Thursday, December 13, 2012

পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হলো ফিলিস্তিন স্বাধীনতা কত দূর? :: দৈনিক ইত্তেফাক


পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হলো ফিলিস্তিন স্বাধীনতা কত দূর?
অনুষ্টুপ অনু
ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির আরো এক ধাপ এগোনোর জন্য গত বৃহস্পতিবার দিনটা ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেল। ওই দিনটিতে অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক সমর্থনের সাক্ষী হয়ে থাকল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। এবার পর্যবেক্ষক অ-সদস্য রাষ্ট্রে উন্নীত করা উচিত ফিলিস্তিনকে—এমন প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ সভার সদস্যভুক্ত দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দেশ। 

নিউ ইয়র্কে গত বৃহস্পতিবার ১৯৩টি দেশের জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ফিলিস্তিনকে স্বতন্ত্র দেশের মর্যাদা দেয়া নিয়ে ভোটাভুটি হয়। অভাবিত সংখ্যাগরিষ্ঠতায়—১৩৮-৯ ভোটের ব্যবধানে প্রস্তাব পাষ হয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। ভোটদানে বিরত থেকেছে ৪১টি দেশ। ভোটাভুটির ফল প্রকাশ্যে আসতেই আসন্ন স্বাধীনতার সম্ভাবনায় উদ্বেল ফিলিস্তিনীয়রা পথে নেমেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে বরাবরই বিরোধী এই দুটি দেশের কাছে গত বৃহস্পতিবারের সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই বড়সড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে। জার্মানি ও ব্রিটেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধীতা করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।

ঘটনাচক্রে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়েছে হামাস-ইসরায়েল সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির মাত্র কয়েক দিনের মাথায়। তবে পরিস্থিতি বলছে—একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের বিরোধীতা, অন্য দিকে হামাস ও ফাতাহর মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা পাওয়ার পথে। তাত্পর্যপূর্ণ ভাবে হামাস কিন্তু ভোটাভুটির ফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

ফিলিস্তিন ন্যাশনাল অথরিটির প্রেসিডেন্ট ও ফাতাহ গোষ্ঠীর প্রধান মাহমুদ আব্বাস তখন উপস্থিত সেখানে। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে ভোটের ফল ঘোষণা হতেই আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিনিধির সামনে তোলা হয়েছে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা। আব্বাস বলেছেন, 'জাতিসংঘের সাধারণ সভা আজ ফিলিস্তিনের বার্থ সার্টিফিকেটে সই দিল। এই মুহূর্তটা দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে চলে আসা দীর্ঘ দিনের সমস্যার সমাধান খোঁজার একটা শেষ সুযোগ।' এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লা শহরে পথে নেমেছেন উল্লসিত ফিলিস্তিনীয়রা। হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা, মুখে 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনি। ঘটনা হলো—এত দিন আব্বাস গোষ্ঠীর বিরোধিতা ও সমালোচনা করা সত্ত্বেও সম্ভবত ফিলিস্তিনের সাধারণ স্বাধীনতাকামী মানুষের আবেগের কথা মাথায় রেখে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেনি হামাস। রামাল্লার উল্লাসে সামিল হতে দেখা গিয়েছে তাদের সমর্থকদেরও। হামাস জানিয়েছে—জাতিসংঘের এই প্রস্তাবনায় তারা নাকগলানোর পক্ষপাতী নয়।

জাতিসংঘের রায় পক্ষে গেলেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির রাস্তাটা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ দিনের ভোটের অর্থ—১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম, গাজা স্ট্রিপ ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের যে যে অংশ ইসরায়েল দখল করেছিল, তা এবার চলে আসবে ফিলিস্তিনের দখলে। সবচেয়ে বড় কথা—এবার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধদমন আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে আব্বাসের ফিলিস্তিন। যুদ্ধে জিতে যে জমি দখল করে নিয়েছিল ইসরায়েল, সেই ভূখণ্ডে 'অবৈধ নির্মাণ' বা যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিন আবেদন জানাতে পারবে আন্তর্জাতিক আদালতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃত স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে এখনো অনেক দেরি। কারণ, তার আগে সম্ভবত শান্তি মধ্যস্থতায় যেতে হবে ইসরায়েলের সঙ্গে। ফিলিস্তিনের চিরবৈরী প্রতিবেশী ইহুদি রাষ্ট্রটি আগেই ঘোষণা করেছে—ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চিরন্তন সমস্যার যা সমাধান হতে পারত, জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত তা শুধু দেরিই করবে। 

