনবেগ। তার মতে, ‘‘এই অঞ্চলের আরও অনেকের মত সৌদি শাসন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য একটিই তা হলো তাদের ক্ষমতা রক্ষা করা। তবে তাদের মধ্যেও এই ক্ষমতা হারানোর ভয় ঢুকে গেছে।” পশ্চিমা গবেষকদের মতে, সৌদি আরবের এই প্রভাব সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও একটি ভূমিকা রাখছে। তাদের ইরানবিরোধী অবস্থানের কারণে তারা সিরিয়ার আসাদ বিরোধীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়া পরিণত হয়েছে সুন্নি সৌদি আরব আর শিয়া ইরানের যুদ্ধক্ষেত্রে।
সূত্র : ওয়েবসাইট



আরব বসন্ত শেষ হচ্ছে না!
তারিখ: ২০-০৬-২০১২
·         ১ মন্তব্য
·         প্রিন্ট
·         ShareThis
·         Share on Facebook
·         http://paimages.prothom-alo.com/secured/theme/public/newdesign/style/images/plus.png
·         http://paimages.prothom-alo.com/secured/theme/public/newdesign/style/images/minus.png
·          
prothom-alojobs news details small ad
আরব বসন্তে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে গত বছর যে লক্ষ্য নিয়ে মিসরের রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার বিপ্লবী, তাঁদের সেই লক্ষ্য আপাতত পূরণ হওয়ার কোনো আভাস মিলছে না।
আরব বসন্ত গণজাগরণে প্রায় ৩০ বছরের শাসক প্রেসিডেন্ট মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৬ ও ১৭ জুন অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি জয়ের দাবি করেছেন। জয়ের দাবি করেছেন মোবারকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিকও। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করেনি। কাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ওই ফলাফল ঘোষণা করার কথা রয়েছে।
নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল যা-ই হোক, নির্বাচনের আগে থেকে কিছু প্রক্রিয়ায় এটা এক প্রকার নিশ্চিত যে মোবারকের পতনের পর থেকে সামরিক বাহিনীর যে সুপ্রিম কাউন্সিল ক্ষমতায় আছে, তারাই দেশটির নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে চায়। প্রাথমিক পর্যায়ে শফিকের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণার পরও আদালতের রায়ে তা বৈধ ঘোষণা, নির্বাচনের আগে আগে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা—এসব বিষয় শফিকের পক্ষে সুপ্রিম কাউন্সিলের অবস্থান ও তাদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার কৌশল বলেই মনে হয়। নির্বাচনে শফিক পরাজয় মেনে নিলেও সুপ্রিম কাউন্সিল ক্ষমতা ছেড়ে দেবে, তেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।
মার্কিন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও বর্তমানে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের কর্মকর্তা অ্যান্থনি কর্ডসম্যান বলেন, মিসরে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা বাস্তবিক অর্থে নির্বাচনের চেয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের একটি পর্ব বলেই বেশি মনে হয়। তিনি বলেন, ‘মিসর কে শাসন করবে, কারা দেশটির প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা অস্পষ্ট। তবে এটা স্পষ্ট যে দেশটিতে খুব শিগগিরই স্থিতিশীলতা ফিরছে না।’
মিসরের বর্তমান বাস্তবতা হলো, নতুন প্রেসিডেন্ট যেই হোন, তাঁকে অন্তত ২০ জন জেনারেলের অধীনে থাকতে হবে। আরব বসন্তের সময় এই জেনারেলরা মোবারকের পাশে ছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিসরে ব্রাদারহুড দেশটির সেনাবাহিনীর পুরোনো শত্রু। তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই সেনাবাহিনীর নেই। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে মিসরের তাহরির স্কয়ারে যে লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করে মোবারককে হটিয়ে দেন বিপ্লবীরা, তা অন্তত পূরণ হচ্ছে না। রয়টার্স।


আরব বসন্ত উত্তর মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহ

http://www.bangladeshnews24x7.com/wp-content/uploads/2012/02/egypt-protest.jpg

নিজামউদ্দিন আহমেদ
আরব বসন্তের সূচনাকাল ২০১১ সাল। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উৎসারিত হয়েছে আরব বসন্তের গণজোয়ার। