Monday, December 31, 2012

জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে সাপ!----দৈনিক ইত্তেফাক


জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে সাপ!
চিররঞ্জন সরকার
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে আকস্মিকই সাপ নামের প্রাণীটি আলোচিত হয়ে উঠেছে। বছরের শেষে এসে প্রধান দুই নেত্রীর কাছে সাপ নামক প্রাণীটি বড় উপমা হিসেবে ধরা দিয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীতে তার বিভিন্ন পথসভায় বলেছেন, 'সাপকে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু আওয়ামী লীগকে নয়। এর একদিন পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নেত্রী সাপের ঝাঁপি মাথায় নিয়ে চলেছেন। তবে, বিরোধী দলীয় নেত্রী সাপের কথা বললেও ওঝার কথা বলেননি। এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বলেন, সাপের বিষে অনেক সময় ওঝাও মারা যায়। বিরোধী দলীয় নেত্রী বিষধর সাপ নিয়ে চলেছেন। সাপের দংশনেই তিনি ধ্বংস হবেন। 

সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, 'খালেদা জিয়া সাপ চেনেন ভালো। কারণ জাতে জাত চিনে। আওয়ামী লীগ সাপ নয়। আমরা সাপ থেকে জাতিকে রক্ষা করেছি।' তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, খালেদা জিয়া মানুষকে বিশ্বাস না করে সাপের সঙ্গে বসবাসের ঘোষণা দিয়েছেন। যিনি সাপের সঙ্গে বসবাস করতে চান তিনি গণতন্ত্র ও রাজনীতির অনুপযুক্ত। এর আগে গত নভেম্বরে কক্সবাজারের বৌদ্ধপল্লী সফররত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে 'সাপ হয়ে দংশনের পর ওঝা হয়ে ঝাড়ার' খেলা বন্ধ করতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ দংশন করে জাতিকে নীল করে ফেলেছে। একই সঙ্গে 'ওঝা' ও 'সাপের' ভূমিকায় রয়েছে তারা । 

দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা একে অপরকে সাপের সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে রাজনীতিতে সাপ এবং সাপের বিষ দুইয়েরই উত্পাত বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

অবশ্য আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে একে-অপরকে সাপ হিসেবে চিহ্নিত করার এই প্রবণতা আকস্মিক নয়; নিরর্থক তো নয়ই। আমাদের রাজনীতি তো সাপের খেলাই বটে। এখানে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা যতটা না দেখা যায়, একে অপরকে মরণ কামড় দেয়ার প্রতিযোগিতা দেখা যায় তার চেয়ে বেশি। মরণ ছোবলে বংশ শুদ্ধ ধ্বংস করার আয়োজনও দেখা যায়। এর পরও এই সাপদের ক্ষয় নেই! 

অবশ্য আমাদের জীবনে সাপের প্রভাব অপরিসীম। আমাদের শিশুশিক্ষার শুরুই হয় অ-তে অজগরটি আসছে তেড়ে। আমরা গ্রাম বাংলায় এক সময় বাড়ির আনাচে-কানাচে সাপ দেখতাম, সাপের ভয়ে তটস্থ থাকতাম। এক-আধজনকে সাপে কাটেনি—এমন পরিবার তখন খুঁজে পাওয়া যেত না। তখন আমরা যেসব রূপকথার গল্প শুনতাম তার মধ্যে সাপ-ওঝার ব্যাপার থাকতোই। আর বাংলা সিনেমা মানেই তো ছিল নায়ক বা নায়িকার সাপের কামড়ে অজ্ঞান হওয়া, এরপর নায়ক বা নায়িকার চেষ্টায় বিষমুক্ত হওয়া, অতঃপর বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা। সাপের কাহিনী নিয়ে তৈরি বাজ্ঞারান কিংবা বেদের মেয়ে জোসনা আমাদের সিনেমা জগতে এখনও সুপারহিট।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মা মনসা হচ্ছেন সাপের দেবী, এই দেবীকে সবাই খুব সমীহ করে চলেন। আমরা চাঁদ সওদাগর নামে একজন ঘাড় ত্যাড়া বণিকের লোককাহিনী জানি যে মনসাকে মানেনি বলে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আমরা হতভাগিনী বেহুলার কাহিনী শুনেছি যার স্বামী লক্ষীন্দরকে লোহার বাসরেও সাপে কেটেছিল। সেই সাপে কাটা স্বামীকে ভেলায় ভাসিয়ে বেহুলা তার স্বামীর জীবন ফিরে পাওয়ার অসম্ভব অভিযানে নেমেছিলেন। বিখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক গানে 'আজি ভেলায় ভাসে বেহুলা বাংলারে' বলে তার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। 

