Wednesday, July 24, 2013

৪৭ ও ৭১ এর স্বাধীনতা: ইতিহাস বিশ্বাস ও মীথ


১৬০০ সালের দিকে ইংল্যান্ড বা বৃটেনের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলনা। তাই তারা সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ইংরেজদের আদি ব্যবসা ছিল জলদস্যুতা। তাদের পূর্বপুরুষরা পাইরেটস হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। কালক্রমে তারা ধন ও শক্তি সংগ্রহ করে অভিজাতদের সাথে আত্মীয়তা করে। এভাবেই ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের উত্‍পত্তি হয়। ১৬০০ সালের দিকেই লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিস্ঠা হয়। সেই কোম্পানীই ভারতে ব্যবসা করতে আসে। তখন মোগল বাদশাহদের রমরমা অবস্থা। ওই  একই সময়ে ব্যবসা করার জন্যে ভারতে ফরাসী পর্তুগীজ ও  ওলন্দাজরা  আসে। এর বহু আগেই আরবরা ভারতে আসে ব্যবসা করার জন্যে। মূলত  তারা ভারতের উপকূলীয় এলাকায় ব্যবসার কেন্দ্র স্থাপন করে। বিশেষ করে সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে বহু আরব মুসলমান ব্যবসায়ী ও প্রচারকরা এদেশে আসেন। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দের মিশেল পাওয়া যায়। স্থল পথেও বাংলাদেশেমুসলমান শাসক বণিক ও ধর্ম প্রচারকরা এসেছেন। ১২০০ সালের দিকে বাংলাদেশ মুসলমান শাসনের অধীনে আসে। দিল্লীতেও মুসলমান  শাসন কায়েম হয় ১২০০ সালের দিকে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা  যড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলার শাসন দখল করে। ১৮৫৮ সালে প্রকাশ্যে ভারতীয়  সৈনিকরা  বাহাদুর শাহকে তাদের নেতা মেনে নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। এটাই ছিল ভারতীয়দের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু। এর আগে ১৭৫৭ থেকে ইংরেজদের অধীনতা অস্বীকার করে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আলেম সমাজের নেতৃত্বে বাংলার কৃষকরা বিদ্রোহ করে। ইংরেজদের দখলদারিত্ব অস্বীকার করে সারা ভারতে মুসলমান আলেম সমাজই প্রথম ১০০ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ইংরেজ দখলদারিত্বের ফলে এদেশে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের মুসলমান সমাজ। ৭১১ সাল থেকে হিসাব করলে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে  প্রায় এক হাজার বছর মুসলমান শাসন চলেছে। ১২০০ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল নাগাদ লাগাতার প্রায় ৭শ’ বছর মুসলমান চলেছে। এ দীর্ঘ সময়ই ছিল ভারতের স্বর্ণযুগ। ১৮৫৮ সালে শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর জাফরের কাছ থেকে সারা ভারতের শাসন ভার দখল করে নেয়। বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রেঙুনে নির্বাসনে পাঠায়। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ইংরেজরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত শাসন করে। এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রায় দেড়শ’ বছর হিন্দু নেতারা ইংরেজ সরকারকে সহযোগিতা করে। ইংরেজ শাসন আমলের শেষের দিকে মুসলমান নেতারা, বিশেষ করে আলিগড় আন্দোলনের নেতা স্যার সৈয়দ ইংরেজী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সাথে সাথে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু বিত্তবান উচ্চ শ্রেণীর  মুসলমান নেতা স্যার সৈয়দকে সমর্থন করেন। স্যার সৈয়দ ও অন্যান্য মুসলমান নেতাদের আহ্বানে মুসলমান তরুনরা ইংরেজী শিক্ষায় আগ্রহী হয়। হিন্দুদের ভিতর রাজা রাম মোহনকে নব জাগরনের দূত হিসাবে অভিহিত করা হয়। ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে সকল সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্যে অক্ষয় দত্ত, বিদ্যাসাগর , মধুসুদন রাম মোহনের ভাবধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। হিন্দু জাতিকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্যে এরা সকলেই পাশ্চাত্য শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন। তাদের মাথায় তখন মুসলমানদের সাথে নিয়ে চলার কোন চিন্তা ভাবনা ছিলনা। কারণ তখন মুসলমানরা একেবারেই পতিত ছিল। ১৮২৩ সালের  ১১ই  ডিসেম্বর  রাজা রাম মোহন হিন্দুদের আধুনিক শিক্ষার ব্যাপারে ভাইসরয় লর্ড আমহার্স্টকে এক চিঠি দেন। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী  ওই চিঠিকে ‘নবযুগের শংখধ্বনি’ বলে অভিহিত করেছেন। ডিরোজিও রাম মোহনের চিন্তাধারার একজন বড় শিষ্য ছিলেন। তাঁরাই সকলে মিলে হিন্দু কলেজ প্রতিস্ঠা করেন। এই সময়ে ডিরোজিওর শিষ্য ছিলেন  রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, দিক্ষিণারণঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ,ও রাধানাথ। একই ভাব ধারায় মহারাস্ট্রে কাজ শুরু করেছিলেন  মহাদেব গোবিন্দ রানাড়ে, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং বালগঙাধর তিলক। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে এর আগেই ১৮৩৮ সালে জমিদার রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে জমিদার সভা প্রতিস্ঠিত হয়। তারপর ১৮৪৩ সালে প্রতিস্ঠিত হয় বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। ১৮৫১ সালে প্রতিস্ঠিত হয় বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন। এ ধরনের আরও বহু সমিতি গঠন করে হিন্দুরা সারা ভারতে। এর ইংরেজদের সরাসরি সমর্থন ছিল। ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা সর্ব ভারতীয় সম্মেলনের আয়েজন করে। এর পরেই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিস্ঠিত হয় লর্ড হিউমের নেতৃত্বে ১৮৮৫ সালে। ফলে ভারতীয় হিন্দুরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারকে সমর্থন দিতে থাকে।
ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে হিন্দু নেতারা সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতিস্ঠার আন্দোলন বলিয়া মনে করিতেন।তাহারা ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতেই পরিচালিত করিতে চাহিয়া ছিলেন। ১৯২১ সালে ইক্যবদ্ধ খেলাফত আন্দোলনের সময় গান্ধীজী  হঠাত্‍ বলে বসলেন, ‘ আমি নিজেকে একজন সনাতনী হিন্দু বলিয়া ঘোষণা করিতেছি। কারণ, ১। বেদ উপনিষদ পুরাণ যাহা কিছু হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলিয়া পরিচিত তাহার সকল কিছুতেই আমি বিশ্বাস করি,সুতরাং অবতার আর পূণর্জন্মেও আমার দৃঢ বিশা্বাস আছে। ২। বর্ণাশ্রম ধর্মে আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ। সেই বর্ণাশ্রম ধর্ম বর্তমান কালের লৌকিক ধারণা বা স্থুল অর্থ ে নহে, তাহা এক অর্থে আমার মতে সম্পুর্ণ  বেদ ভিত্তিক ৩। গোরক্ষা সম্বন্ধেও আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ। আমি মুর্তি পুজায়ও বিশ্বাস করি। ‘সনাতনী হিন্দু, বলিতে কি বুঝায় ? গান্ধীজীর একনিস্ঠ অনুচর পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু স্বয়ং এর ব্যাখ্যা দিয়াছেন। তিনি লিখেছেন, সনাতনীরা পশ্চাত্‍গতির দৌড়ের প্রিযোগিতায় হিন্দু মহাসভাকেও বহুদূর পিছনে ফেলিয়া যায়। এই সনাতনীরা এক চরম আকারের ধর্মীয় রহস্যবাদের সহিত বৃটিশ শাসনের প্রতি একাগ্র অনুরক্তি যোজনা করিয়া থাকে। গান্ধীজী হিন্দু বলিতে আমরা বলিতেন আর মুসলমান বলিতে তাহারা বলিতেন। পন্ডিত জওহরলাল অন্তরে ছিলেন বামপন্থী  আর বাইরে ছিলেন দক্ষিণপন্থিদের