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে জনতার লড়াই-সংগ্রাম ও শক্তির সামনে পতন ঘটেছে স্বৈরশাসকদের। লড়াই চলছে সিরিয়ায়। নব্যস্বৈরাচার বাশার আল আসাদ সেখানে জনগণের শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ, পতন এখন সময়ের ব্যাপার। জনগণের ভোটে সরকার গঠন করার মাধ্যমে মরক্কোর বাদশাহ হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেছেন। জর্ডানে বিরোধী দল শক্তিশালী নয়, তবে পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ওমান এখন শান্ত হলেও পরিস্থিতি বেঁকে বসতে পারে। কুয়েতে বিক্ষোভ হয়েছে। পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হলেও সরকারের বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণে জনগণও শান্ত রয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হামাস-ফাতাহ সমঝোতা আরব বসন্তের অন্যতম বড় অর্জন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ঐকমত্যের সরকার গঠনের অঙ্গীকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে অর্থবহ অর্জন বললে অত্যুক্তি হবে না। ফিলিস্তিনিদের বিবদমান উভয় গ্র“পের কৌশল পরিবর্তন এবং কর্মপনস্থা নতুনভাবে পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকারে এর সুবাতাস বইতে শুরু করেছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। আরব বসন্তের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হামাসের নীতি ও কৌশল যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং ফাতাহ একলা চলার নীতি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর ঐক্যপ্রচেষ্টায় সফলতা আসবে। আরব ভূখণ্ডে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ফিলিস্তিনিদের অবসস্থান জোরদারে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে ইসরাইলেও। বিগত মাসগুলোতে তেল আবিবসহ অন্য শহরগুলোতে বড় বড় প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে, জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছে, সাথে সাথে ইসরাইলি গণমাধ্যমেও প্রতিবাদী আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। ইসরাইলি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের সাথে বোঝাপড়ার জন্য নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিতেও দেখা গেছে। আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছে রুশ ফেডারেশন ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশেও। কোথাও কোথাও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে সরকারের ক্রিয়াকল্পেও। মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া এর অন্যতম। গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল সোভিয়েত রাশিয়া। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড রাশিয়া বিজয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচনে পরাস্ত দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ নির্বাচনকে অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার নির্বাচন অবাধ বা নিরপেক্ষ কোনোটাই হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ভোট জালিয়াতি হওয়ায় পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। পুতিন ও মেদভেদেভের সময় শেষ হয়ে আসছেও বলে তিনি মন্তব্য করেন। গর্বাচেভ বলেন, এটা ভীষণ লজ্জা ও বিব্রতকর। আমি এ জন্য লজ্জিত। রাশিয়ায় ঘুরেফিরে চলছে ভ্লাদিমির পুতিন ও দিমিত্রি মেদভেদেভের ক্ষমতায় টিকে থাকার নাটক। রাশিয়ার চলমান বিক্ষোভকে রুশ বসন্ত বলেও অভিমত বিশ্লেষকদের। ডুমার নির্বাচনের পর যে বিক্ষোভ চলছে সে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস তাতে সন্দেহ নেই। রাশিয়ার নিপ্রাণ রাজনীতি এখন দ্রুত গতি সঞ্চার করছে, চলমান বিক্ষোভে তাই প্রমাণিত। ডুমার নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি জোরালো একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বাস্তবে এর প্রভাব পড়বে আগামী মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। কেননা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসতে চাইছেন পুতিন। আগামীতে পুতিন যদি পাতানো নির্বাচনের খেলা খেলতে চান, তাহলে আরব বসন্তের মতো গণ-অসন্তোষ ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বেন তিনি। মিয়ানমারে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে। অং সান সুচি এখন মুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় সম্পর্ণ ভিন্ন। সুচি পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। বিদেশী অতিথি রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে ফিরে আসবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সুচির দলকে নির্বিঘেœ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হলে মিয়ানমার দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মালয়েশিয়ায় স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন চলছে। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগ সরকারের অধীন। কিন্তু ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর জন্ম নেয়া অসন্তোষ এ বছর জুলাই মাসে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজধানী কুয়ালালামপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কার্যত রাজধানীকে অচল করে রেখেছিল, যা নাকি মালয়েশিয়ার মতো দেশে অকল্পনীয়। সরকারের দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে; কিন’ তার জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। আরব বসন্তের পথ ধরে জনগণ যেমন উদ্বেলিত, তেমনই সরকার অপাতত নির্বাচন পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সংস্কার মেনে নিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আগামী নির্বাচন নাগাদ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটেছে তা কোনো ভূমিকম্পের চেয়ে কম নয়। তিউনিসিয়ার গণবিস্ফোরণ এত দ্রুত পুরো আরব বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে তা ২০১০ সালের শেষার্ধেও কেউ ভাবতে পারেনি। বু আজিজির আত্মত্যাগের জন্যই অপেক্ষা করছিল আরব দুনিয়া। যেন স্বৈরাচারদের বিদায় ঘণ্টা বাজানোর জন্যই জন্মেছিলেন এই তরুণ। দীর্ঘ দিনের চাপা অসন্তোষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ আরব বিশ্বের জনগণ খুঁজে পেল এক বু আজিজিকে তাদের দিশারী ও কাণ্ডারি হিসেবে। বাস্তবতা হলো, আরব জনগণ বরাবরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে; সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না কোনো কিছুই। আর তাই আন্দোলন বেগবান হতে সময় লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে অকাতরে রক্তে সিক্ত করেছে রাজপথ। আরব গণআন্দোলন বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে অর্থবহ আন্দোলন। এর পুরোটাই চলেছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কোনো ষড়যন্ত্র বা বহির্বিশ্বের অংশগ্রহণ ছাড়াই এটা সম্ভব হয়েছে।
আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর একটি অন্তর্বতীকালীন সংবিধান পেয়েছে দেশটি। তিউনিসিয়ার ২১৭ সদস্যের নির্বাচিত পার্লামেন্ট নতুন সংবিধানের প্রস্তাবিত ২৬টি অনুচ্ছেদই অনুমোদন দিয়েছে। নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুস্তফা বেন জাফর বলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত, স্মরণীয় এক রাত, এখন থেকে নতুন তিউনিসিয়ার যাত্রা শুরু হলো।’ ইয়েমেনে শপথ নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। রাজধানী সানার রিপাবলিকান প্যালেসে নতুন সরকারের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে শপথ নেন। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে অর্ধেক সদস্য বিরোধী জোটের, বাকি অর্ধেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহের অনুগত। ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদি শপথ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকার পরিচালনা করবেন। নতুন সরকার তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ছাড়লেও তিনি এখনো প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিরুদ্ধে কোনো বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে না। রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সালেহর অনুগত লোকজনের হাতেই থাকবে এবং তারাই নির্বাচন করবেন এমন বাস্তবতায় ইয়েমেনের জনগণের রায়ের প্রতিফলন ব্যালেট বে ঘটবে কি না সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
এ দিকে মরক্কোর ইসলামী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রধান আবদুল্লাহ বেন কিরান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেছেন। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রধানকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। পার্লামেন্টের ৩৯৫টি আসনের মধ্যে জাস্টিস পার্টি ১০৭টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্য ছোট দলগুলোর জোট গঠনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। আরব অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তার প্রভাব থেকে মরক্কোকে দূরে রাখতে মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ দ্রুত সংস্কার হাতে নেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর মরক্কোর বাদশাহের পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশে সুশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা নতুন সরকারের বড় সাফল্য। তবে মরক্কোর নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার মতো কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখনো বাদশাহর হাতেই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মরক্কোর এখনো অনেক কিছু করার বাকি। মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শাসকদের অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার বিষয়ে সামরিক কাউন্সিলের সদস্য জেনারেল মামদো শাহীদের খোলামেলা বক্তব্যে এই সন্দেহ সৃষ্টির কারণ। পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে ঘোষণা দেয়ার পর আপাতত সমালোচনা শেষ হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। জেনারেল মামদো