Monday, October 15, 2012

সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশনের মূল্যায়ন


সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশনের মূল্যায়ন

লেখক: মোহাম্মদ আতাউর রহমান  |  সোমবার, ১৫ অক্টোবর ২০১২, ৩০ আশ্বিন ১৪১৯
গ ত ১৮ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৭তম অধিবেশন। ২৪  সেপ্টেম্বর উচ্চ পর্যায়ের সভা ও ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া সাধারণ বিতর্ক ছিল অধিবেশনের কেন্দ্রবিন্দু। জাতিসংঘভুক্ত ১৯৩টি দেশের প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও সংস্থা এতে অংশ নেয়। সভাপতিত্ব করেন সার্বিয়ার ডাক জেরেমিন। ব্যাপক আশা উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হয়ে যথারীতি বক্তৃতা আর অঙ্গীকারের ফুলঝুরি দিয়ে শেষ হয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কথা বলার একমাত্র প্লাটফর্ম সাধারণ পরিষদের এবারের অধিবেশন। আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল- সিরিয়া, ইরান ও বিতর্কিত চলচ্চিত্র ইস্যুগুলো অধিবেশনে উত্তাপ ছড়াতে পারে। হয়েছেও ঠিক তাই। তবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো হট ইস্যুতে অধিবেশনে জোরালো আলোচনা হতে পারত। তদুপরি ৬৭তম অধিবেশনটি যেসব কারণে বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে সেগুলো হচ্ছে-জাতিসংঘের সংস্কারের জোরালো দাবি, ইরানি প্রেসিডেন্টের নতুন বিশ্বব্যাবস্থার ধারণা, সিরিয়া ইস্যুতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিভক্তি, ইরানের পরমাণু ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর পরস্পর বিরোধী অবস্থান। এসব বিবেচনায়  এবারের অধিবেশনকে ব্লাংক চেক দেওয়া যায় না।
অধিবেশনে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের বক্তব্য পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতিতে খুবই তাত্পর্যবহ, সন্দেহ নেই তাতে। সম্মেলনের পূর্বে জাতিসংঘ মহাসচিব নেজাদকে কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য পরিহার করতে সাবধান করেন। সেটি উপেক্ষা করে নেজাদ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে কঠিন সত্য কথাগুলো অকপটে বলে দিলেন। তিনি পশ্চিমা শক্তিকে শয়তান আখ্যা দিয়ে আধিপত্যমুক্ত একটি নতুন বিশ্বব্যাবস্থা গড়ার আহবান জানান। নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপকল্প তুলে ধরে বলেন, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদীদের আগ্রাসনের শক্তি নিস্তেজ হয়ে  গেছে এবং পৃথিবীর  কেউ এখন আর একক  কোনো কর্তৃত্ব  মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তিনি বলেন, নতুন বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখেই পৃথিবীর অন্য রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তার টানা ৩৫ মিনিটের ভাষণ তৃতীয় বিশ্বের নিগৃহীত ও বঞ্চিত মানুষের চিন্তার প্রতিফলন বললে বোধকরি অন্যায় হবে না। প্রসঙ্গেক্রমে বলে রাখা ভালো যে, নতুন বিশ্বব্যবস্থার ধারণা এর আগে নিয়ে আসেন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। উপসাগরীয় যুদ্ধ চলাকালে ১৯৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি এমন একটি ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন, যা সন্ত্রাসের হুমকিমুক্ত হবে। যেখানে ন্যায়বিচার, শান্তি ও প্রতিটি জাতির সহাবস্থান নিশ্চিত হবে। তার সেই স্বপ্নের বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তার পরবর্তী শাসকরা ব্যর্থ হয়েছেন সেটি  যেমন সত্য, নেজাদের প্রস্তাবিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে আগেরটির যথেষ্ট ফারাক, সেটিও মিথ্যা নয়। স্নায়ুযুদ্ধোত্তরকালে আমেরিকা একমেরুকেন্দ্রিক যে বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছে তার অবসান চেয়েছেন ইরানি প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব এবং নব্যবাস্তববাদী তাত্ত্বিক প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট জিলপিনের ঐতিহাসিক হেজেমনিক ডিক্লাইন তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে সেই প্রস্তাব অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই। জিলপিনের মতে, কয়েকটি প্রক্রিয়ার কারণে কতৃত্ববাদী রাষ্ট্র (হেজেমনিক স্টেট) পড়ন্ত অবস্থায় পতিত হবে। প্রথমত: সময়ের প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক কতৃত্ববাদী রাষ্ট্রের অধিক ব্যয় ও কম বিনিয়োগ প্রবণতার কারণে। দ্বিতীয়ত: প্রযুক্তির পরিব্যাপ্তি: যার ফলে উদীয়মান শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কতৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত: মারজিনাল রিটার্ন, কোনো রাষ্ট্র যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ীই তার ক্ষমতার প্রান্তিকিকরণ হয়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির পন্ডিতদের মতে, আরও কয়েকটি কারণে কতৃত্ববাদী একক শক্তিধর রাষ্ট্র ক্ষমতা হারায়। সেগুলো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ব্যয় বেড়ে গেলে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ যদি প্রতিষ্ঠিত শক্তিধর রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। এসব বিশ্লেষণ করলে এটি বুঝা কঠিন নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের একমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা নিকট ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। কারণ আমেরিকার অর্থনীতি বর্তমানে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সংকটে রয়েছে। সে তুলনায় তার খরচ কিন্তু কমেনি। প্রযুক্তির পরিব্যাপ্তির কারণে অনেক দেশ নতুন করে পরমাণু অস্ত্র অর্জন করতে যাচ্ছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে পর্যবেক্ষকদের  কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের কতৃত্ববাদী ব্যবস্থা নস্যাত্ করে দিতে তুরুপের তাস হবে বেইজিং। তাছাড়া বিশ্বের বৃহত্ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে, তাকে নিয়েও অনেকে বাজি ধরতে দ্বিধা করবেন না। রাশিয়া অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠলে আর জাপান যদি মার্কিন তোষণ নীতি থেকে বেরিয়ে আসে তবে একমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা যে আর থাকবে না সেই সরল সমীকরণ কিন্তু করাই যায়।
অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণের দুটি দিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত: সম্প্রতি ইসলাম বিদ্বেষী চলচ্চিত্র নিয়ে মুসলিম বিশ্বে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া নিয়ে ওবামার বক্তৃতা। দ্বিতীয়ত: ইরানের পরমাণু ইস্যুতে তার অবস্থান। ওবামা মুহাম্মদ (স.)কে কটাক্ষ করে চলচ্চিত্র নির্মাণের নিন্দা জানান। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সহিংসতা ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বিশ্বনেতাদের সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান। ওবামা ধর্মবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণের নিন্দা জানিয়ে ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ভোটারদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি অধিবেশনে উপস্থিত মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টসহ অনেক রাষ্ট্রপ্রধান আগে থেকে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন যে, অধিবেশনে এ বিষয়ে আলোচনার সূচনা করে পশ্চিমা বিশ্বকে জুতসই জবাব দেওয়া হবে। মুসলিম নেতারা তাদের পরিকল্পনায় কতটুকু সফল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ওবামা যে তার কৌশলে ঠিকই সফল হয়েছেন, তা বুঝতে তার বক্তৃতার পরের অংশটুকু দেখতে হবে। লিবিয়ার  বেনগাজিতে মার্কিন উপদূতাবাসে হামলা ও বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিক্ষোভের প্রতিবাদ জানিয়ে ওবামা বিক্ষোভকারীদের যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেন।
সিরিয়া ইস্যুতেও ওবামা বরাবরের মতো ইরানের প্রতি আক্রমণের তীর নিক্ষেপ করেছেন। সিরিয়াকে সহায়তা করার অভিযোগ এনে তিনি ইরানকে রীতিমত শাসিয়েছেন। এ বিষয়ে ইরানকে দোষারোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের স্টেরিও টাইপ (বদ্ধমূল) ধারণা বলতে হবে। কারণ পার্শ্ববর্তী দামেস্কের সঙ্গে তেহরানের সুসম্পর্ক রাখাটা যেমন অন্যায় নয়। ঠিক তেমনি আসাদ বাহিনীকে তেহরান অদৌ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে কিনা তাও প্রমাণিত নয়। সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিপরীতমুখী অবস্থানে জাতিসংঘ পুনরায় ব্যর্থ হলো। ১৮ মাসের এ যুদ্ধে ১৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং প্রায় ৭ লাখ লোক শরণার্থী হয়েছে। এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়ার ভেটোর মুখে সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধা হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটোর মুখে সিরিয়া সমস্যা সমাধানে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় সাধারণ পরিষদ কিন্তু অতীতের মতো শান্তির জন্য ঐক্য প্রস্তাব  পাস করতে পারতো।  স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি সিরিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে এবার সাধারণ পরিষদ শান্তির জন্য ঐক্য প্রস্তাব পাস করল না কেন?
২৮ আগস্ট ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে বিশ্বনেতাদের একটি রেড লাইন বেধে দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে বলেন, তেহরান ১ বছরের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে। বোমার একটি কার্টুন একে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন তেহরান বোমা তৈরির কার্যক্রম ৯০ শতাংশ এগিয়ে নিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য  দেয় যে, ওই ইস্যুতে ইসরায়েলের এমন অবস্থান নতুন নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণে জাতিসংঘ, ব্রেটন উড্স প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক সংস্থার সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। অগণতান্ত্রিক ভেটো ক্ষমতার ফাঁদে পড়ে জাতিসংঘের স্বকীয়তা দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ বাজেটের এক চতুর্থাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এতে করে সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সনদের ২৩ নং ধারা অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদে বর্তমানে ৫টি স্থায়ী সদস্য রয়েছে। পাঁচটির মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ইউরোপ পৃথিবীর মোট ভূখন্ডের ৬.৬ শতাংশ অথচ নিরাপত্তা পরিষদে তার প্রতিনিধিত্বের হার ৬০ শতাংশ।
জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব ব্রুট্টোস ঘালি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কফি আনানও প্রাশাসনিক সংস্কারে ১০ দফা কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতিসংঘের সংস্কারের কফিনে পরিকল্পিতভাবে শেষ পেরেকটি মেরে দিয়েছেন খোদ সনদ প্রণেতারা। সনদের ১০৮ নং ধারায় বলা আছে, জাতিসংঘের সনদ সংশোধনের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যসহ অন্তত ৯ জন সদস্যের সম্মতির প্রয়োজন। তাই দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন থাকা অবস্থায় সংস্থাটির সংশোধনের দাবি শুধু দাবিতেই থেকে যাবে। তবে পবিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সংস্থাটির ভূমিকা আরও  জোরালো, বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক করার কোনো বিকল্প নেই।  সেজন্য ৬৭ তম অধিবেশনের আলোচনাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার এনে জাতিসংঘকে ঢেলে সাজিয়ে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী করে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
ataur_irdu@yahoo.com

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.