নেতা। ভারতের বামপন্থী নেতারা গান্ধীজীকে বৃটিশ শাসক , জমিদার ও সামন্তবাদীদের প্রকাশ্য এজেন্ট বলে অভিহিত করেছেন। লেনিনের মতে অহিংস আন্দোলনের মূল দর্শন ছিল জনগনের সংগ্রামী চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। গান্ধীজীর স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল মালিক-শ্রমিক, জমিদার-প্রজা ও বৃটিশদের মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে দাবী আদায় করা। কংগ্রেস বহুকাল গান্ধীজীর পথ অনুসরন করে অবশেষে কঠের ভাষায় দাবী আদায়ের কথা বলতে থাকে।
ভারতের মুসলমান নেতৃবৃন্দ যখন  দেখলেন কংগ্রেসে থেকে এক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন করা যাবেনা তখনই তারা পৃথক সংগঠন বা প্ল্যাটফরম থেকে কথা বলে দাবী আদায়ের চিন্তা করতে থাকলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলীম লীগ প্রতিস্ঠিত হয়। কংগ্রেস মুসলীম লীগকে সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আখ্যায়িত করে। আর নিজেদের সর্বভারতীয় সার্বজনীন রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রচার করে। কংগ্রেস নেতারা  বৃটিশ সরকারের কাছে কংগ্রেসকে ভারতবাসীর একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রমান করার চেস্টা করতে লাগলেন। মুসলমান নেতারাও বসে থাকলেননা। তারাও জানান দিলেন, কংগ্রেস একটি হিন্দু সংগঠন এবং হিন্দুদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কংগ্রেস নেতারা  শিখ বৌদ্ধ জৈন ও খৃস্টান জনগনের কথা একেবারেই ভুলে গেলেন। ক্ষুদ্র ধর্ম গোস্ঠি ও জাতিগুলো নিজেদের আলাদা করে প্রতিস্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কট্টর হিন্দু নেতা গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্বপ্ন ছিল ইংরেজদের কাছ থেকে তারা একাই ক্ষমতা বুঝে নিবে। প্রথম দিকে মুসলমান নেতারা কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস করেছিলেন। এমন কি ১৯৩৪ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলীম লীগের সভাপতি হওয়ার পরও জিন্নাহ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চেস্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন অখন্ড ভারতে মুসলমানেরা তাদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে পাবে। কিন্তু দু:খের বিষয় কংগ্রেস নেতারা মুসলীম লীগের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায়নি। মুসলমানরা ভারতীয় হলেও তাদের আলাদা স্বত্তা আছে একথা হিন্দু নেতারা কখনই মেনে নিতে চাননি। কংগ্রেসের এই মনোভাবকে শাসক গোস্ঠিও পছন্দ করেনি। এমনি করেই এক সময় পাকিস্তান প্রস্তাব সামনে এসে যায় এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠে খুবই অল্প সময়ে। আজ ভারতীয় নেতারাও অনুভব করছেন, কংগ্রেসের  উদারতা সহনশীলতার অভাবেই ভারত বিভক্ত হয়েছে। ভারতের নতুন প্রজন্ম বুঝতে পেরেছে কংগ্রেসের হীনমন্যতা ও হিন্দুত্ববাদীতাই ভারত বিভক্তির জন্য দায়ী। মুসলমানরা একটি আলাদা জাতি একথা প্রমান করার জন্যেই তারা পাকিস্তান প্রস্তাবকে সামনে নিয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস বিভক্ত ভারতে একটি হিন্দু রাস্ট্র প্রতিস্ঠা করেই ছাড়লো। কংগ্রেস যদি হিন্দু ভারত না চাইতো তাহলে ভারত ভাগ হতোনা এবং নতুন মুসলীম রাস্ট্র পাকিস্তানও প্রতিস্ঠা হতেনা।