শাহীদের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় বললে বাস্তবে অত্যুক্তি হবে না। পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস ফ্রিডম পার্টির আত্মপ্রকাশের পর মিসরীয় সেনাবাহিনীর ঘোষণায় তাদের আন্তরিকতা ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো। জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। আজ ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি মেনে চলা ও আগেকার সম্পর্ক রক্ষা করার বিষয়ে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিসরের সেনাবাহিনী মোবারকের প্রতি অনুগত না থাকলেও ইসরাইলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী। সেই বিবেচনায় তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না।
অন্যদিকে গণরায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ সরকারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিসরে সরকার পরিবর্তন ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও ইসলামপন্থী সালাফি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাদের স্বার্থপরিপন্থী বলে বিবেচনা করছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণকারী মিসরের সেনাবাহিনী পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন দেখছে, তার ফলে মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাস্টিস পার্টির উপপ্রধান এশাম এল ইরিয়ন ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রাদারহুড মিসরে কঠোর ইসলামী বিধিনিষেধ জরবদস্তি চাপিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। কারণ মিসরে মুসলিমদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও অন্য সম্প্রদায়ের লোকের বাস। তিনি বলেন, শরিয়া আইনের মৌলিক বিষয়গুলো উদারভাবে প্রয়োগ করতে চাই, যাতে মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।
মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সালাফিপন্থী আল নূর পার্টির দ্বিতীয় স্থান দখল করার ফলে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করল। আরব গণজাগরণের ফলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবাধিকার পদদলিত বা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুর লক্ষ করা গেছে, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই শেষ হবে। মিসর ও লিবিয়ায় এখনো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মিসরে পার্লামেন্ট ডাকা এবং শাসনতন্ত্র রচনার প্রক্রিয়ার সাথে ষড়যন্ত্র চলছে- তবে জনরায়কে হাইজ্যাক করার যেকোনো প্রচেষ্টা মিসরীয় জনগণ প্রতিহত করবে সন্দেই নেই। লিবিয়ার দুর্বল অন্তর্বতীকালীন সরকার নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম


রং দে আরব বাসন্তী - প্রথম পর্ব

হিমু এর ছবি
গতবছর তিউনিসিয়া থেকে বাহরাইন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া আরব সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ভালোবেসে আরব বসন্ত নাম দিয়েছে পশ্চিমা মিডিয়া। ঋতু বসন্তের চেয়ে রোগ বসন্তের সাথেই এর সাদৃশ্য বেশি। তিউনিসিয়ায় এক ক্ষুব্ধ অপমানিত ফলবিক্রেতা নিজের গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন, আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সুদূর বাহরাইন পর্যন্ত। সুদীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আরব সমাজ গর্জে উঠেছে তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনে। আরব বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবে এ আঁচ লাগেনি, যেমন লাগেনি আরব আমিরাতেও। হয়তো এরা পশ্চিমা বিশ্বের তেলের বহুলাংশ যোগান দেয় বলেই এসব দেশে আরব বসন্তের বিরুদ্ধে আগেভাগেই নানা টীকা দেয়া ছিলো।
ঢালাওভাবে আরব দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক বিক্ষোভকে আরব বসন্ত নাম দিয়ে প্রতিটি বিক্ষোভের স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে কিছু মোটা দাগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এদের একটি কার্পেটের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে মিডিয়া। আমাদের দেশের খবরের কাগজ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যারা কাজ করেন, তারা বড় পশ্চিমা মিডিয়ার বক্তব্যকেই তর্জমা করে চালিয়ে দেন। আমরাও তাই আরব বিক্ষোভকে আরব বসন্ত নামেই চিনতে শিখলাম, সেইসাথে মিডিয়ায় গর্জমান একটি কথা ছড়িয়ে পড়লো, এই বিপ্লব ফেসবুক বিপ্লব, সামাজিক যোগাযোগের সাইট এই বিপ্লবের জনক।
এই কথাটা মিডিয়ায় এসেছে, আবার অন্যান্য ঘটনার চাপে মিডিয়া থেকে সরেও গেছে, কিন্তু প্রভাবশালী মহলের কানে এই বাক্যটি অনুরণিত হয়ে চলছে। সামাজিক যোগাযোগর সাইট নিয়ে মিডিয়ামুদি থেকে শুরু করে রাজনীতিকও উদ্বেগ প্রকাশ করে চলছেন। আসছে আষাঢ় মাস, তাঁদের মন ভাবছে, কী হয় কী হয়, কী জানি কী হয়!