আমরা শৈশব-কৈশোরে লুডু নামের একটি অলস এবং ফালতু খেলা খেলতাম। এর মধ্যে একটি ছিল সাপ লুডু। উপরে উঠতে উঠতে হঠাত্-ই সাপের ফণার মুখে। তার পর সাপের শরীর বেয়ে নেমে যাওয়া। আবার উপরে উঠার চেষ্টা। তখন আনন্দ না পেলেও এখন মনে হয়, এই খেলাটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীকী। সারাজীবন আমরা উপরে উঠার সাধনা করবো। কিন্তু সাপের মুখে পড়ে আবার নিচে নেমে যাব। এই প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে চলছে তো চলছেই। 

আমরা কৈশোরে সুকুমার রায়ের একটি ছড়ায় এক অদ্ভুত সাপের বয়ান শুনেছিলাম, 'বাপুরাম সাপুড়ে/কোথা যাস বাপুরে/আয় বাবা দেখে যা/ দুটো সাপ রেখে যা/যেই সাপের চোখ নেই/শিং নেই...করে নাকো ফোঁস-ফাঁস মারে নাকো ঢুঁস-ঢাস...(আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে মহামহিম সুকুমার রায় এমন একটি আশ্চর্য সাপের ছবি এঁকেছিলেন কিনা কে জানে)!

আমাদের এক যৌবনদীপ্ত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তার এক কবিতায় আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে/আমি চুম্বনে চাইবো না অমরতা/আমাদের প্রেম হোক বিষে জর্জর/ সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা। আমাদের নেতানেত্রীরা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মতো সবকিছুকে 'বিষে জর্জর' করার অভিযানে শামিল হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের সমাজে সুনীতি, সদাচার, সততা যেভাবে বিলুপ্তপ্রায় তেমনিভাবে সাপ এবং সাপ নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী-কাব্যও বিলুপ্ত হতে বসেছে। এমন এক সন্ধিক্ষণে আমাদের নেতানেত্রীরা এই বিষধর প্রাণীটিকে সামনে তুলে আনার পেছনে নিশ্চয়ই গূঢ় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে! 

ছোটবেলায় আমরা কোনো কিছু না ভেবেই অ-তে অজগর আসছে তেড়ে পড়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে মনে প্রশ্ন জেগেছে, অজগর শুধু শুধু কেন আসবে তেড়ে? সে কি আমাদের ভয় দেখানোর জন্য? যত সব ফালতু কথা। জীবনের শুরুতেই অজগরের তাড়া খেয়ে আমরা শিক্ষার পাঠ শুরু করেছি। এখন দেখছি সেই শিক্ষাও নিরর্থক ছিল না। পুরো জাতিকেই এখন তাড়া করছে অজগর। শুধু অজগরের কথাই বা বলি কেন, আরও অনেক অনেক বিষধর সাপ। এই সাপেরা রাজনীতির মঞ্চকে জঙ্গল বানিয়ে ফেলছেন। আর নিজেরা পরিণত হচ্ছেন ভয়ঙ্কর কালসাপে। তবে সাপ নিয়ে না খেলাই ভালো। সাপ কখনও কারো বন্ধু হয় না। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যাক একটি প্রাচীন গল্প। দুই বন্ধু মিলে দেশ ভ্রমণে বের হলো। এদের একজন ছিল অন্ধ। হাঁটতে হাঁটতে ওরা এমন এক জায়গায় আসলো যেখানে রাতে খুব ঠাণ্ডা আর দিনে প্রচুর গরম। দুই বন্ধু এক গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে যে বন্ধু চোখে দেখতে পায়, সে খাবারের খোঁজে বের হলো। অন্ধ বন্ধুটি আশপাশে যা আছে তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো।

একটি সাপ বরফে জমে অবশ হয়ে এক পাশে মরার মত শুয়ে ছিল। অন্ধ বন্ধুটি সাপটিকে ধরে ভাবলো এটি একটি লাঠি। সে খুব খুশি হয়ে সেটা হাতে নিল, ভাবলো পথ চলতে এটা তার অনেক কাজে লাগবে। মৃতপ্রায় সাপকে হাতে নিয়ে সে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করলো।

অন্য বন্ধু খাবার নিয়ে ফিরে এসে সাপ দেখে ভয়ে চিত্কার করে উঠলো। বন্ধুকে বললো, তাড়াতাড়ি এটা হাত থেকে ফেলে দাও। অন্ধ বন্ধু কিছুতেই বিশ্বাস করলো না যে এটা লাঠি না; বরং সাপ।