এতক্ষন যা বলেছি তার সবই পুরাণো কথা এবং ইতিহাসের পাতা থেকে নেয়া। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান সৃস্টির বিষয়টা আজও ভাল করে জানেনা। তাই পুরাণো কথা গুলো নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে বলতে হয়েছে। শিক্ষিত সমাজের ৯০ ভাগই জানেন বা বলেন জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্বের কারণে ভারত ভাগ হয়েছে। হাঁ, জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু কখন এবং কেন? কংগ্রেস যদি হিন্দু রা্স্ট্র ভারত না চাইতো তাহলে পাকিস্তান হতেনা। আগেই  বলেছি  কংগ্রেস যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্ব না করতো তাহলে মুসলীম লীগের জন্মই হতোনা। ভারতের মুসলমানরা এখনও  দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোস্ঠি। সে হিসাবে তারা এখনও অধিকার বঞ্চিত। এমন কি পশ্চিম বংগে অসম্প্রদায়িক বলে কথিত কমিউনিস্ট পার্টি ৩৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুসলমান জনগোস্ঠির সুবিচার করা হয়নি। ভারতের সকল রাজনৈতিক দলই মোটামুটি হিন্দু ভারতে বিশ্বাসী। ৪৭ সালেও কংগ্রেস মুসলীম মেজরিটি এলাকা পাঞ্জাব এবং বাংলাকে বিভক্ত করে। বাংগালীরা হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ ভাবে স্বাধীন অখন্ড বাংলাদেশ চেয়েছিল। সেটাও কংগ্রেস মানেনি।
৪৭ সালে পাকিস্তান রাস্ট্র  যখন প্রতিস্ঠিত হয় তখন এর রাজধানী নির্ধারন করা হয়  সিন্ধু প্রদেশের করাচীতে। ঢাকা প্রাদেশিক সরকারের রাজধানীতে পরিণত হয়। প্রাক  ৪৭  সময়ে সারা ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে বাংগালী মুসলমানের তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব ছিলনা। ফলে পাকিস্তান প্রতিস্ঠার পর সামরিক বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসের উচ্চ পদ গুলিতে চাকুরী লাভ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসারগণ। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পদ গুলিতেও অবাংগালী অফিসারগণ নিয়োগ লাভ করেন। ভারত বিভক্তির ফলে ভারত থেকে  লাখ লাখ অবাংগালী সরকারী কর্মচারী পূর্ব পাকিস্তানে আসতে শুরু করে। এদের পূণর্বাসনের দায়িত্ব পড়ে প্রদেশিক সরকারের উপর। আজকের মোহাম্মদপুর সে সময়েরই সৃস্টি। রেলের বড় বড় চাকুরী গুলো লাভ করেন অবাংগালী অফিসারেরা। পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে ছিল এক বিরাট চাকুরীদাতা। প্রদেশের জেলাগুলোতে অনেক অবাংগালী ডিসি , ডিএম ও এসপি চাকুরী পান। পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের নাম থখন ছিল ইস্ট বেংগল। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একজন গভর্ণর ও একজন চীফ সেক্রেটারী প্রদেশে থাকতো। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান ছিল খুবই অনগ্রসর। মূলত: একটি কৃষি প্রধান প্রদেশ। কল কারখানা যা ছিল তার মালিকরা থাকতেন কোলকাতায়। অধিবাসীদের ৯০ ভাগই ছিলেন  কৃষক। সত্যি কথা বলতে কি প্রদেশটি দীর্ঘকাল ইংরেজ শোষন ও হিন্দু জমিদারদের শোষণের ফলে নি:স্ব হয়ে পড়েছিল। সচিবালয়ে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে কর্মচারীরা কাজ করেছেন। মন্ত্রীরা তিন-চার জন মিলে একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ১৯০৫ সালে গঠিত প্রদেশ ব্যবস্থা যদি টিকে থাকতো তাহলে সদ্য স্বাধীন প্রদেশের এমন দূরবস্থা হতোনা। রেডী প্রশাসনিক কাঠামো পাওয়া যেতো। যা অন্য প্রদেশের ক্ষেত্রে বিদ্ধমান ছিল।
