Thursday, August 30, 2012

আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সাজেশন

১।
বিশ্বায়ন বলতে কি বুঝ? বিশ্বায়নের প্রভাব আলোচনা করুন। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া কি সফল হয়েছ? না হলে বাধাগুলো কোথায়? দোহা রাউন্ডের ভিত্তিতে আলোচনা করুন।
২।
ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের এ পর্যন্ত যত উদ্যোগ গ্রহন হয়েছে তা আলোচনা করুন। ফিলিস্তিনি আদৌ কি স্বাধীন হবে? যদি স্বাধীন না হয় তাহলে বাধাগুলো কোঠায়?
৩।
আরব বসন্ত বলতে কি বুঝেন? এই বসন্তের মুল কারণগুলো কি কি? এই বসন্তের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবার কথা ছিল কিন্তু তা যদি না হয় তবে বাধাগুলো কি কি?
৪।
সমুদ্র সীমানা বলতে কি বোঝেন? মায়ানমারের সাথে মামলার রায় উল্লেখ করে ভারতের সাথে সমুদ্র সীমানা আলোচনা করুন।
৫।
জাতিসংঘের সফলতা ও ব্যর্থতা আলোচনা করে সংস্কার পদ্ধতি আলোচনা করুন।
৬।
SAARC/OIC/NAM/NATO/Commonwealth/ASEAN –এর সফলতা ও ব্যর্থতা আলোচনা করুন।
৭।
WB/IMF এর গঠন ও কাজ উল্লেখ করে ঋণ দান পদ্ধতি আলোচনা করুন।
৮।
WTO কি? ইহা তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে নাকি পুঁজিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
৯।
পররাষ্ট্র নীতি ও কূটনীতির মধ্যে কি সম্পর্ক? কূটনীতিবিদদের সুযোগ সুবিধা এবং দায়মুক্তি Viena Convention এর আলকে আলচন করুন।
১০।
অর্থনৈতিক কূটনীতি বলতে কি বোঝেন? Look East Policy বলতে কি বোঝেন? Envoy কি? Persona Non Grata কি? বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র নীতি উল্লেখ করে সাংবিধানিক ধারায় পররাষ্ট্রনীতির আলোচনা করুন।
পররাষ্ট্রনীতির নিয়ামকগুলো কি কি?
বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ-মায়ানমার (রোহিঙ্গা সমস্যা) সম্পর্কের মূল্যায়ন করুন।
১১।
বারাক হোসেন ওবামার ইরাকনীতি,আফগাননীতি, মধ্যপ্রাচ্যনীতি, দক্ষিন-এশিয়া নীতি, স্বাস্থ্যনীতি আলোচনা কর।
১২।
যৌথ নিরাপত্তা (Collective Security) বলতে কি বোঝেন? Ballance of Power কি?
জাতীয় শক্তির উপাদানগুলো আলোচনা করুণ।
১৩।
জাতীয়তাবাদ কি? নব্য উপনিবেশবাদ কি? সম্রাজ্যবাদ কি? North-South Dialouge কি? Third World কি? মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতি আলোচনা করুন।

Wednesday, August 29, 2012

কাজী নজরুল ইসলাম


কাজী নজরুল ইসলাম: (মে ২৪, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬),(জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ - ভাদ্র ১২, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালিকবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই "বিদ্রোহী কবি"।, তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।
নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটারদলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকেঅবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম| তারা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"।, তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল)কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে নেমে যেতে হয় জীবিকা অর্জ্জনে।এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদেরমুয়াজ্জিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল)[৪] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙশকুনীবধরাজা যুধিষ্ঠিরের সঙদাতা কর্ণআকবর বাদশাহকবি কালিদাসবিদ্যাভূতুমরাজপুত্রের গানবুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ।[২] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - “ কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। ”
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ"। এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল। এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র'সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলেসপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।  সৈনিক জীবন
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফারসি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধিইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাতএবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। 
সাংবাদিক জীবন ও বিয়ে
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্‌ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্‌ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দম্‌। এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।

