১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম কয়েকটি দিন বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্পূর্ন। এর মধ্যে ৭ নভেম্বর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এই দিনেই সিপাহী জনতার দুর্বার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করা হয় যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সিপাহী এবং সর্বস্তরের জনসাধরনের সচেতনতা আর দেশপ্রেম এই দিনে দেশকে একটা ভয়াবহ অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করে। ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী চার দিনের অনাকাঙ্খিত নানা ঘটনার অবসান ঘটিয়ে ৭ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মত মানুষ মুক্তির আনন্দে মেতে ওঠে। ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লবের ৩৪ বছর পরও জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ এবং তাহেরের তখনকার ভুমিকা নিয়ে এখনও আলোচনায় সরগরম প্রতিটি অঙ্গন। প্রকৃতপক্ষে খালেদ মোশাররফ কর্তৃক অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্র থেকেই দেশে তখন একটা অচলাবস্থা এবং সাময়িক আনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে জিয়ার জনপ্রিয়তার উপর ভর করে জিয়াকে ফাদে ফেলে তাহেরেরও ক্ষমতায় আরোহন করার অভিন্ন উদ্দেস্য ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সীমাহীন দেশপ্রেম এবং সাধারন সৈনিক ও জনগনের নিকট আকাশ ছোয়া জনপ্রিয়তার কাছে পরাজিত হতে হয় খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল তাহেরকে। তথাপি কেউ কেউ প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে খালেদ মোশাররফকে, আবার গুটিকয়েক লোক তাহেরকে নায়ক সাজাতে বদ্ধ পরিকর।
নভেম্বরের ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত সংগঠিত খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ ক্যু, জেনারেল জিয়াকে বন্দী করা ও সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়ার মুক্তি এবং পরবর্তী দুই তিনদিন সাধারন মানুষের দৃষ্টির বাইরে ক্যন্টনমেন্টের অভ্যন্তরের নানা ঘটনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও বেশ কৌতুহল লক্ষ্য করা যায়। মূলত কয়েকজন লেখকের মিথ্যা এবং বানোয়াট ইতিহাস রচনা এবং কতিপয় লোকের লাগামহীন মিথ্যা প্রচারনার ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে এখনো প্রকৃত ঘটনাগুলো অনেকটা অস্পষ্ট। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই লেখায় ঐ সময়কার ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন মানুষের লিখিত বই থেকে উল্লেখ্যযোগ্য অংশ সরাসরি কোট করা হয়েছে। তার সাথে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হালের সত্যনিষ্ঠ একাধিক কলাম লেখকের লেখার অংশ বিশেষও এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯৭৫ সালের ৭, ৮ ও ৯ নভেম্বর প্রকাশিত তখনকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেরও গুরুত্বপূর্ন অংশ এই লেখায় সংযোজন করা হয়েছে যা প্রকৃত সত্য ঘটনা আচ করতে অনেকটাই সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।
নভেম্বরের সেই দিনগুলোতে সংঘঠিত ঘটনাবলীর একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ঢাকার তখনকার স্টেশন কমান্ডার লে: ক: আব্দুল হামিদ। সংগত কারনেই একজন নিরপেক্ষ লোক হিসেবে তার লেখা বই 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' অনেক সত্য ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে। অন্যদিকে ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন লে: ক: শরিফুল হক ডালিম। সে হিসেবে তার লেখা 'যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি' বইটিই যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য। এছাড়াও সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার লিখিত বইও মোটামুটি সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হওয়ায় প্রকৃত ঘটনা উদ্ধারে এ বই দুটি থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য আংযোজন করা হয়েছে। এই লেখায় প্রধানত ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট, নভেম্বরের ৩ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অপচেষ্টা এবং মৃত্য, ৭ নভেম্বর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কয়েক দিনে কর্নেল তাহেরের ভুমিকা এবং জিয়াউর রহমানের অবস্থান ও ভুমিকা প্রসঙ্গে বিভিন্ন লেখকের বই এবং পত্রিকায় লিখিত কলাম থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা হয়েছে। আশা করি পাঠকমহল সত্য ইতিহাস অনুধাবনে সক্ষম হবেন।
৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট
লে: ক: ডালিম ৭ নভেম্বর তথা নভেম্বর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, "ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটি প্রতি বিপ্লব ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিনত করা।" (লে: ক: শরীফুল হক ডালিম: যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি, পৃষ্ঠা ৫০৩)
বিশিষ্ট কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও প্রথম আলোয় লিখিত একটি কলামে একই ধরনের তথ্য দেন। তিনি বলেন, "পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩-৭ নভেম্বরের দিনগুলো আকাশ থেকে হঠাৎ পড়েনি। সব ঘটনারই একটি পটভূমি থাকে। ওই ঘটনাপ্রবাহেরও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭৪-এর ১৩ অক্টোবর জাসদ গণ-আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানায়। হরতাল ও গণ-আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়: ‘ভারতের আধিপত্যবাদী, রাশিয়ার সংশোধনবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্ত ও অশুভ প্রভাবের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণ বিধানের জন্য; সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় সরকার গঠন।" (সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রথম আলো, ৯/১১/১০)
সাবেক সেনাপ্রধান লে: জে: মাহবুবুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়; যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক দিন টানতে হয়েছে। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁকে সেনাপ্রধান না করে করা হলো কে এম সফিউল্লাহকে। এটা মন্দ দৃষ্টান্ত। এর ফলে সেনাবাহিনীতে কিছুটা অসন্তোষ দেখা যায়। আরেকটি বিষয় ছিল রক্ষীবাহিনী। আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধা তো সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি হতে পারে না।" (লে: জে: মাহবুবুর রহমান: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
অন্যদিকে ড: রেজোয়ান সিদ্দিকী লেখেন, "রাষ্ট্র আজ যে সঙ্কটে পড়েছে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে তেমনি এক ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিতে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল শাসন কায়েম; ভারতীয় মদদে, ভারতীয় প্রশিক্ষণে, ভারতীয় রিজার্ভ পুলিশের পোশাকে গঠিত রক্ষী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে তখন পিষ্ট হচ্ছিল এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। সেই নিপীড়ন থেকে উদ্ধারের সব পথও রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদপত্রের তথা মত প্রকাশের সব স্বাধীনতা হরণ করে নেয়া হয়েছিল। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছিল ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণের অধিকার। কেড়ে নেয়া হয়েছিল চিন্তার স্বাধীনতা। বিচার বিভাগকে নেয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের ইচ্ছার অধীন করে। গোটা দেশের মানুষ নিজ ভূমে যেন গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিল।" (ড: রেজোয়ান সিদ্দিকী: নয়া দিগন্ত, ০৬/১১/২০০৯)
খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও করুন পরিনতি
আগেই উল্লেখ করেছি খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের নিমিত্তেই মূলত নভেম্বরের নানা ঘটনার উৎপত্তি। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, লে: ক: আবদুল হামিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমিন আহমেদ চৌধুরী, লে: জে: মাহবুবুর রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুর রহমানসহ অনেকের কন্ঠেই অভিন্ন সুর পরিলক্ষিত হয়।