খুব বেশী পিছিয়ে পড়া এই প্রদেশের উন্নতির জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের যে সব জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল তা তারা নিতে পারেননি। হয়ত তাঁরা এর প্রয়োজন বোধ করেননি। হয়ত প্রদেশ সম্পর্কে তাদের সুস্পস্ট কোন ধারনা ছিলনা। বারোশ’ মাইল দূরে অবস্থিত এই প্রদেশের সাথে কেন্দ্রের শক্তিশালী টেলি যোগাযোগ বা বিমান যোগাযোগ ছিলনা। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিলম্ব হয়ে যেতো। নুরুল আমিন সাহেবের অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায় বিষয়টি খুবই স্পস্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। পুর্ব পাকিস্তানের জন্যে যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল তা কেন্দ্র কখনই অনুভব করেনি। অথবা তারা পুরো বিষয়টাকে অবহেলা করেছে। প্রাদেশিক মুসলীম লীগের রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানীকে অবজ্ঞা করা মোটেই বুদ্ধির পরিচায়ক হয়নি। প্রাদেশিক মুসলীম লীগ নেতাদের খামখেয়ালীপনা ও অদূরদর্শিতার ফলেই মাওলানা ভাসানী মধ্যবিত্ত তরুণ নেতাদের নিয়ে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করেন।দূর্বল মুসলীম লীগ সংগঠনের বিপরীতে আওয়ামী মুসলীম লীগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রদেশের সাধারন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভাষাকে কেন্দ্র করে প্রদেশের সাধারন মানুষের ভিতর এক নতুন জাগরনের সৃস্টি হয়।মুসলীম লীগকে রাজনীতি থেকে বিদায় দেয়ার জন্যে মাওলানা ভাসানী ৫৪ সালের নির্বাচনের জন্যে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে যুক্তফ্রন্ট গঠণ করেন। নির্বাচনে মুসলীম লীগের ভরাডুবি হয়। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম লীগ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অথচ এই দলটি নির্যাতিত মুসলমানদের বাঁচানোর তাগিদেই  ৪৭ সালে পাকিস্তান নামক  রাস্ট্রটি প্রতিস্ঠা করেছি। হিন্দু প্রাধান্যের সামনে তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্যেই পাকিস্তানের জন্যে জান দিয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের মাথায় প্রদেশের মুসলমানেরা নিজেদের বাংগালী ভাবতে শুরু করে। ৭০ এর সাধারন নির্বাচন অনুস্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের গণভোটের মতো। এই নির্বাচন ছিল বাংগালী অবাংগালীর নির্বাচন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোস্ঠি তা একেবারেই অনুধাবন করতে পারেনি। তারা আলোচনার দুয়ার বন্ধ করে দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে পাকিস্তান রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়নি। ১৬ই ডিসেম্বর’৭১ এ পাকিস্তানের পরাজয়ের পর পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেল। আমরা এবার ষোলয়ানা বাংগালী হিসাবে স্বাধীন হলাম। ৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছিলাম মুসলমান হিসাবে। মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তান খন্ডিত হয়ে গেল। এটাই পাকিস্তানের ডেস্টিনি ছিল। ১৬ ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন,‘ হাজার সালকা বদলা লিয়া’। কেন বলেছিলেন তা এক লম্বা ইতিহাস। ইতিহাস সচেতন সব মুসলমানেরই জানার কথা। শুরু হলো বাংগালী মুসলমানের নব যাত্রা। ৭১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর। আমাদের আত্মপরিচয় এখনও নির্ধারিত হয়নি। আমরা বাংগালী না বাংলাদেশী তাও ঠিক করে বলতে পারিনা। আমরা মুসলমান না বাংগালী? একদল বলেন পাকিস্তানের বিদায়ের সাথে সাথে দ্বিজাতি তত্বের কবর হয়েছে। বাংলাদেশ সৃস্টি হয়েছে বাংগালী তত্ত্বের ভিত্তিতে। এসব হচ্ছে রাজনীতির বাহাস বা বিতর্ক। রাজনীতিকরা বিতর্ক করেন তাদের ভোট এবং রাজনীতির জন্যে। কিন্তু গবেষকরা বলবেন প্রতিস্ঠিত গবেষণার ভিত্তিতে। আওয়ামী লীগ এবং তার দলীয় ও ভক্তরা মনে করেন আমাদের জাতীয়তা এবং ঐতিহ্য হচ্ছে ভাষা ভিত্তিক। যা  কোলকাতা আর দিল্লীর রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের মাথায় ঢুকিয়েছে। শুধু ভাষাই হতো তাহলেতো ৪৭ সালেই বাংগদেশ অখন্ড এক থাকার কথা