তরুণ নজরুল
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবেব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।বিদ্রোহী নজরুল
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে। এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তাঁর মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে "এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে" প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল। এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী"। নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেনঃ-
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।
...
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নিপাথার কলরোল কলকোলাহল ।
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারী ভুবনে সহসা সঞ্চারী ভূমিকম্প ।
..........................
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যেরাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...।
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।  
অসুস্থতা
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি। এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।
এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক। তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল "ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)।, কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্‌স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বরতারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।  
বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারতসরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচকডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন:
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন

তিনি কালীদেবিকে নিয়ে অনেক শ্যামা সঙ্গিত রচনা করেন , ইসলামী গজলও রচনা করেন । নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেছেন - কেউ বোলে আমা এই কবিতায় তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়। তার জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। 
সাহিত্যকর্ম 
কবিতা

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: "প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্‌-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা" ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল "বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী"। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: "হেনা, ব্যাথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে"। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়।  রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দর্শন
সৈনিক জীবন ত্যাগ করে নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে বাস করছিলেন। মুজফ্‌ফর আহমদ ছিলেন এদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এখান থেকেই তাই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়। মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। এ সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে পরিচিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তার লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ। এরই সাথে প্রকাশ করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত। তার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রেড ফ্ল্যাগ-এর অবলম্বনে রচিত রক্তপতাকার গান
তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতারণ। আর খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কারণ এই সমন্বিত সুলতানী শাসন ব্যবস্থার প্রধান তথা তুরস্কের সুলতানকে প্রায় সকল মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের খলীফা জ্ঞান করতো। নজরুল এই দুটি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা তথা স্বরাজ অর্জনে বিশ্বাস করতেন যা মহাত্মা গান্ধীর দর্শনের বিপরীত ছিল। আবার মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন তুরস্ক গড়ে তোলার আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তারপরও তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
তবে সব দিক বিচারে নজরুল তার রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। কারণ কামাল পাশা তুরস্কে সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত তথা সালতানাত উচ্ছেদ করে দেশটিকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুরস্কবাসীদের জীবন থেকে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করতে পেরেছিলেন বলেই নজরুল তার প্রতি সবচেয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ(অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম)মত প্রকাশ করেছেন।নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবেনা? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। আর তার এই অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল কামাল পাশার। সে হিসেবে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা। নজরুলও তার বিদ্রোহী জীবনে অনুরুপ ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯২১সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্‌ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯১৭ সনের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেও নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনই এই দলের সদস্য হননি, যদিও কমরেড মুজফ্‌ফর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আজীবন।
১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন।নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পাননি। এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিপ্রকাশ অব্যাহত থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়। 

সম্মান
কাজী নজরুল ইসলামের সম্মানে উৎসর্গিত কলকাতা মেট্রোর কবি নজরুল (গড়িয়া বাজার) মেট্রো স্টেশন।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর রচিত "চল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায় নজরুল অ্যাকাডেমি ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমী, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারীভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট, কলকাতায়নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মূল শহরের সংযোগকারী প্রধান রাস্তাটি কবির নামে উৎসর্গ করে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি করা হয়। এছাড়াও কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার স্টেশনটিকে কবির সম্মানে কবি নজরুল নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ। 
সূত্র: উইকিপিডিয়া

The Daily Ittefaq | মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও আশঙ্কা | News


মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও আশঙ্কা

লেখক: আ. কাইউম  |  বুধবার, ২৯ অগাষ্টu-এ ২০১২, ১৪ ভাদ্র ১৪১৯
তাহলে বোয়াজিজিই কি সেই মহানায়ক, যিনি নিজের গায়ে আগুন দিয়ে জীবন উত্সর্গ করে উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় বেনআলীবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তার পতনের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে মিসরের হোসনি মোবারককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এবং লিবিয়ার লৌহমানব মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির চার দশকের শাসনের অবসানের পর ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোকে গণতন্ত্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শীতল করেছেন? নাকি মহাবীর তারাও যারা তিউনিসে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, যারা ত্রিপলিতে ও বেনগাজীতে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিল এবং যারা মিসরের তাহরীর স্কয়ারকে রক্তে রর্িঞ্জত করেছিল? এরা সবাই মহাবীর—কারণ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনে এদের সবারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান রয়েছে। তবে বোয়াজিজি একটু বেশিই। কারণ ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলো থেকে আরব বসন্তের হাওয়া সুয়েজখাল পাড়ি দিয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় এসে থমকে আছে। থমকে থাকলেও এর সূচনা কিন্তু বোয়াজিজির হাতেই। যুদ্ধরত ও সমঝোতাহীন সিরিয়ার বর্তমান বিষয়টির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এতই বেশি যে, এই অঞ্চলকে সবাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বর্তমানে এ অঞ্চলের গুরুত্ব আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ এ অঞ্চল তিন মহাদেশের মিলনস্থল, নৌ যোগাযোগব্যবস্থা, ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা (মুসলমানদের মসজিদুল আকসা, খ্রিস্টানদের বেথেলহেম, ইহুদীদের সিনামোম) এবং আরো রয়েছে তেল সম্পদ। তাই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মিসর, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান ও সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের গুরুত্ব একটু বেশিই।
এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে দৌড়ঝাঁপ ও কূটনীতি বেলফোর ঘোষণার (নভেম্বর ১৯১৭) পর থেকে শুরু হয়েছে, তা আজও বিরাজমান। যুদ্ধবিরোধী যুদ্ধে জয়ী হতে এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে ১৭২টি আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানসহ ৮০টিরও বেশি অনিবার্য যুদ্ধ নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এ-সংস্থাটি। অছি পরিষদের (Trustship Council) অধীনে অসংখ্য দেশ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ফিরে পেয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যাসংকুল বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশংসনীয়। যেমন কম্বোডিয়া, নামিবিয়া, এলসালভাদর, মুজাম্বিক, পূর্বতিমুর ইত্যাদি দেশে গণতন্ত্রসহ তাদের আত্মঅধিকার ফিরে পাবার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাই প্রধান। তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে, যা এক দীর্ঘ সমস্যা, তা কেন শান্তি প্রতিষ্ঠার নিয়তে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ সমাধান করতে পারছে না? তাহলে জাতিসংঘ কি এক মেরুকেন্দ্রিক কোনো হুকুমের তাঁবেদারি করছে? নাকি আজ জাতিসংঘ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠনের পরিবর্তে পুতুল সংগঠনে পরিণত হয়েছে? বিশ্বমানচিত্রে আজ ফিলিস্তিন একটি সার্বভৌমত্বহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে (১৫ মে ১৯৪৮) ৭৮% এবং তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বাকি ২২% ভূমি ইসরাইল দখল করলে পুরো ফিলিস্তিন একটি উদ্বাস্তু রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৬৪ সালে পিএলও গঠনের পর ১৯৮৮ সালে তিউনিসিয়ায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং ঘোষণা মোতাবেক ফিলিস্তিন স্বাধীনতার প্রহরও গুনছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে দৃশ্যপট আস্তে আস্তে পালটে যায়। কারণ ইরাকের সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাঁটছড়া যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করেছিল। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্র এমন আচরণ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গেও করেছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বন্যা হলে যুক্তরাষ্ট্র PL-480 (Public Law-480)-এর আওতায় গম সহায়তার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ কিউবার সঙ্গে পাটের বাণিজ্যচুক্তি করায় গম সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে এক বৃহত্ জাতীয় শক্তির অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ বা বল প্রয়োগ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতি প্রায়ই চোখে পড়ে। যাই হোক, এতকিছুর পরও (স্বায়ত্তশাসন চুক্তি ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, হেবরণ চুক্তি ১৫ জুন ১৯৯৭, ভূমির বিনিময়ে শান্তি চুক্তি/ওয়াইরিভার-১  ২৩ অক্টোবর ১৯৯৮, ওয়াইরিভার-২ ৪সেপ্টেম্বর ১৯৯৯) ২০১২ সালে এসেও ফিলিস্তিনিয় স্বাধীনতা অর্জিত হচ্ছে না, যা রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৫ সালে হবার কথা ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন সমস্যার সঙ্গে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সিরিয়ার পরিস্থিতি দ্বিমেরুকেন্দ্রিক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU),  অন্যদিকে সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়া, চীন ও ইরান। উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি ২০০৫-এ ইরান-সিরিয়া পারস্পরিক হুমকি মোকাবেলায় আত্মরক্ষামূলক একটি প্রতিরক্ষাচুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ১৮৭০ সালে জার্মান জাতির জনক অটোভান বিসমার্কের নেতৃত্বে গড়া শক্তিজোটের মতো এক জোট, যা আমেরিকার প্রতি সরাসরি এক চ্যালেঞ্জের শামিল। অটোভান বিসমার্কের বিরুদ্ধে রাশিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেনের (১৮৯৩) মতো পালটা শক্তিজোট করে আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ কি সিরিয়া ও ইরান? আর এ আগমনী বার্তাই কি কিছুদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যে সফরে এসে দিয়ে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী রডহ্যাম ক্লিনটন?
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও  আরবের কয়েকটি দেশ ‘ফ্রেন্ডস অব সিরিয়া’ জোটের প্রতি সমর্থন দিলেও সিরিয়ার সহিংসতার জন্য প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। পঞ্চ শক্তির বৃহত্ দুই শক্তি চীন ও রাশিয়া যদি সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে থাকে তাহলে আমেরিকা ও ইইউ (EU) সমর্থিত কোনো সামরিক বাহিনী (NATO) পদক্ষেপ নিতে পারবে না। আর যদি নেয়ই তাহলে এই আধুনিক বিশ্ব যার মুখোমুখি হতে পারে— সে জন্য জুলাই ২০১০-এ কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর একটি টেলিভিশন সাক্ষাত্কারের কিছুটা উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেন, “ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের মুখোমুখি অবস্থান বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর এজন্য দায়ী থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।” তাই ইরানে পারমাণবিক কর্মসূচির নাম দিয়ে হোক, অথবা সিরিয়ার সহিংসতা বন্ধের নাম দিয়ে হোক বৃহত্ কোনো শক্তির বিরুদ্ধে আমেরিকার এমন কোনো পদক্ষেপ পৃথিবীকে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতির সামনে ফেলতে পারে। আর এমন পরিস্থিতি যদি ঘটেই তাহলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী/রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের আলোচিত থিসিস The clash of civilization-এর মূল কথাই প্রতিফলিত হবে যে, “ভবিষ্যত্ সংঘাতের চরিত্র হবে সভ্যতাভিত্তিক, রাষ্ট্রভিত্তিক নয় এবং স্নায়ুযুদ্ধ (cold war) পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় এই সভ্যতা শক্তিশালী হবে ‘সাংস্কৃতিক যোগসূত্র’-এর ভিত্তিতে, যার মূল উপাদান হবে ধর্মকেন্দ্রিক, এর একদিকে থাকবে ইসলাম ও চীন, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদি গণতান্ত্রিক দেশগুলো।”
ঢাকা