"২ নভেম্বর দুপুর থেকেই সেনানিবাস থেকে ট্রুপস মুভমেন্ট শুরু হল।... ৩ নভেম্বর দিনের মধ্যেই ফারুক-রশীদরা ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে একটা আপোস রফায় আসেন। ...৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে মুশতাকের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালে কর্নেল সাফায়াত জামিলের নেত্বটত্বে একদল সশসস্ত্র সৈনিক সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সবাইকে হ্যান্ডসআপ করায় এবং মুশতাককে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলে গালিগালাজ করতে থাকে। মুশতাক ও তার মণ্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে হত্যা করে ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে জেলখানা পর্যন্ত সব হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার হয়মকি দেয়। মুশতাকসহ মন্ত্রিপরিষদের সবারই তখন অত্যন্ত করুণ অবস্থা। তারা তাক করা অস্ত্রের সামনে ভীত ভেড়ার মত কাপতে থাকে। এ সময় জেনারেল খলিলুর রহমান উত্তেজিত সৈনিকদের বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খান। তবে শেষ পর্যন্ত জেনারেল ওসমানী তাদের নিবৃত্ত করেন। এ সময় খন্দকার মুশতাক উদাসভাবে জিজ্ঞএস করেন, তোমরা আমার কাছে কি চাও" জবাবে তারা জেনারেল জিয়াকে বরখাস্ত করে তার স্থলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করতে বলে। মুশতাক তাদের এই দাবি মেনে নেন।" (রাজনীতির তিনকাল: মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ১৭২-১৭৩)
"৩ নভেম্বর ভোর রাতে আরো একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে বাংলাদেশে। মোশতাক ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। ২ নভেম্বর রাতে সে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে মোশতাক বঙ্গভবনে যে বৈঠক ডাকেন তাতে হাজির ছিলেন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল, মন্ত্রিসভার সদস্য ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, জেনারেল এম এ জি ওসমানী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর। রাত ১টায় বৈঠক শেষ হয়। আড়াইটার দিকে কর্নেল রশিদ এসে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে খবর দেন যে বঙ্গভবনে কর্মরত সামরিক প্রহরীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। খুব সকালে ক্যাপ্টেন নূর এসে মোশতাককে জেনারেল খালেদ মোশাররফের পক্ষ থেকে সাত দফা শর্তের একটা তালিকা দেন। সে তালিকার মূল কথা ছিল, খালেদ মোশাররফের দাবিগুলো মেনে নেয়া হলে সেনাবাহিনী মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখবে। মোশতাক খালেদ মোশাররফের শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি আর রাষ্ট্রপতি থাকতে চান না। তার জবাব নিয়ে ক্যাপ্টেন নূর চলে গেলেন। আরো পরে মোশতাক যখন তার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশুরুল হকের কামরায় ছিলেন, তখন জেনারেল খালেদ মোশাররফ তাকে ফোন করেন। তিনি এবং বিমান বাহিনীর নবনিযুক্ত প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল তওয়াব দাবি করেন, বঙ্গভবনে অবস্খিত শেখ মুজিবের ঘাতকদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ প্রমুখ সংশ্লিষ্ট অফিসাররা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন তারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে খালেদ মোশাররফের সমর্থক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এই অচলাবস্খার অবসানের জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার মধ্যস্খতায় জেনারেল খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহী অফিসারদের বিদেশে নির্বাসনে পাঠাতে রাজি হন। সে রাতে (২ নভেম্বর ১৯৭৫) জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। ১টার দিকে বাড়ি ফিরে তারা শুয়ে পড়েন। ঘন্টাখানেক পরই দরোজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে জেনারেল জিয়া উঠে গিয়ে দরোজা খোলেন। উপস্খিত খালেদ মোশাররফের প্রতি অনুগত অফিসাররা তাকে বলেন, তাকে গৃহবন্দী করা হচ্ছে। তারা বাইরের ফটক এবং দরোজায় তালা লাগিয়ে দেন। একাধিক অফিসার জিয়াকে পাহারা দেয়ার জন্য বাড়ির ভেতরেই অবস্খান করছিলেন।" (সিরাজুর রহমান: নয়া দিগন্ত, ০৭-১১-২০১০)
"৩ নভেম্বর রাতেই খালেদ মোশাররফকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এই খালেদ মোশাররফ মুক্তিযুদ্ধকালে অসীম সাহসী বীরের ভুমিকা রেখেছিলেন। পরেরদিন ৪ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক একদল বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্বে একটি নাগরিক শোক মিছিল ধানমন্দি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসে। এ মিছিলে জেনারেল খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধা মাতাও ছিলেন। পরদিন এই মিছিলের ছবি খবরের কাগজে ছাপা হলে মুহূর্তে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। খালেদ মোশাররফের দাবি অনুযায়ী ৫ নভেম্বর খন্দকার মুশতাক বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মাদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্বভার অর্পন করেন। ৬ নভেম্বর সংসদ বাতিল করা হয়। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সাধারন সৈনিক এবং এনসিও ও জেসিও র্যা ঙ্কের অফিসাররা এবারের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়। 'সিপাহী-জনতা ভাই ভাই' এই শ্লোগান দিয়ে ৬ নভেম্বর রাতেই এরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। জিয়া তখন সেনানিবাসে গৃবন্দি। এরা জিয়াকে মুক্ত করে। এক পর্যায়ে বঙ্গভবন দখল করে নেয। খালেদ মোশাররফ, মেজর হূদা ও মেজর হায়দার পালাতে গিয়ে সৈনকদের গুলিতে নহত হন। এভাবেই ঘটে গেলো ক্ষমতার আরেক দফা পালাবদল। মুশতাক অপসৃত হলেন। ১৫ আগষ্টের খুনিচক্র দেশছাড়া হলো। যারা এদের দেশছাড়া করল, সেই খালেদ মোশাররফও নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। ক্ষমতায় আহীন হলেন জিয়াউর রহমান।" (রাজনীতির তিনকাল: মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ১৭১-১৭৪)
"৩ নভেম্বর কর্নেল শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে ও জেনারেল খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধানে অবৈধ মোশতাক সরকারকে উৎখাত করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হলো। প্রয়াত মেজর ইকবাল (সিলেটবাসী, পরবর্তীকালে মন্ত্রী) বঙ্গভবন থেকে তাঁর প্রথম ই-বেঙ্গল নিয়ে সরে এসে কর্নেল গাফফার বীর উত্তমের নেতৃত্বে বঙ্গভবন ঘেরাও করে মোশতাককে (তখন কেবিনেট মিটিং চলছিল) হেস্তনেস্ত করে (কথিত আছে যে কর্নেল গাফফার খন্দকার মোশতাককে থাপড় মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেন এবং শাফায়েত জামিল স্টেনগান নিয়ে তেড়ে আসেন। মাঝখানে ওসমানী দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়ন্ত্রণে এনে বঙ্গভবনকে রক্তাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেন) পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবং প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) বানানো হলো। ৫ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হলো। ইতিমধ্যে গৃহবন্দী সেনাপ্রধান (৩ নভেম্বর থেকেই গৃহবন্দী) জিয়াউর রহমান ব্রিগেডিয়ার রউফ ও কর্নেল মালেকের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র দেন। ধুরন্ধর মোশতাক পদত্যাগ করলেও ছয় মেজরসহ তাঁদের অন্য সাথিদের নিরাপত্তা বিধানের নিমিত্তে সংলাপ চালিয়ে যান ৩ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময় দেশে কোনো সরকার ছিল না। কেউই কিছু জানতে পারছিল না। সেনাসদরসহ সবাই যখন অন্ধকারে নানা ধরনের গুজবের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখনই ৫ নভেম্বর জেলহত্যার কথা সেনাসদর জানতে পারে।" (আমিন আহমেদ চৌধুরী: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
