মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও আশঙ্কা
লেখক: আ. কাইউম | বুধবার, ২৯ অগাষ্টu-এ ২০১২, ১৪ ভাদ্র ১৪১৯
তাহলে বোয়াজিজিই কি সেই মহানায়ক, যিনি নিজের গায়ে আগুন দিয়ে জীবন উত্সর্গ করে উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় বেনআলীবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তার পতনের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে মিসরের হোসনি মোবারককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এবং লিবিয়ার লৌহমানব মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির চার দশকের শাসনের অবসানের পর ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোকে গণতন্ত্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীতল করেছেন? নাকি মহাবীর তারাও যারা তিউনিসে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, যারা ত্রিপলিতে ও বেনগাজীতে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিল এবং যারা মিসরের তাহরীর স্কয়ারকে রক্তে রর্িঞ্জত করেছিল? এরা সবাই মহাবীর—কারণ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনে এদের সবারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান রয়েছে। তবে বোয়াজিজি একটু বেশিই। কারণ ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলো থেকে আরব বসন্তের হাওয়া সুয়েজখাল পাড়ি দিয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় এসে থমকে আছে। থমকে থাকলেও এর সূচনা কিন্তু বোয়াজিজির হাতেই। যুদ্ধরত ও সমঝোতাহীন সিরিয়ার বর্তমান বিষয়টির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এতই বেশি যে, এই অঞ্চলকে সবাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বর্তমানে এ অঞ্চলের গুরুত্ব আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ এ অঞ্চল তিন মহাদেশের মিলনস্থল, নৌ যোগাযোগব্যবস্থা, ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা (মুসলমানদের মসজিদুল আকসা, খ্রিস্টানদের বেথেলহেম, ইহুদীদের সিনামোম) এবং আরো রয়েছে তেল সম্পদ। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মিসর, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান ও সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের গুরুত্ব একটু বেশিই।
এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে দৌড়ঝাঁপ ও কূটনীতি বেলফোর ঘোষণার (নভেম্বর ১৯১৭) পর থেকে শুরু হয়েছে, তা আজও বিরাজমান। যুদ্ধবিরোধী যুদ্ধে জয়ী হতে এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে ১৭২টি আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানসহ ৮০টিরও বেশি অনিবার্য যুদ্ধ নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এ-সংস্থাটি। অছি পরিষদের (Trustship Council) অধীনে অসংখ্য দেশ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ফিরে পেয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যাসংকুল বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়। যেমন কম্বোডিয়া, নামিবিয়া, এলসালভাদর, মুজাম্বিক, পূর্বতিমুর ইত্যাদি দেশে গণতন্ত্রসহ তাদের আত্মঅধিকার ফিরে পাবার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাই প্রধান। তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে, যা এক দীর্ঘ সমস্যা, তা কেন শান্তি প্রতিষ্ঠার নিয়তে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ সমাধান করতে পারছে না? তাহলে জাতিসংঘ কি এক মেরুকেন্দ্রিক কোনো হুকুমের তাঁবেদারি করছে? নাকি আজ জাতিসংঘ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠনের পরিবর্তে পুতুল সংগঠনে পরিণত হয়েছে? বিশ্বমানচিত্রে আজ ফিলিস্তিন একটি সার্বভৌমত্বহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে (১৫ মে ১৯৪৮) ৭৮% এবং তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বাকি ২২% ভূমি ইসরাইল দখল করলে পুরো ফিলিস্তিন একটি উদ্বাস্তু রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৬৪ সালে পিএলও গঠনের পর ১৯৮৮ সালে তিউনিসিয়ায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং ঘোষণা মোতাবেক ফিলিস্তিন স্বাধীনতার প্রহরও গুনছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে দৃশ্যপট আস্তে আস্তে পালটে যায়। কারণ ইরাকের সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাঁটছড়া যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করেছিল। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র এমন আচরণ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গেও করেছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বন্যা হলে যুক্তরাষ্ট্র PL-480 (Public Law-480)-এর আওতায় গম সহায়তার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে পাটের বাণিজ্যচুক্তি করায় গম সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে এক বৃহত্ জাতীয় শক্তির অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ বা বল প্রয়োগ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতি প্রায়ই চোখে পড়ে। যাই হোক, এতকিছুর পরও (স্বায়ত্তশাসন চুক্তি ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, হেবরণ চুক্তি ১৫ জুন ১৯৯৭, ভূমির বিনিময়ে শান্তি চুক্তি/ওয়াইরিভার-১ ২৩ অক্টোবর ১৯৯৮, ওয়াইরিভার-২ ৪সেপ্টেম্বর ১৯৯৯) ২০১২ সালে এসেও ফিলিস্তিনিয় স্বাধীনতা অর্জিত হচ্ছে না, যা রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৫ সালে হবার কথা ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন সমস্যার সঙ্গে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সিরিয়ার পরিস্থিতি দ্বিমেরুকেন্দ্রিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU), অন্যদিকে সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়া, চীন ও ইরান। উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি ২০০৫-এ ইরান-সিরিয়া পারস্পরিক হুমকি মোকাবেলায় আত্মরক্ষামূলক একটি প্রতিরক্ষাচুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ১৮৭০ সালে জার্মান জাতির জনক অটোভান বিসমার্কের নেতৃত্বে গড়া শক্তিজোটের মতো এক জোট, যা আমেরিকার প্রতি সরাসরি এক চ্যালেঞ্জের শামিল। অটোভান বিসমার্কের বিরুদ্ধে রাশিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেনের (১৮৯৩) মতো পালটা শক্তিজোট করে আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ কি সিরিয়া ও ইরান? আর এ আগমনী বার্তাই কি কিছুদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যে সফরে এসে দিয়ে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী রডহ্যাম ক্লিনটন?
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও আরবের কয়েকটি দেশ ‘ফ্রেন্ডস অব সিরিয়া’ জোটের প্রতি সমর্থন দিলেও সিরিয়ার সহিংসতার জন্য প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। পঞ্চ শক্তির বৃহত্ দুই শক্তি চীন ও রাশিয়া যদি সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে থাকে তাহলে আমেরিকা ও ইইউ (EU) সমর্থিত কোনো সামরিক বাহিনী (NATO) পদক্ষেপ নিতে পারবে না। আর যদি নেয়ই তাহলে এই আধুনিক বিশ্ব যার মুখোমুখি হতে পারে— সে জন্য জুলাই ২০১০-এ কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর একটি টেলিভিশন সাক্ষাত্কারের কিছুটা উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেন, “ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের মুখোমুখি অবস্থান বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর এজন্য দায়ী থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।” তাই ইরানে পারমাণবিক কর্মসূচির নাম দিয়ে হোক, অথবা সিরিয়ার সহিংসতা বন্ধের নাম দিয়ে হোক বৃহত্ কোনো শক্তির বিরুদ্ধে আমেরিকার এমন কোনো পদক্ষেপ পৃথিবীকে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতির সামনে ফেলতে পারে। আর এমন পরিস্থিতি যদি ঘটেই তাহলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী/রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের আলোচিত থিসিস The clash of civilization-এর মূল কথাই প্রতিফলিত হবে যে, “ভবিষ্যত্ সংঘাতের চরিত্র হবে সভ্যতাভিত্তিক, রাষ্ট্রভিত্তিক নয় এবং স্নায়ুযুদ্ধ (cold war) পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় এই সভ্যতা শক্তিশালী হবে ‘সাংস্কৃতিক যোগসূত্র’-এর ভিত্তিতে, যার মূল উপাদান হবে ধর্মকেন্দ্রিক, এর একদিকে থাকবে ইসলাম ও চীন, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদি গণতান্ত্রিক দেশগুলো।”
ঢাকা
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.