সামাজিক যোগাযোগ সাইট বিপ্লবের জন্ম দেয় না। বিপ্লবের জন্ম হয় শাসকের অদক্ষতা আর অকর্মণ্যতা থেকে, শাসিতের বঞ্চনার অনুভূতি থেকে। একাত্তরে এদেশে ফেসবুক ছিলো না, ছিলো না নব্বইতেও। কিন্তু একবার পাকিস্তানী সেনাশাসন, আরেকবার বাংলাদেশী সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব করেছে বাংলাদেশের মানুষ। ফেসবুকে বসে বিপ্লব করে ফেলা লোকের অভাব যদিও নেই, কিন্তু বিপ্লব হয় আকাশের নিচে, সেখানে মানুষের উপস্থিতি লাগে, লক্ষ্য লাগে, কর্মপন্থা লাগে। সামাজিক যোগাযোগের সাইট বিপ্লব নিয়ে মত বিনিময়ের কাজটা শুধু অনেক সহজ করে দিয়েছে, এ-ই। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো আরব বসন্তের জীবাণু দেখা শুরু করে দিয়েছেন সম্ভবত মিডিয়ার দেখানো জুজুর ভয়ে, কিংবা আরব বসন্ত এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইট সম্পর্কে নিজেদের পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতার কারণে। আমাদের নেতানেত্রীরা কিছু শব্দ মুখস্থ করে যত্রতত্র ব্যবহার করেন, এবং তাঁদের অনবধানতাবশে মাঝেমধ্যে শব্দগুলো তার মূল অর্থ হারিয়ে যোগরূঢ়ার্থেই মানুষের কাছে বেশি পরিচিত হয়। গত শতাব্দীর শেষ দিকে এমনই একটি বহুলব্যবহৃত শূন্যগর্ভ শব্দমালা ছিলো "একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ", যার উচ্চ ঘটনসংখ্যায় বিরক্ত হয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, বাঙালি বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাতেই অসমর্থ, সে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ কী মোকাবেলা করবে? এরপর আমরা সবকিছুতেই শহীদ জিয়ার স্বপ্ন পেয়েছি কিছুদিন, জানতে পেরেছি বর্তমান সময়ে যা কিছু ঘটে সবই শহীদ জিয়ার স্বপ্ন। এখন যোগরূঢ়ার্থে ধন্য হচ্ছে "ডিজিটাল"। "আরব বসন্ত"কে সেই পথে নিয়ে যাওয়ার কাজটা মিডিয়া-রাজনীতিকের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জোট সফল করে তুললেও তুলতে পারে।
তিউনিসিয়ায় যে বসন্ত এসেছিলো, তার সাথে মিশরের বসন্তের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু লিবিয়ায় বসন্তের কিসিম ছিলো সম্পূর্ণই ভিন্ন, যদিও পশ্চিমা মিডিয়া লিবিয়াকেও একই কাতারে ভিড়িয়ে দিয়ে খুশি। সিরিয়াতেও লিবিয়ার তরিকায় বসন্ত আনয়নের চিন্তাভাবনা চলমান। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর নাম ফেটেছে তিউনিসিয়া আর মিশরের ক্ষেত্রেই। খুলে বলি।
তিউনিসিয়া আর মিশর, দুই জায়গাতেই দীর্ঘ সময় ধরে একনায়কের শাসন চলছে। তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক ব্লগের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, ফেসবুক নিয়ে একনায়ক বেন আলির কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। সেখানে টিভি আর পত্রিকা, দুটিই ছিলো সেন্সরশিপের আওতায়। ফলে সিদি বুজিদে যখন মোহামেদ বোয়াজিজি নামে এক তরুণ ফল বিক্রেতা পুলিশের চাঁদাবাজি ও চড়থাপ্পড়ের কারণে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন, এবং অভিমানে তাদের দরজার সামনেই গায়ে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন, তখন ঘটনাটা পত্রিকা বা টিভি বা ব্লগ, কিছুতেই আসেনি। পরদিন অসংখ্য আম পাবলিক নগর কর্তৃপক্ষের দরজার সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ করলে তাদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়, সে খবরও মিডিয়া চেপে যায়। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের হাতে ইঁটের পাশাপাশি মোবাইল ফোনও ছিলো। মোবাইলে তারা পুলিশের তাণ্ডব ভিডিও করে তুলে দেয় ফেসবুকে। রাজধানী তিউনিসের এক ব্লগার স্লিম আমামু সেই জিনিস দেখতে পেয়ে ছড়িয়ে দেন। তরুণদের মধ্যে সেই জিনিস আলোড়ন তুললেও তিউনিস শহরে সিদি বুজিদের মতো সাড়া পড়েনি। তিউনিসে সিদি বুজিদের মতো বিক্ষোভ শুরুর কাজটা করেন আমামু ও তার কয়েকজন বন্ধু। শহরের এক চত্বরে নাগরিকদের জড়ো হওয়ার ডাক দিয়ে শুরু হয় আরব বসন্ত, আর ফেসবুকের নামটাও ফাটে তখনই। একবার বেন আলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যাওয়ার পর সেটা নিজ থেকেই গতি পায়। বিক্ষোভ চলাকালে টুইটারও বিপ্লবীদের কাজে এসেছে। পুলিশ কোথাও জড়ো হয়ে কোনো রাস্তা আটকে দিলে তারা সেটা টুইট করে জানিয়ে দিয়েছে অন্যদের, এদিক দিয়ে নয় ওদিক দিয়ে চলো। সামাজিক যোগাযোগের সাইটের দৌড় অতটুকুই। তিউনিসিয়ায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বেন আলির দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন চলছিলো। বিপ্লব ফেসবুকে পেজ বা গ্রুপ খুলে শুরু করা যায় না, বিপ্লবের বারুদ সমাজে জমা হতে হয়। তিউনিসিয়ায় সেই বারুদে একটা স্ফূলিঙ্গের প্রয়োজন ছিলো, যা বোয়াজিজির আত্মহনন এবং তদপরবর্তী সিদি বুজিদ বিক্ষোভ থেকে এসেছে। তিউনিসিয়ায় মানুষ ফেসবুকে চোখ রেখেছে স্বাধীন সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মাধ্যমের অভাবের কারণেই। প্রেস-টিভি-রেডিও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিকমতো পালন করতে পারেনি বলেই সেখানে সামাজিক যোগাযোগের সাইটের দিকে ঝুঁকে পড়েছে মানুষ। তিউনিসিয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহারের হারও অনেক বেশি, প্রতি তিনজনে সেখানে একজন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
মিশরে বিক্ষোভ ছড়িয়েছে মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ হিসেবে। খালিদ নামের এক তরুণ রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টকে মিশরীয় পুলিশ নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। খালিদের ভাই খালিদের মৃত মুখের ছবি তুলে নেটে পোস্ট করেন। সেই ছবিটি মিশরের তরুণদের আলোড়িত করে, সেইসাথে তিউনিসিয়ার টাটকা উদাহরণ তাদের একই রকম আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু মিশরে নেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যা তিউনিসিয়ার চেয়ে আনুপাতিক হারে অনেক কম। শুধু তা-ই নয়, ফেসবুকে সেখানে পুলিশ শকুনের মতো চোখ রাখে সবসময়, ঊনিশ-বিশ দেখলে তুলে নিয়ে পেটায়। তাই খালিদের হত্যাকাণ্ডের পর কয়েকজন তরুণ-তরুণী গোপনে পরিকল্পনা করেন, তারা গণবিক্ষোভের ডাক দেবেন অন্যভাবে। এ কাজে তারা ব্যবহার করেন কায়রোর ট্যাক্সিচালকদের। যেন খুব গোপন কিছু বলছেন, এভাবে তারা মোবাইলে ট্যাক্সিচালকদের শুনিয়ে শুনিয়ে অমুক জায়গায় তমুক দিন গণজমায়েতের কথা বলেন। ট্যাক্সিচালকরা সেই গুজব বিশ্বস্ততার সাথে ছড়িয়ে দেয় সারা শহরে। গণবিক্ষোভের আলামত দেখার পর মোবারক সরকার সোজা দেশে