"৬ তারিখ রাত ১২ টায় সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মুশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। নুরুজ্জামান তাকে খাকি ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। সে তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেয়। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে: কামরুল ফোন ধরে। সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে যান। প্রথমে নিরাপদেই তার বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ। তিনি তাৎক্ষনিক টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মুশররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। জিয়ার সাথে জলিলের ফোনে কিছু কথা হয়। কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন, যেন খালেদকে প্রানে মারা না হয়। যাহোক, ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করল। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাদের টেনে হিচড়ে বের করে। জানা গেছে মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, 'আমরা তোমার বিচার চাই।' খালেদ শান্ত কন্ঠে জবাব, ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।' স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার বলল, 'আমরা এখানেই তোমার বিচার করব'। খালেদ ধীরস্থির, বললেন, 'ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর'। খালেদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র! একটি ব্রাশ ফায়ার! আগুনের ঝলক বেরিয়ে এল বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদ মোশররফ। সাঙ্গ হল বিচার। শেষ হল তার বর্নাঢ্য জীবনেতিহাস।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"বাংলাদেশকে ফের রুশ-ভারত অক্ষশক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক সামরিক ক্যুদেতা সংঘটিত হয়। ক্যুদেতার নায়করা সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে। তার বন্দিত্ব এবং খালেদ মোশাররফের ক্যুদেতার সংবাদ মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদ রাজধানী নগরী ঢাকার প্রতিটি মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সেদিন ঢাকা নগরীর মানুষদের বাকরুদ্ধ অবস্থার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যাদের সঙ্গেই আমার সাক্ষাত্ হয়েছে তারা সবাই গভীর উত্কণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন—এখন দেশের কী হবে? আবারও কি চালের দাম বাড়বে? আবারও কি দেশে দুর্ভিক্ষ হবে, আবারও কি দেশ ভারতীয় আধিপত্যবাদের হিংস্র নখরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে? খালেদ মোশাররফও একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৩ নভেম্বর তার উচ্চাভিলাষী এই পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষ তাকেও শ্রদ্ধা করত। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। কিন্তু তিনি তার উচ্চাভিলাষকে গোপন রাখতে পারলেন না। এই উচ্চাভিলাষই তার জন্য কাল হলো। সাহসী মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তি মুহূর্তে পরিণত হলো ভিনদেশের সেবাদাসরূপে। তার এই পরিবর্তিত ভাবমূর্তি তাকে ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেল ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে। সেই সময়কার ঘটনাবলীর সঙ্গে যাদের যোগসূত্র ছিল তাদের মুখেই শুনেছি জেনারেল জিয়া তার জীবন রক্ষার জন্য বিদ্রোহী সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষিপ্ত সৈনিকরা তার কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি বেঁচে থাকলে তার জবানবন্দিতেই জানা যেত তার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য কী ছিল। তার নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের কালের ইতিহাসের একজন সাক্ষী হারিয়ে গেলেন।" (অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ: আমার দেশ, ০৫/১১/২০১১)
ক্ষমতা দখলে কর্নেল তাহেরের কুটকৌশল
নজরকাড়া কিছু দাবী দাওয়ার অন্তরালে জিয়ার কাধে পা দিয়ে ক্ষমতা দখল করাই ছিল কর্নেল তাহেরের মুল উদ্দেশ্য। ৩ নভেম্বর থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ কর্নেল তাহেরের কার্যকলাপ স্পষ্টতই বলে দেয় তাহেরে মুল লক্ষ্য।
"জিয়াকে মুক্ত করার কিছুক্ষন পরেই তাহের টু-ফিল্ড রেজিমন্টে ছুটে আসে। তখন রাত প্রায় ২-৩০ মিনিট। ওই সময় জিয়ার কক্ষে গুটিকয় অফিসার: কর্নেল আমিনুল হক, মেজর মহীউদ্দীন, মেজর জুবায়ের সিদ্দীক, মেজর মুনীর, সুবেদার মেজর আনিস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জিয়া ও তাহের উভয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। জিয়া বললেন, তাহের তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাচিয়েছো। তাহের বলল, আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। এদিকে আসুন প্লিজ, তাহের তাকে নিয়ে কক্ষের একটি নিভৃত কোণে গেল। বহুক্ষন ধরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকল। একসময় তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। এক ফাকে জিয়া বারান্দায় এসে সুবেদার মেজর আনিসকে কানে কানে বললেন, আনিস সাহেব ওকে কোনভাবে সরিয়ে দিন এখান থেকে। সাবধান বহু পলিটিক্স আছে। তাহের জিয়াকে টু-ফিল্ড থেকে বের হয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইছিল। জিয়া যেতে রাজি হন নি সংগত কারনেই। সাধারন সৈনিকদের ধারনা ছিল জিয়াকে মুক্ত করার পরপরই সিপাহী-বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে। তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে,কিন্তু বাইরের বিপ্লবী সৈনিক ও বিপ্লবী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল ভিন্ন, অনেক গভীর। সমস্ত প্লান-প্রোগ্রামই ছিল সাধারন সৈনিকদের এবং বিপ্লবী তাহের গ্রুপের। শত শত সৈনিকদের পদভারে টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারন জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নাই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সদস্যবৃন্দ। সিপাহী বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারন জোয়ানদের সাথে। উপস্থিত শত শত সৈনিকদের মধ্যে কে বিপ্লবী সৈনিক, কে আসল সৈনিক বুঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তারাই অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল। টু-ফিল্ডে বসেই জিয়া বেতার ভাষন দিলেন। টু-ফিল্ডের অফিসেই রেডিও রেকর্ডিং ইউনিট এনে জিয়ার একটি ভাষন রেকর্ড করা হল ভোর বেলা প্রচার করার জন্য। সংক্ষিপ্ত ভাষনে জিয়া ঘোষনা করেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে এই মুহূর্তে শান্ত থেকে নিজ নিজ দ্বায়িত্ব পালন করার আহবান জানান। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস-আদালত, বিমানবন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করার অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সহায়। (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"জাসদের উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিষঠা, যদিও কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিলো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। তাহের সৈনিকদের ১২ দফা দাবী প্রনয়ন করে। এগুলোর মধ্যে ছুলো: ব্যাটম্যান প্রথার বিলুপ্তি, অফিসার ও সৈনিকদের মধ্য এ ব্যবধান দূর, সৈনকদের মষহ্য থেকে অিসার নিয়োগ, সৈনিকদের বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ব্যবস্থাকরন, দুর্নীতিবাজ অফিসারদের অপসারন, রাজবন্দীদের নুক্তি। বিপ্লবি সৈনিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো বিপ্লবের মাধ্যমে ১২ দফা বাস্তবায়ন। তাহেরের মতে, জিয়ার সাথে আগেই এসব বনিয়ে সমঝোতা হয়েছিলো। তাহের ভেবেছিলো সে-ই অধিক বুদ্ধিমান, জিয়াকে ব্যবহার করে সে ক্ষমতায় আরোহন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার সেই ক্যালকুলেশন ভুল হয়েছিলো।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ, পৃষ্ঠা: ১২৬)
"৭ তারিখ বিকেল আনুমানিক ৪টার দিকে আবার টু-ফিল্ডে গেলাম জিয়ার কাছে। বারান্দায় উঠতেই দেখি একটি কক্ষে বসে আছে কর্নেল তাহের। মুখ তার কালো, গম্ভীর, ভারী। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার তাহের? তুমি এতো গম্ভীর কেন? বললো, স্যার আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না। মন খারাপ হবে না? আমি তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। কর্নেল আমিন মুচকি হেসে আমাকে বারান্দায় টেনে নিয়ে গেল। বললো, বুঝলেন না স্যার! ব্যাপারটা তো সব তাহেরের লোকজন ঘটিয়েছে, এখন জিয়াকে মুঠোয় নিয়ে বারগেন করছে। এখন তো সে জিয়া মেরে ফেলতে চায়। এতক্ষনে বুঝলাম 'ডালমে কুছ কালা হ্যায়।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে, এটা ঠিক। তাঁরা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাহেরের অনুসারীরা প্রচলিত সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী ধারায় একটি বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন।"(কে এম শফিউল্লাহ: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