সে ভাবলো তার কুড়িয়ে পাওয়া দামি লাঠি বন্ধু মনে হয় নিয়ে নিতে চাইছে। সে কিছুতেই বন্ধুর কথায় রাজি হলো না। তাই উপায় না দেখে দৃষ্টিমান বন্ধু আবারো অন্ধ বন্ধুকে সাথে নিয়ে পথ চলা শুরু করলো। দিনের বেলা রোদ উঠে তাপ বাড়তে লাগলো, সাপটি তার চেতনা ফিরে পেতে শুরু করলো। একটু পরে সে অন্ধ বন্ধুকে ছোবল দিল। বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অন্ধ বন্ধুটি মারা গেল।

এই গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম? শিখলাম, অন্ধরা সাপকে লাঠি মনে করে। তাদের সাবধান করে লাভ নেই। সাপের ছোবলে তাদের মৃত্যুটা যতটা সম্ভব দ্রুত এবং নির্বিঘ্ন হোক— এই কামনা করা ছাড়া আসলে কারোর কিছু করার নেই।

এক বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর এক অমর উপন্যাসে বলেছিলেন, কথার মধ্যে বিষ আছে। কথা কখনও ব্যর্থ হয় না। কথা কখনও ব্যর্থ হয় কিনা জানি না, তবে কথার মধ্যে যে বিষ আছে একথা মানতেই হবে। আমাদের দেশে সারাক্ষণই এই কথার বিষের চাষ হয়। কমবেশি সবাই প্রায় কথার বিষ উত্পাদনের চেষ্টায় সারাক্ষণ ব্যস্ত। কথার হুলে বিদ্ধ করার, কথা দিয়ে একে-ওকে-তাকে ঘায়েল করার বিদ্যা কমবেশি সবার মধ্যেই দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে কথার বিষে জর্জরিত করার ক্ষমতা সম্ভবত রাজনীতিবিদদেরই বেশি। রাজনীতিবিদরা এমনিতেই উকিলদের মত বাকপটু হন এবং একটু বেশি কথা বলেন। বেশি কথা বলার কারণেই কিনা বিষাক্ত কথাও বেশি বলেন। এসব কথা শুনলে অনেক সময় মন খারাপ হয়ে যায়। সমস্ত শরীরটাই কেমন যেন বিষে জর্জর হয়ে যায়, মনটা বিষিয়ে উঠে। কেন বাবা, ভালো কাজ করার ক্ষমতা বা মুরদ বা ক্ষমতা তো আপনাদের নেই-ই, ভালো কথাটুকু পর্যন্ত বলতে পারেন না? আপনাদের কথা, কাজ, আচরণ—সবই যদি বিষাক্ত, বিরক্তিকর ও ক্ষতিকর হয়, তাহলে এর পরিণতি কী হবে তা একবারও ভেবে দেখেছেন? আপনারা যদি নিজেদের না পাল্টান, কথা-আচরণ-স্বভাব না বদলান, তাহলে ভবিষ্যতে কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হতে পারেন। সাধারণ মানুষ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে আপনাদের পেছনে লিখে দিতে পারে (যেমন ট্রাকের পেছনে লিখা থাকে), সাবধান, রাজনীতিবিদ! ১শ' গজ দূরে থাকুন!

পুনশ্চ: আমার এক বন্ধু রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করতে অনুরোধ করেছেন। তাদের নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে অনেক অপ্রীতিকর তথ্য বের হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে বন্ধুবর আমাকে শুনিয়েছেন সেই পুরানো কৌতুকটি।

ছাত্র শিক্ষককে বলছেন, স্যার, আপনি সত্যিই, খুব চমত্কার পড়ান। এত ভালো পড়াতে আমি আর কাউকে দেখিনি। আব্বা সেদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্যার কি পাস। আমি অনুমানেই বলে দিলাম, এমএ।

শিক্ষক: তা এক রকম এমএ-ও বলতে পার। আমি এমএ ক্লাসের ছাত্রদের অনায়াসে পড়াতে পারি। পড়িয়েছিও।

ছাত্র: আপনি তাহলে এমএ পাস করেননি? বিএ পাস বুঝি?

শিক্ষক: তা বিএ পাস করা এমন কি কঠিন ব্যাপার? সুযোগ পেলে আমি কি আর করতাম না? কলেজের প্রিন্সিপাল ব্যাটা অমন ব্যবহার না করলে কবে গ্রাজুয়েট হয়ে যেতাম। 

ছাত্র: সে কি বলছেন স্যার, আপনি মাত্র আইএ পাস?

শিক্ষক: তা আর হলো কই, ম্যাট্রিক পাস করিনি বলে আইএতে ভর্তিই নিল না! কলেজের যত্তসব অরাজক নীতি!

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.