মোবাইল আর ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। আর সেটাই হয় কাল। যা পাবলিক ফোনে, নেটে, কানাঘুষায় জানতে পারছিলো, তা জানার জন্যে নেমে আসে পথে। আর তারই ফলাফল তাহরির স্কোয়্যারে কুড়ি লক্ষ মানুষের সমাগম। মোবারক সেই জনতার ওপর জলকামান থেকে শুরু করে ট্যাঙ্ক, পুলিশ-সেনা থেকে শুরু করে উষ্ট্রারোহী গুণ্ডা, সবই লেলিয়ে দেয়, কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি। এখানেও বিপ্লবের জন্ম সামাজিক যোগাযোগ সাইটে নয়, মোবারকের চলমান অত্যাচারে। আর বিপ্লবের সাফল্য শুধু মিশরীদের অনমনীয় আন্দোলনেই নয়, মোবারকের প্রতি ওবামা আর মিশরী সেনাবাহিনীর নিমকহারামিতেও। মোবারক মার্কিন-ইসরায়েলি অক্ষের পরীক্ষিত বন্ধু, কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে ওবামা তাকেও এলি এলি, লামা শবক্তানি বলিয়ে ছাড়ে। মিশরীয় সেনাবাহিনীও তাদের আনুগত্য যতটা বারাকের প্রতি, ততটা মোবারাকের প্রতি দেখায়নি।
তিউনিসিয়া-মিশরের সাথে লিবিয়ার পার্থক্য, সেখানে বিপ্লব গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। গাদ্দাফির পতন যত না সাধারণ মানুষের হাতে, তারচেয়ে বেশি ন্যাটোর আক্রমণ ও ব্রিটিশ-প্রশিক্ষিত মিলিশিয়াদের হাতে [১]। তিউনিসিয়া বা মিশরের চেয়ে লিবিয়ার মানুষ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বেশি ভোগ করতো, তাই গাদ্দাফিকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নিজের দেশের একাংশসহ ন্যাটোরও, যেটা তিউনিসিয়া বা মিশরে ঘটেনি। ফেসবুক বা টুইটার লিবিয়াতে কোনো কাজে আসেনি, যেমন আসছে না সিরিয়া বা ইরান বা বাহরাইন বা সৌদি আরবের ক্ষেত্রে। শেষের দেশগুলো সামাজিক যোগাযোগ সাইট সম্পর্কে খুব হুঁশিয়ার অবশ্য, তারা কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ এখনও পাইকারি হারে মানুষ মেরে চলমান বিক্ষোভ দমন করে যাচ্ছে, সেখানে ফেসবুক বা টুইটারের জয়গান নিয়ে আরব বসন্তের কোকিলেরা একেবারেই চুপ। কারণ সামাজিক যোগাযোগের সাইটের ম্যাজিকের বেলুন সেখানে বাশারের নির্মম সেনাবাহিনী ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোকে পাইকারি হারে বিপ্লবের জনক বানিয়ে দেয়ার আগে, দুই হাজার নয়ে ইরানের কারচুপির নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলা যায়। ইউটিউবে তরুণী নেদার মৃত্যুর ভিডিও সেখানে মড়কের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিলো। ছিলো ফেসবুক, ছিলো টুইটারও। কিন্তু কিছু হয়নি। অটোয়া সিটিজেনে ডেক্ল্যান হিল লিখেছেন, ইরানের বিক্ষোভের কয়েকদিন পরই মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যু ঘটার কয়েক ঘন্টার মধ্যে গোটা ব্লগোস্ফিয়ার ইরানের রাজনীতি বাদ দিয়ে মাইকেলের সেরা গান বাছাই নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে [২]।