"অনেকেই মনে করেন, খালেদ-শাফায়েত গোড়ায় গলদ করে বসেছিলেন।সেনাদের ভেতর জিয়ার ইমেজ ঈর্ষণীয় পর্যায়ে ছিল। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়ার ভারী গলায় ঘোষণা সেনাসহ সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, ফলে তাঁর একটা আলাদা ইমেজ ছিল। কর্নেল আবু তাহের এই সুযোগ আগ বাড়িয়ে গ্রহণ করেন। তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। কর্নেল তাহের রুশ বিপ্লবের তারিখকে স্মরণ করে তাঁর বিপ্লবের তারিখ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন ৬-৭ নভেম্বর রাত ১২টায়। এর মধ্যে নভেম্বরের অভ্যুত্থান তাঁকে সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। তাহের তার আগ থেকে ওসমানী, জিয়া ও খালেদের মধ্যে জিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর বিপ্লবের নায়ক হিসেবে। জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করতে হবে—এই দাবি সামনে নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্টে সেনা ও সিভিল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের একত্র করেন তিনি। সঙ্গে রাখেন সৈনিকদের ১২ দফা দাবি। রাত ১২টায় প্রথম গোলাগুলি শুরু হয়।" (আমিন আহমেদ চৌধুরী: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
অফিসার নিধনের মুল ভুমিকা ছিল কর্নেল তাহের বাহিনীর
মুলত তাহেরের বিপ্লবী বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের প্রচারনার ফলে সিপাহীদের মাঝে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কয়েকজন লেখকের কথায় পরিষ্কার বুঝা যায় তাহের বাহিনী পুরো সেনানিবাসে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে অফিসার নিধনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়।
"সন্ধা নামার সাথে সাথে এক অজানা আতঙ্ক সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। টু-ফিল্ডের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের সৈনিকরা এখানে ওখানে জটলা করছিল। আশে পাশে সৈনিকরা অস্ত্র কাধে ঘোরাফেরা করছে। রাস্তায় দেখি বেশ কিছু অফিসার গাড়ি করে, রিক্সা করে ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাস্তা ঘাট সন্ধ্যার আগেই একেবারে ফাকা হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে ঐ মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্টে কমান্ড কন্ট্রোল আর ডিসিপ্লিন বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবীদের প্রপাগান্ডা, হাজার হাজার বিপ্লবী লিফলেটস্ ইত্যাদির প্রভাবে ইতোমধ্যে সাধারন সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লক্ষ্য করলাম। তারা অফিসারদের প্রতি অবজ্ঞাভরে তাকাচ্ছিল। ৪র্থ বেঙ্গল এবং টু-ফিল্ড রেজিমন্টের কিছু বিশ্বস্ত অফিসার জেসিও এবং সৈনিক জেনারেল জিয়াকে আগলে রেখেছিল। কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল রাস্তায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে পৌছে মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দিতে চাপ প্রয়োগ করল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, মেজর মুনীর ও সৈনিকেরা অফিসারদের তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করল। আফিসারদ্বয় বেচে গেলেন। রাত আনুমানিক ১২টা। হঠাৎ গেটে তুমুল চিৎকার হট্টগোল। তারা নিচতলায় কর্নেল শামসের বাসায় আক্রমন করে বসল। শামসরা সবাই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারা উপর তলায় উঠে আসল। তারা একেবারে আমার বেডরুমের দরজায় পৌছে হাকা-হাকি করে দরজা খুলতে বলল। আমার স্ত্রী আমাকে থামিয়ে বলল দাড়াও আমিই যাব, বলেই সে একেবারে আক্রমনকারীদের সম্মুখে এসে দাড়ালো। লেডিজ দেখে বিপ্লবীরা প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। রক্তপাগল সৈনিকরা আমার স্ত্রীকে গুলি করতে পারে ভেবে আমি নিজেই তাড়াতাড়ি দরজার পিছন থেকে বেরিয়া এলাম। একজন সিপাহী গুলি করার জন্য রাইফেল তুলতেই সমুজ আলী ও অনুগত সিপাহীরা তাকে জাপটে ধরল। ঐ বেটাই ছিল লিডার। মনে হল তারা ভিন গ্রহের বিপ্লবী সিপাহী। বাকি দু-তিন জনকে সামসের সিগন্যাল ইউনিটের মনে হল। যাহোক আমরা কোনরকম এযাত্রায় বেচে গেলাম।(তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দুল হামিদ)
৭/৮ নভেম্বর ঐ বিভীষিকাময় রাত্রে গভীর অন্ধকারে উম্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। সৈনিকরা মেজর করিম, মেজর আজিম, মিসেস মুজিব ও মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। টিভি ভবনে তিনজন অফিসার মারা পড়ে। উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা দলবেধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত অফিসাররা প্রাণ রক্ষার্থে বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপ-জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারারাত কাটায়। ১২ জন অফিসার মারা পড়ে ঐ রাতে। ঐ রাতে বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যি অফিসারদের রক্ত নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিল। ভাগ্যিস অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। সিপাহীগণ কতৃক আপণ অফিসারদের উপর হামলা এর আগে কস্মিনকালেও ঘটেনি! এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা।(তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দিল)
খালেদ মোশাররফের বিশ্বাসঘাতকতা
১৫ আগস্টের পর থেকেই খালেদ মোশাররফ ক্ষমআ দখলের উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। যে কোন উপায়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করাই ছিল খালেদের অদ্বতীয় উদ্দেশ্য। তিনি নানাভবে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই বাংলাদেশের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের সূচনাকারী।
"কিছুদিন পর একদিন জেনারেল জিয়া জানালেন, তার কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে কিছু বাকশালপন্থি অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খালেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ভীষন উচ্চাভিলাষী। তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য অতি কৌশলে যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি তার শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা করে আসছিলেন। মুজিব সরকার এবং বাকশালীদের সহানুভূতিও ছিল তার প্রতি। আচমকা বাকশাল সরকারের পতনের ফলে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাই তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে কোন উপায়েই তার পরিকল্পনা কার্যকরি করে তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে। তার এই হীন চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ থেকে তাকে কিছুতেই নিরস্ত্র করতে পারছিলেন না জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আগস্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় দেশকে নিয়ে আযাবার এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটানো হল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপর্টেও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে লাগল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রধান উস্কানিদাতা ছিল কর্নেল শাফায়াত। ব্রিগেডিয়ার খালেদের মোশাররফ এবং কর্নেল সাফায়াত জামিলের ঐদ্ধত্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। জেনারেল জিয়ার প্রায় সব নির্দেশই উপেক্ষা করে চলেছেন তারা। প্রতি রাতেই মধ্যস্থতার জন্য ছুটে যেতে হচ্ছে তাদের বিরোধের মীমাংসা করার জন্য। সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীন অবস্থাকে ভীষণভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন তারা। ক্রমান্বয়ে আর্মির chain of command-কে অকেজো করে তুলেছে CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং ঢাকা Brigade Commander কর্নেল শাফায়াত জামিল। জেনারেল জিয়া তাদের হাতে প্রায় জিম্মি হয়ে পড়লেন। চিফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে তার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও বাধা সৃষ্টি করতে লাগলেন। " (যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি: লে কর্নেল (অব) ডালিম, পৃষ্ঠা: ৫০১, ৫০৮, ৫১০)