এই ভোটাভুটির পরই ইসরায়েল অভিযোগ তুলেছে—দুই পক্ষের মধ্যে যে মধ্যস্থতা চলছিল, তা পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদার দাবিতে জাতিসংঘে জোরালো প্রস্তাব রেখেছিল ফিলিস্তিন। মাহমুদ আব্বাস অবশ্য জাতিসংঘে বলেছেন, 'ইসরায়েলের মোকাবিলা বা তার বৈধতা খর্ব করার লক্ষ্যে নয়, বরং ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা প্রশস্ত করার লক্ষ্যেই এই প্রয়াস।' এ সুযোগে অবশ্য ইসরায়েলকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি মাহমুদ। বলেছেন, 'ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ঔপনিবেশিক দখলদারি কায়েম করেছে। জাতিগত আধিপত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকতার রূপ দিয়েছে ইসরায়েলিরা।' 

প্রত্যাশিতভাবেই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছে ইসরায়েল। এই ভোটাভুটিকে 'অর্থহীন' বলে আখ্যা দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। আব্বাসের বক্তব্যকে তিনি নস্যাত্ করেছেন, 'নোংরা, অপমানজনক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার' বলে। নেতানিয়াহুর কথায়, 'জাতিসংঘে যে প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে, তার জন্য বাস্তবে কিছু বদলাবে না। এই সিদ্ধান্তের ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তো এগোবেই না, বরং পিছিয়ে যাবে অনেকটাই।'

প্রায় একই সুরে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রও। হিলারি ক্লিনটন এই ভোটাভুটিকে বর্ণনা করেছেন 'দুর্ভাগ্যজনক ও বাস্তবতাবিরোধী' হিসেবে। তার কথায়, 'আমরা বরাবরই বলে এসেছি যে, একমাত্র মধ্যস্থতার মাধ্যমেই শান্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। সেই শান্তি দু্ই দেশের প্রাপ্যও। যা হওয়া উচিত, তা-ই হলো—একদিকে সার্বভৌম, স্বাধীন ফিলিস্তিন এবং অন্য দিকে ইহুদি-অধ্যুষিত গণতান্ত্রিক ইসরায়েলের শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত সহাবস্থান। কিন্তু ভোটাভুটিতে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত তা করতে পারবে বলে আমরা মনে করি না।' 

শুধু বাইরে ইসরায়েল-আমেরিকার চড়া বিরোধতাই নয়, ঘরেও সম্ভবত যথেষ্ট বিরোধীতার মুখে পড়তে হবে মাহমুদ আব্বাসকে। ২০০৪ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পরে কট্টরপন্থী হামাস এবং মধ্যপন্থী ফাতাহয় বিভক্ত হয়ে পড়ে ফিলিস্তিনীয়রা। তারপর থেকে ক্রমশ শক্তি বেড়েছে হামাসের, আর দুর্বলতর হয়েছে আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ছাড়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিতর্কিত ভূখণ্ডের প্রায় কোনো অংশই এখন আব্বাসের দখলে নেই। বরং গাজা স্ট্রিপের মতো শরণার্থী-অধ্যুষিত ঘন জনবসতিপূর্ণ ভূখণ্ডের দখল নিয়ে রেখেছে হামাস। বারবার আগ্রাসন দেখানো সত্ত্বেও গাজার দখল শেষ পর্যন্ত নিজেদের হাতে নিতে পারেনি ইসরায়েল। অতি সম্প্রতি দুই পক্ষের হিংসা বন্ধ হয়েছে আট দিন পর যুদ্ধবিরতিতে। 

ঘটনা হলো—কট্টরপন্থী হামাস যেমন ইসরায়েলের স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদাকে মান্যতা দেয় না, তেমনি তারা বিশেষ পাত্তা দেয় না 'ইসরায়েলি পুতুল' মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহকে। অনেক ফিলিস্তিনীয় এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—ফিলিস্তিনকে প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা কেউ এনে দিতে পারলে তা হামাস-ই পারবে, ফাতাহ নয়। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন—জাতিসংঘ গত বৃহস্পতিবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা মাহমুদ আব্বাসের হারানো শক্তি বেশ কিছুটা ফিরিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাওয়ার পথে নিশ্চিতভাবেই অনেকটা এগিয়ে গেল ফিলিস্তিন।

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.