হিল তাঁর নিবন্ধে রং দে আরব বাসন্তী প্রপঞ্চটিকে আরেকটু ভালোমতো খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন। যদি সামাজিক যোগাযোগ সাইটের কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই না থাকবে, তাহলে এদের নাম এতো ফাটলো কীভাবে? তিনি খুঁজে বার করেছেন দু'টি কারণ। এক, সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো চায় তাদের নাম ফাটুক, সেই খাতে তারা কিছু খরচাপাতি চেষ্টাচরিত্রও করে, তাই তাদের নাম কিছুটা ফাটে। দুই, তাদের চেষ্টাচরিত্রের বাইরে নাম ফাটে সাংবাদিকদের কারণে। পশ্চিমা মিডিয়ায় সাংবাদিক ছাঁটাই চলছে সমানে। যুক্তরাষ্ট্রে ২৫% সাংবাদিক ছাঁটাই হয়েছেন খবরের কাগজ থেকে। সারা বিশ্বে যখন নানা গিয়ানজাম চলমান, যখন ভালো সাংবাদিককে অকুস্থলে গিয়ে ঘটনার ওপর রিপোর্টিং করা জরুরি হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই চলছে উল্টো ছাঁটাই। বাজেটেও নানা কাটছাঁট করে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে সাংবাদিকরা আর ডেস্ক ছেড়ে বেরোয় না, সামাজিক মিডিয়ায় নানা তথ্য-তত্ত্ব-ছবি-গালি-বুলির তালাশ করে বেড়ায়। তাতে করে সামাজিক যোগাযোগের সাইটের কদর বাড়ে, আর বড় মিডিয়া হাউসগুলো নিজেদের খরচ কমানোর ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে পারে।
এই ধরনের চিন্তা বা বিশ্লেষণ থেকে আমাদের মিডিয়া দূরে। গুটি কয়েক পোড় খাওয়া ঝানু সাংবাদিকের পাশাপাশি অগণিত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সংবাদকর্মী আমাদের দেশে মিডিয়া চালায়, যাদের অনেকে ঠিকমতো ইংরেজি থেকে বাংলাও করতে পারে না, ভুলভাল লিখে ছেপে বা এয়ার করে বসে থাকে। এরা এই গোটা আরব বসন্তের ঘটনাকে মিডিয়ায় উপস্থাপন করেছে ফেসবুক বিপ্লব হিসেবে। আমাদের এক বিতাড়িত রাষ্ট্রপতির বাতিল রাজনীতিক ছেলে ফেসবুকে তরুণদের রাজনৈতিক দল খুলে বসেছেন আরব বসন্তের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে। এই আরব বসন্তের ঝোঝুল্যমান মূলা ধামরাইয়ে খালেদা জিয়ার জনসভাতে্ও উচ্চারিত হতে শুনি আমরা। মিডিয়াও নিজের অজ্ঞতা-মূর্খতা চেপে চুপে রেখে ফেসবুক আর সামাজিক যোগাযোগের সাইটের বিপ্লবপ্রসূ চেহারাটাকে জিইয়ে রাখে, আবার সময় বুঝে সেই একই ধরনের সাইটগুলোকে শেকলবন্দী করার জন্যে চারতারা হোটেলে দাওয়াত করে এনে রাজনীতিকদের ধমকায়, কেন এখনও এইসব সাইটকে লাগাম-কাপাইয়ের আওতায় আনা হয়নি।
আমরা জানি, আমাদের দেশে মিডিয়া অনেক স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু মিডিয়ার আচরণ আরব বিশ্বের বন্দী মিডিয়ার মতোই। ভেতরে ভেতরে হয়তো আমাদের মূল মিডিয়া জানে, তাকে রফা করতে হবে তাদের সাথেই, যাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সাধারণত হয়। তাই সে পরিচয়ে স্বাধীন হলেও আচরণে বশংবদ। সামাজিক যোগাযোগের সাইটের জুজু দেখাতে পারলে রাজনীতিকের সাথে তার দর কষাকষির সুযোগ প্রশস্ত হয়, সংকীর্ণ হয় না। তাই রাজনীতিকরা ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, মিডিয়া এই উদ্বেগ সরবরাহ করে খুশি থাকে। আমাদের দেশে অতীতে বিনা নোটিসে ইউটিউব আর ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে (দেশে কিছু কর্তৃপক্ষের মনোভাব আইয়ুবের আমলাদের চরিত্র বহন করে এখনও), সেও এই উদ্বেগেরই ফসল।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের কি কোনো ভূমিকাই তাহলে বিপ্লবে নেই? এই যে আমরা ব্লগিং করছি, ফেসবুকে সন্নিবিষ্ট হচ্ছি, মত বিনিময় করছি, সকলই ভ্রান্ত সিন? মিডিয়া তাহলে সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে এমন আড়ে আড়ে তাকায় কেন? ব্লগ নিয়ন্ত্রণে তাহলে কিছু লোক আইন চায় কেন? ঢোঁড়া সাপের জন্যে তাহলে কেন কুঁচকি পর্যন্ত গামবুট?