নভেম্বরের ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত সংগঠিত খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ ক্যু, জেনারেল জিয়াকে বন্দী করা ও সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়ার মুক্তি এবং পরবর্তী দুই তিনদিন সাধারন মানুষের দৃষ্টির বাইরে ক্যন্টনমেন্টের অভ্যন্তরের নানা ঘটনা নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও বেশ কৌতুহল লক্ষ্য করা যায়। মূলত কয়েকজন লেখকের মিথ্যা এবং বানোয়াট ইতিহাস রচনা এবং কতিপয় লোকের লাগামহীন মিথ্যা প্রচারনার ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে এখনো প্রকৃত ঘটনাগুলো অনেকটা অস্পষ্ট। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এই লেখায় ঐ সময়কার ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন মানুষের লিখিত বই থেকে উল্লেখ্যযোগ্য অংশ সরাসরি কোট করা হয়েছে। তার সাথে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হালের সত্যনিষ্ঠ একাধিক কলাম লেখকের লেখার অংশ বিশেষও এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯৭৫ সালের ৭, ৮ ও ৯ নভেম্বর প্রকাশিত তখনকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেরও গুরুত্বপূর্ন অংশ এই লেখায় সংযোজন করা হয়েছে যা প্রকৃত সত্য ঘটনা আচ করতে অনেকটাই সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।
নভেম্বরের সেই দিনগুলোতে সংঘঠিত ঘটনাবলীর একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ঢাকার তখনকার স্টেশন কমান্ডার লে: ক: আব্দুল হামিদ। সংগত কারনেই একজন নিরপেক্ষ লোক হিসেবে তার লেখা বই 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' অনেক সত্য ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে। অন্যদিকে ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিলেন লে: ক: শরিফুল হক ডালিম। সে হিসেবে তার লেখা 'যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি' বইটিই যথেষ্ট গ্রহনযোগ্য। এছাড়াও সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার লিখিত বইও মোটামুটি সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হওয়ায় প্রকৃত ঘটনা উদ্ধারে এ বই দুটি থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য আংযোজন করা হয়েছে। এই লেখায় প্রধানত ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট, নভেম্বরের ৩ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অপচেষ্টা এবং মৃত্য, ৭ নভেম্বর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কয়েক দিনে কর্নেল তাহেরের ভুমিকা এবং জিয়াউর রহমানের অবস্থান ও ভুমিকা প্রসঙ্গে বিভিন্ন লেখকের বই এবং পত্রিকায় লিখিত কলাম থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করা হয়েছে। আশা করি পাঠকমহল সত্য ইতিহাস অনুধাবনে সক্ষম হবেন।
৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপট
লে: ক: ডালিম ৭ নভেম্বর তথা নভেম্বর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বর্ননা করতে গিয়ে বলেন, "ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটি প্রতি বিপ্লব ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিনত করা।" (লে: ক: শরীফুল হক ডালিম: যা দেখেছি, যা বুঝেছি ও যা করেছি, পৃষ্ঠা ৫০৩)
বিশিষ্ট কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও প্রথম আলোয় লিখিত একটি কলামে একই ধরনের তথ্য দেন। তিনি বলেন, "পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩-৭ নভেম্বরের দিনগুলো আকাশ থেকে হঠাৎ পড়েনি। সব ঘটনারই একটি পটভূমি থাকে। ওই ঘটনাপ্রবাহেরও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭৪-এর ১৩ অক্টোবর জাসদ গণ-আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানায়। হরতাল ও গণ-আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়: ‘ভারতের আধিপত্যবাদী, রাশিয়ার সংশোধনবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্ত ও অশুভ প্রভাবের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণ বিধানের জন্য; সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় সরকার গঠন।" (সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রথম আলো, ৯/১১/১০)
সাবেক সেনাপ্রধান লে: জে: মাহবুবুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তৎকালীন সরকার কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়; যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক দিন টানতে হয়েছে। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁকে সেনাপ্রধান না করে করা হলো কে এম সফিউল্লাহকে। এটা মন্দ দৃষ্টান্ত। এর ফলে সেনাবাহিনীতে কিছুটা অসন্তোষ দেখা যায়। আরেকটি বিষয় ছিল রক্ষীবাহিনী। আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সুযোগ-সুবিধা তো সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি হতে পারে না।" (লে: জে: মাহবুবুর রহমান: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
অন্যদিকে ড: রেজোয়ান সিদ্দিকী লেখেন, "রাষ্ট্র আজ যে সঙ্কটে পড়েছে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে তেমনি এক ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিতে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন। শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল শাসন কায়েম; ভারতীয় মদদে, ভারতীয় প্রশিক্ষণে, ভারতীয় রিজার্ভ পুলিশের পোশাকে গঠিত রক্ষী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনে তখন পিষ্ট হচ্ছিল এ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। সেই নিপীড়ন থেকে উদ্ধারের সব পথও রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদপত্রের তথা মত প্রকাশের সব স্বাধীনতা হরণ করে নেয়া হয়েছিল। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছিল ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণের অধিকার। কেড়ে নেয়া হয়েছিল চিন্তার স্বাধীনতা। বিচার বিভাগকে নেয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের ইচ্ছার অধীন করে। গোটা দেশের মানুষ নিজ ভূমে যেন গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিল।" (ড: রেজোয়ান সিদ্দিকী: নয়া দিগন্ত, ০৬/১১/২০০৯)
খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও করুন পরিনতি
আগেই উল্লেখ করেছি খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের নিমিত্তেই মূলত নভেম্বরের নানা ঘটনার উৎপত্তি। সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, লে: ক: আবদুল হামিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আমিন আহমেদ চৌধুরী, লে: জে: মাহবুবুর রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুর রহমানসহ অনেকের কন্ঠেই অভিন্ন সুর পরিলক্ষিত হয়।
"২ নভেম্বর দুপুর থেকেই সেনানিবাস থেকে ট্রুপস মুভমেন্ট শুরু হল।... ৩ নভেম্বর দিনের মধ্যেই ফারুক-রশীদরা ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে একটা আপোস রফায় আসেন। ...৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে মুশতাকের সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালে কর্নেল সাফায়াত জামিলের নেত্বটত্বে একদল সশসস্ত্র সৈনিক সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সবাইকে হ্যান্ডসআপ করায় এবং মুশতাককে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলে গালিগালাজ করতে থাকে। মুশতাক ও তার মণ্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে হত্যা করে ৩২ নম্বর থেকে শুরু করে জেলখানা পর্যন্ত সব হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার হয়মকি দেয়। মুশতাকসহ মন্ত্রিপরিষদের সবারই তখন অত্যন্ত করুণ অবস্থা। তারা তাক করা অস্ত্রের সামনে ভীত ভেড়ার মত কাপতে থাকে। এ সময় জেনারেল খলিলুর রহমান উত্তেজিত সৈনিকদের বোঝানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খান। তবে শেষ পর্যন্ত জেনারেল ওসমানী তাদের নিবৃত্ত করেন। এ সময় খন্দকার মুশতাক উদাসভাবে জিজ্ঞএস করেন, তোমরা আমার কাছে কি চাও" জবাবে তারা জেনারেল জিয়াকে বরখাস্ত করে তার স্থলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করতে বলে। মুশতাক তাদের এই দাবি মেনে নেন।" (রাজনীতির তিনকাল: মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ১৭২-১৭৩)