ছিল। এক থাকেনি , কারণ কংগ্রেস তা চায়নি। কারণ অখন্ড বংগদেশে মুসলমানেরা ছিল মেজরিটি। এখনও দুই বাংলা মিলে মুসলমানেরা মিলে মুসলমানেরা মেজরিটি। খোদা কখনও বেকুবদের হেফাজত করেন না। যে ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্ঠার বিরোধীতা করেছেন আর ১৯০৫ সালের  বংগভংগ রদের জন্যে আন্দোলন করেছেন তিনিই এখন আমাদের জাতীয় দর্শন হতে চলেছেন। যিনি বৈদিক ধর্ম ও আদর্শে বিশ্বাস করেন তারই বন্দনায় আমরা পাগল হতে চলেছেন। যিনি জমিদার হিসাবে এক সময়ে এদেশের গরীব কৃষকদের শোষণ করেছেন। তাঁর অত্যাচারের নমুনা কি ছিল তা কাংগাল হরিনাথ আর গগন হরকরার লেখা পড়লেই বুঝতে পারবেন। এই মহা ভাগ্যবান মহাপুরুষের জন্ম জয়ন্তী উত্‍সব পালনের জন্যে বহুজাতিক কোম্পানীর অর্থের ভান্ডার সব সময় খোলা থাকে। মানবতার কবি নজরুলের এসব আয়োজন কখনই জোটেনা। এর রহস্য কি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখনও ভাবার সুযোগ পান না।
বাংলাদেশের অধিবাসীর  ৯০ ভাগ মুসলমান। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে আমাদের ধর্ম ও ধর্মীয় দর্শন  নিবিড়ভাবে জড়িত। ধর্মকে আমেদের জীবন থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। যেমন গান্ধীজী বলেছিলেন,তিনি প্রথমে হিন্দু তারপরে জাতীয়তাবাদী। ধর্মের বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতাও চান না। তিনিই হচ্ছেন ভারতের বাপুজী। তিনি তাঁর হিন্দুত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই ভারত বিভক্তিকে সমর্থন করেছেন। আর আমরা জিন্নাহকে সাম্প্রদায়িক বলে গালআগাল দিই। ভারতের কট্টর হিন্দুবাদীরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নতুন তত্ত্ব  দিয়েছেন। তাহলো ভারতবাসী সকলেই ভৌগলিক কারণে হিন্দু। মুসলমানদের বলতে হবে, হিন্দু মুসলমান। ভারতের হিন্দু নেতারা এখনও স্বপ্ন দেখেন অখন্ড ভারতের এবং হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিস্ঠার। আমাদের দেশে যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেন তারা জ্ঞানপাপী আর হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তারা জেনে শুনে আমাদের জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কারন আমাদের জাতিসত্ত্বার প্রধান উপাদান হচ্ছে আমাদের ধর্ম। এই ধর্মই আমাদের ৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা করেছে। এই ধর্মের কারনেই ১৭৫৭ সালে হিন্দুরা  ক্লাইভকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এই ধর্মের কারনেই হিন্দুরা  ১৫০ বছর ইংরেজ শাসনকে সমর্থন করেছে। ৭১ সালে আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছি অর্থনৈতিক কারনে। বাংগালী বলে নয়। ৬ দফা ছিল অর্থনেতিক শ্লোগান ও দাবী। ৬ দফায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা বাংগালী বলে কোন শ্লোগান ছিলনা। পাকিস্তানী শাসক গোস্ঠি যদি ৬ দফা মেনে নিত তাহলে পাকিস্তান আজ খুব বেশী হলে একটি  কনফেডারেশন হতো। বংগবন্ধুও হয়ত  তাই চেয়েছিলেন। তাই তিনি স্বাধীনতার কোন প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি। কিছুলোক এখন তাঁর নামে নানা ধরনের ঘোষণা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। জিন্নাহ ভারত ভাগ করেছেন আর বংগবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন হচ্ছে রামায়ন মহাভারতের মতো একটা মীথ। ভারতের হিন্দুরা এই মহাকাব্য দুটিকে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা একটা হচ্ছে ইতিহাস আরেকটা হচ্ছে মীথ। অনেক সময় মীথ ইতিহাসের চেয়ে বহু গুণে শক্তিশালী হয়। ( নয়া দিগন্ত, জুন ৪, ২০১১ )

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.