"৩ নভেম্বর ভোর রাতে আরো একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে বাংলাদেশে। মোশতাক ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। ২ নভেম্বর রাতে সে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে মোশতাক বঙ্গভবনে যে বৈঠক ডাকেন তাতে হাজির ছিলেন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল, মন্ত্রিসভার সদস্য ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, জেনারেল এম এ জি ওসমানী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর। রাত ১টায় বৈঠক শেষ হয়। আড়াইটার দিকে কর্নেল রশিদ এসে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে খবর দেন যে বঙ্গভবনে কর্মরত সামরিক প্রহরীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। খুব সকালে ক্যাপ্টেন নূর এসে মোশতাককে জেনারেল খালেদ মোশাররফের পক্ষ থেকে সাত দফা শর্তের একটা তালিকা দেন। সে তালিকার মূল কথা ছিল, খালেদ মোশাররফের দাবিগুলো মেনে নেয়া হলে সেনাবাহিনী মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখবে। মোশতাক খালেদ মোশাররফের শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি আর রাষ্ট্রপতি থাকতে চান না। তার জবাব নিয়ে ক্যাপ্টেন নূর চলে গেলেন। আরো পরে মোশতাক যখন তার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশুরুল হকের কামরায় ছিলেন, তখন জেনারেল খালেদ মোশাররফ তাকে ফোন করেন। তিনি এবং বিমান বাহিনীর নবনিযুক্ত প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল তওয়াব দাবি করেন, বঙ্গভবনে অবস্খিত শেখ মুজিবের ঘাতকদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ প্রমুখ সংশ্লিষ্ট অফিসাররা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন তারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে খালেদ মোশাররফের সমর্থক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এই অচলাবস্খার অবসানের জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার মধ্যস্খতায় জেনারেল খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহী অফিসারদের বিদেশে নির্বাসনে পাঠাতে রাজি হন। সে রাতে (২ নভেম্বর ১৯৭৫) জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। ১টার দিকে বাড়ি ফিরে তারা শুয়ে পড়েন। ঘন্টাখানেক পরই দরোজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে জেনারেল জিয়া উঠে গিয়ে দরোজা খোলেন। উপস্খিত খালেদ মোশাররফের প্রতি অনুগত অফিসাররা তাকে বলেন, তাকে গৃহবন্দী করা হচ্ছে। তারা বাইরের ফটক এবং দরোজায় তালা লাগিয়ে দেন। একাধিক অফিসার জিয়াকে পাহারা দেয়ার জন্য বাড়ির ভেতরেই অবস্খান করছিলেন।" (সিরাজুর রহমান: নয়া দিগন্ত, ০৭-১১-২০১০)
"৩ নভেম্বর রাতেই খালেদ মোশাররফকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এই খালেদ মোশাররফ মুক্তিযুদ্ধকালে অসীম সাহসী বীরের ভুমিকা রেখেছিলেন। পরেরদিন ৪ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক একদল বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্বে একটি নাগরিক শোক মিছিল ধানমন্দি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসে। এ মিছিলে জেনারেল খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধা মাতাও ছিলেন। পরদিন এই মিছিলের ছবি খবরের কাগজে ছাপা হলে মুহূর্তে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। খালেদ মোশাররফের দাবি অনুযায়ী ৫ নভেম্বর খন্দকার মুশতাক বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মাদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্বভার অর্পন করেন। ৬ নভেম্বর সংসদ বাতিল করা হয়। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সাধারন সৈনিক এবং এনসিও ও জেসিও র্যা ঙ্কের অফিসাররা এবারের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়। 'সিপাহী-জনতা ভাই ভাই' এই শ্লোগান দিয়ে ৬ নভেম্বর রাতেই এরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। জিয়া তখন সেনানিবাসে গৃবন্দি। এরা জিয়াকে মুক্ত করে। এক পর্যায়ে বঙ্গভবন দখল করে নেয। খালেদ মোশাররফ, মেজর হূদা ও মেজর হায়দার পালাতে গিয়ে সৈনকদের গুলিতে নহত হন। এভাবেই ঘটে গেলো ক্ষমতার আরেক দফা পালাবদল। মুশতাক অপসৃত হলেন। ১৫ আগষ্টের খুনিচক্র দেশছাড়া হলো। যারা এদের দেশছাড়া করল, সেই খালেদ মোশাররফও নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। ক্ষমতায় আহীন হলেন জিয়াউর রহমান।" (রাজনীতির তিনকাল: মিজানুর রহমান চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ১৭১-১৭৪)
"৩ নভেম্বর কর্নেল শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে ও জেনারেল খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধানে অবৈধ মোশতাক সরকারকে উৎখাত করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হলো। প্রয়াত মেজর ইকবাল (সিলেটবাসী, পরবর্তীকালে মন্ত্রী) বঙ্গভবন থেকে তাঁর প্রথম ই-বেঙ্গল নিয়ে সরে এসে কর্নেল গাফফার বীর উত্তমের নেতৃত্বে বঙ্গভবন ঘেরাও করে মোশতাককে (তখন কেবিনেট মিটিং চলছিল) হেস্তনেস্ত করে (কথিত আছে যে কর্নেল গাফফার খন্দকার মোশতাককে থাপড় মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেন এবং শাফায়েত জামিল স্টেনগান নিয়ে তেড়ে আসেন। মাঝখানে ওসমানী দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়ন্ত্রণে এনে বঙ্গভবনকে রক্তাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেন) পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবং প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) বানানো হলো। ৫ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করা হলো। ইতিমধ্যে গৃহবন্দী সেনাপ্রধান (৩ নভেম্বর থেকেই গৃহবন্দী) জিয়াউর রহমান ব্রিগেডিয়ার রউফ ও কর্নেল মালেকের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র দেন। ধুরন্ধর মোশতাক পদত্যাগ করলেও ছয় মেজরসহ তাঁদের অন্য সাথিদের নিরাপত্তা বিধানের নিমিত্তে সংলাপ চালিয়ে যান ৩ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময় দেশে কোনো সরকার ছিল না। কেউই কিছু জানতে পারছিল না। সেনাসদরসহ সবাই যখন অন্ধকারে নানা ধরনের গুজবের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখনই ৫ নভেম্বর জেলহত্যার কথা সেনাসদর জানতে পারে।" (আমিন আহমেদ চৌধুরী: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
"৬ তারিখ রাত ১২ টায় সিপাহী বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মুশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। খালেদ প্রথমে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। নুরুজ্জামান তাকে খাকি ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরোধ করেন। সে তার নিজের একটি প্যান্ট ও বুশ শার্ট খালেদকে পরতে দেয়। ৪র্থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লে: কামরুল ফোন ধরে। সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করেন। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমন্টে আশ্রয় গ্রহন করতে যান। প্রথমে নিরাপদেই তার বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদের আগমনের সংবাদ। তিনি তাৎক্ষনিক টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মুশররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। জিয়ার সাথে জলিলের ফোনে কিছু কথা হয়। কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন, যেন খালেদকে প্রানে মারা না হয়। যাহোক, ভোরবেলা দেখতে দেখতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করল। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযোগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাদের টেনে হিচড়ে বের করে। জানা গেছে মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভিতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, 'আমরা তোমার বিচার চাই।' খালেদ শান্ত কন্ঠে জবাব, ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলো।' স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার বলল, 'আমরা এখানেই তোমার বিচার করব'। খালেদ ধীরস্থির, বললেন, 'ঠিক আছে তোমরা আমার বিচার কর'। খালেদ দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র! একটি ব্রাশ ফায়ার! আগুনের ঝলক বেরিয়ে এল বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী খালেদ মোশররফ। সাঙ্গ হল বিচার। শেষ হল তার বর্নাঢ্য জীবনেতিহাস।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"বাংলাদেশকে ফের রুশ-ভারত অক্ষশক্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক সামরিক ক্যুদেতা সংঘটিত হয়। ক্যুদেতার নায়করা সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে। তার বন্দিত্ব এবং খালেদ মোশাররফের ক্যুদেতার সংবাদ মুহূর্তে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদ রাজধানী নগরী ঢাকার প্রতিটি মানুষকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সেদিন ঢাকা নগরীর মানুষদের বাকরুদ্ধ অবস্থার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যাদের সঙ্গেই আমার সাক্ষাত্ হয়েছে তারা সবাই গভীর উত্কণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন—এখন দেশের কী হবে? আবারও কি চালের দাম বাড়বে? আবারও কি দেশে দুর্ভিক্ষ হবে, আবারও কি দেশ ভারতীয় আধিপত্যবাদের হিংস্র নখরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে? খালেদ মোশাররফও একজন বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৩ নভেম্বর তার উচ্চাভিলাষী এই পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত দেশের সাধারণ মানুষ তাকেও শ্রদ্ধা করত। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। কিন্তু তিনি তার উচ্চাভিলাষকে গোপন রাখতে পারলেন না। এই উচ্চাভিলাষই তার জন্য কাল হলো। সাহসী মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তি মুহূর্তে পরিণত হলো ভিনদেশের সেবাদাসরূপে। তার এই পরিবর্তিত ভাবমূর্তি তাকে ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে গেল ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে। সেই সময়কার ঘটনাবলীর সঙ্গে যাদের যোগসূত্র ছিল তাদের মুখেই শুনেছি জেনারেল জিয়া তার জীবন রক্ষার জন্য বিদ্রোহী সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষিপ্ত সৈনিকরা তার কথায় কর্ণপাত করেননি। তিনি বেঁচে থাকলে তার জবানবন্দিতেই জানা যেত তার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য কী ছিল। তার নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের কালের ইতিহাসের একজন সাক্ষী হারিয়ে গেলেন।" (অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ: আমার দেশ, ০৫/১১/২০১১)
ক্ষমতা দখলে কর্নেল তাহেরের কুটকৌশল
নজরকাড়া কিছু দাবী দাওয়ার অন্তরালে জিয়ার কাধে পা দিয়ে ক্ষমতা দখল করাই ছিল কর্নেল তাহেরের মুল উদ্দেশ্য। ৩ নভেম্বর থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ কর্নেল তাহেরের কার্যকলাপ স্পষ্টতই বলে দেয় তাহেরে মুল লক্ষ্য।
"জিয়াকে মুক্ত করার কিছুক্ষন পরেই তাহের টু-ফিল্ড রেজিমন্টে ছুটে আসে। তখন রাত প্রায় ২-৩০ মিনিট। ওই সময় জিয়ার কক্ষে গুটিকয় অফিসার: কর্নেল আমিনুল হক, মেজর মহীউদ্দীন, মেজর জুবায়ের সিদ্দীক, মেজর মুনীর, সুবেদার মেজর আনিস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জিয়া ও তাহের উভয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। জিয়া বললেন, তাহের তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাচিয়েছো। তাহের বলল, আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। এদিকে আসুন প্লিজ, তাহের তাকে নিয়ে কক্ষের একটি নিভৃত কোণে গেল। বহুক্ষন ধরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকল। একসময় তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। এক ফাকে জিয়া বারান্দায় এসে সুবেদার মেজর আনিসকে কানে কানে বললেন, আনিস সাহেব ওকে কোনভাবে সরিয়ে দিন এখান থেকে। সাবধান বহু পলিটিক্স আছে। তাহের জিয়াকে টু-ফিল্ড থেকে বের হয়ে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইছিল। জিয়া যেতে রাজি হন নি সংগত কারনেই। সাধারন সৈনিকদের ধারনা ছিল জিয়াকে মুক্ত করার পরপরই সিপাহী-বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে। তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে,কিন্তু বাইরের বিপ্লবী সৈনিক ও বিপ্লবী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছিল ভিন্ন, অনেক গভীর। সমস্ত প্লান-প্রোগ্রামই ছিল সাধারন সৈনিকদের এবং বিপ্লবী তাহের গ্রুপের। শত শত সৈনিকদের পদভারে টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলোমেলো খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারন জুতা। অনেকের মাথায় টুপিও নাই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সদস্যবৃন্দ। সিপাহী বিদ্রোহের রাতে খাকি উর্দি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারন জোয়ানদের সাথে। উপস্থিত শত শত সৈনিকদের মধ্যে কে বিপ্লবী সৈনিক, কে আসল সৈনিক বুঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তারাই অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল। টু-ফিল্ডে বসেই জিয়া বেতার ভাষন দিলেন। টু-ফিল্ডের অফিসেই রেডিও রেকর্ডিং ইউনিট এনে জিয়ার একটি ভাষন রেকর্ড করা হল ভোর বেলা প্রচার করার জন্য। সংক্ষিপ্ত ভাষনে জিয়া ঘোষনা করেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে এই মুহূর্তে শান্ত থেকে নিজ নিজ দ্বায়িত্ব পালন করার আহবান জানান। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস-আদালত, বিমানবন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করার অনুরোধ জানান। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সহায়। (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"জাসদের উদ্দেশ্য ছিলো রাজনৈতিক শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিষঠা, যদিও কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিলো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। তাহের সৈনিকদের ১২ দফা দাবী প্রনয়ন করে। এগুলোর মধ্যে ছুলো: ব্যাটম্যান প্রথার বিলুপ্তি, অফিসার ও সৈনিকদের মধ্য এ ব্যবধান দূর, সৈনকদের মষহ্য থেকে অিসার নিয়োগ, সৈনিকদের বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ব্যবস্থাকরন, দুর্নীতিবাজ অফিসারদের অপসারন, রাজবন্দীদের নুক্তি। বিপ্লবি সৈনিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো বিপ্লবের মাধ্যমে ১২ দফা বাস্তবায়ন। তাহেরের মতে, জিয়ার সাথে আগেই এসব বনিয়ে সমঝোতা হয়েছিলো। তাহের ভেবেছিলো সে-ই অধিক বুদ্ধিমান, জিয়াকে ব্যবহার করে সে ক্ষমতায় আরোহন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার সেই ক্যালকুলেশন ভুল হয়েছিলো।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ, পৃষ্ঠা: ১২৬)
"৭ তারিখ বিকেল আনুমানিক ৪টার দিকে আবার টু-ফিল্ডে গেলাম জিয়ার কাছে। বারান্দায় উঠতেই দেখি একটি কক্ষে বসে আছে কর্নেল তাহের। মুখ তার কালো, গম্ভীর, ভারী। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার তাহের? তুমি এতো গম্ভীর কেন? বললো, স্যার আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না। মন খারাপ হবে না? আমি তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। কর্নেল আমিন মুচকি হেসে আমাকে বারান্দায় টেনে নিয়ে গেল। বললো, বুঝলেন না স্যার! ব্যাপারটা তো সব তাহেরের লোকজন ঘটিয়েছে, এখন জিয়াকে মুঠোয় নিয়ে বারগেন করছে। এখন তো সে জিয়া মেরে ফেলতে চায়। এতক্ষনে বুঝলাম 'ডালমে কুছ কালা হ্যায়।" (তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা: লে: ক: আব্দিল হামিদ)
"৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে, এটা ঠিক। তাঁরা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে দিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাহেরের অনুসারীরা প্রচলিত সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী ধারায় একটি বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন।"(কে এম শফিউল্লাহ: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
"অনেকেই মনে করেন, খালেদ-শাফায়েত গোড়ায় গলদ করে বসেছিলেন।সেনাদের ভেতর জিয়ার ইমেজ ঈর্ষণীয় পর্যায়ে ছিল। কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জিয়ার ভারী গলায় ঘোষণা সেনাসহ সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, ফলে তাঁর একটা আলাদা ইমেজ ছিল। কর্নেল আবু তাহের এই সুযোগ আগ বাড়িয়ে গ্রহণ করেন। তাহেরের সঙ্গে জিয়ার যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। কর্নেল তাহের রুশ বিপ্লবের তারিখকে স্মরণ করে তাঁর বিপ্লবের তারিখ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন ৬-৭ নভেম্বর রাত ১২টায়। এর মধ্যে নভেম্বরের অভ্যুত্থান তাঁকে সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। তাহের তার আগ থেকে ওসমানী, জিয়া ও খালেদের মধ্যে জিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর বিপ্লবের নায়ক হিসেবে। জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করতে হবে—এই দাবি সামনে নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্টে সেনা ও সিভিল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের একত্র করেন তিনি। সঙ্গে রাখেন সৈনিকদের ১২ দফা দাবি। রাত ১২টায় প্রথম গোলাগুলি শুরু হয়।" (আমিন আহমেদ চৌধুরী: প্রথম আলো, ০৭/১১/২০১০)
অফিসার নিধনের মুল ভুমিকা ছিল কর্নেল তাহের বাহিনীর
মুলত তাহেরের বিপ্লবী বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের প্রচারনার ফলে সিপাহীদের মাঝে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কয়েকজন লেখকের কথায় পরিষ্কার বুঝা যায় তাহের বাহিনী পুরো সেনানিবাসে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করে অফিসার নিধনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়।
"সন্ধা নামার সাথে সাথে এক অজানা আতঙ্ক সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। টু-ফিল্ডের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের সৈনিকরা এখানে ওখানে জটলা করছিল। আশে পাশে সৈনিকরা অস্ত্র কাধে ঘোরাফেরা করছে। রাস্তায় দেখি বেশ কিছু অফিসার গাড়ি করে, রিক্সা করে ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাস্তা ঘাট সন্ধ্যার আগেই একেবারে ফাকা হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে ঐ মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্টে কমান্ড কন্ট্রোল আর ডিসিপ্লিন বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবীদের প্রপাগান্ডা, হাজার হাজার বিপ্লবী লিফলেটস্ ইত্যাদির প্রভাবে ইতোমধ্যে সাধারন সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লক্ষ্য করলাম। তারা অফিসারদের প্রতি অবজ্ঞাভরে তাকাচ্ছিল। ৪র্থ বেঙ্গল এবং টু-ফিল্ড রেজিমন্টের কিছু বিশ্বস্ত অফিসার জেসিও এবং সৈনিক জেনারেল জিয়াকে আগলে রেখেছিল। কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্কের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল রাস্তায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে পৌছে মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দিতে চাপ প্রয়োগ করল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, মেজর মুনীর ও সৈনিকেরা অফিসারদের তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করল। আফিসারদ্বয় বেচে গেলেন। রাত আনুমানিক ১২টা। হঠাৎ গেটে তুমুল চিৎকার হট্টগোল। তারা নিচতলায় কর্নেল শামসের বাসায় আক্রমন করে বসল। শামসরা সবাই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারা উপর তলায় উঠে আসল। তারা একেবারে আমার বেডরুমের দরজায় পৌছে হাকা-হাকি করে দরজা খুলতে বলল। আমার স্ত্রী আমাকে থামিয়ে বলল দাড়াও আমিই যাব, বলেই সে একেবারে আক্রমনকারীদের সম্মুখে এসে দাড়ালো। লেডিজ দেখে বিপ্লবীরা প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। রক্তপাগল সৈনিকরা আমার স্ত্রীকে গুলি করতে পারে ভেবে আমি নিজেই তাড়াতাড়ি দরজার পিছন থেকে বেরিয়া এলাম। একজন সিপাহী গুলি করার জন্য রাইফেল তুলতেই সমুজ আলী ও অনুগত সিপাহীরা তাকে জাপটে ধরল। ঐ বেটাই ছিল লিডার। মনে হল তারা ভিন গ্রহের বিপ্লবী সিপাহী। বাকি দু-তিন জনকে সামসের সিগন্যাল ইউনিটের মনে হল। যাহোক আমরা কোনরকম এযাত্রায় বেচে গেলাম।(তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দুল হামিদ)
৭/৮ নভেম্বর ঐ বিভীষিকাময় রাত্রে গভীর অন্ধকারে উম্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। সৈনিকরা মেজর করিম, মেজর আজিম, মিসেস মুজিব ও মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রান নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। টিভি ভবনে তিনজন অফিসার মারা পড়ে। উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকরা দলবেধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত অফিসাররা প্রাণ রক্ষার্থে বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপ-জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারারাত কাটায়। ১২ জন অফিসার মারা পড়ে ঐ রাতে। ঐ রাতে বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যি অফিসারদের রক্ত নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিল। ভাগ্যিস অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। সিপাহীগণ কতৃক আপণ অফিসারদের উপর হামলা এর আগে কস্মিনকালেও ঘটেনি! এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা।(তিনটি সেনা অভ্যত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে: ক: আব্দিল)
খালেদ মোশাররফের বিশ্বাসঘাতকতা
১৫ আগস্টের পর থেকেই খালেদ মোশাররফ ক্ষমআ দখলের উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। যে কোন উপায়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে উৎখাত করে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করাই ছিল খালেদের অদ্বতীয় উদ্দেশ্য। তিনি নানাভবে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই বাংলাদেশের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের সূচনাকারী।
"কিছুদিন পর একদিন জেনারেল জিয়া জানালেন, তার কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে কিছু বাকশালপন্থি অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খালেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ভীষন উচ্চাভিলাষী। তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য অতি কৌশলে যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি তার শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা করে আসছিলেন। মুজিব সরকার এবং বাকশালীদের সহানুভূতিও ছিল তার প্রতি। আচমকা বাকশাল সরকারের পতনের ফলে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাই তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে কোন উপায়েই তার পরিকল্পনা কার্যকরি করে তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে। তার এই হীন চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ থেকে তাকে কিছুতেই নিরস্ত্র করতে পারছিলেন না জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আগস্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় দেশকে নিয়ে আযাবার এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটানো হল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপর্টেও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে লাগল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রধান উস্কানিদাতা ছিল কর্নেল শাফায়াত। ব্রিগেডিয়ার খালেদের মোশাররফ এবং কর্নেল সাফায়াত জামিলের ঐদ্ধত্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। জেনারেল জিয়ার প্রায় সব নির্দেশই উপেক্ষা করে চলেছেন তারা। প্রতি রাতেই মধ্যস্থতার জন্য ছুটে যেতে হচ্ছে তাদের বিরোধের মীমাংসা করার জন্য। সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীন অবস্থাকে ভীষণভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন তারা। ক্রমান্বয়ে আর্মির chain of command-কে অকেজো করে তুলেছে CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং ঢাকা Brigade Commander কর্নেল শাফায়াত জামিল। জেনারেল জিয়া তাদের হাতে প্রায় জিম্মি হয়ে পড়লেন। চিফ অফ আর্মি স্টাফ হিসেবে তার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও বাধা সৃষ্টি করতে লাগলেন। " (যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি: লে কর্নেল (অব) ডালিম, পৃষ্ঠা: ৫০১, ৫০৮, ৫১০)
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.