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কিছু কথা - ড. মাহবুব উল্লাহ


 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রটির উদ্ভব ঘটেছে একটি জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জনগণের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী বহু ঘাত-প্রতিঘাত এবং রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ঐতিহাসিক নানা মাত্রার ঘটনা পরম্পরার তাত্পর্যে সৃষ্ট ও বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আপামর মানুষ তাদের চেতনার মর্মে লালন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত চেতনা এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের জীবনে বাস্তবায়ন দেখতে চায় স্বাধীনতার প্রায়োগিক ইতিবাচক ফলাফল, যার দ্বারা একদিকে দেশের অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অধিক শক্তিশালী ও অটুট হবে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে জনজীবনের মানোন্নয়ন ঘটানো হবে এবং সর্বোপরি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে ভিত্তি করে জাতীয় রাজনীতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব সমগ্র জাতির। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, কেননা, দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ একমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৯ মাসব্যাপী রক্তাক্ত সশস্ত্র সমরে অংশ নিয়েছে এবং লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণের এবং লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের জাতিরাষ্ট্র এই বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়টি একদিকে যেমন জাতীয় আবেগের বিষয়, তেমনি জাতীয় সম্মিলনেরও বিষয়। সমগ্র জাতিকে সব ভেদাভেদ ও পার্থক্য ভুলে একদেহে লীন হয়ে যাবার চেতনা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক অসাধ্য সাধন করে অর্জন করেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে এর ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে বিগত ৩৮ বছর যাবত্ স্থান করে নিয়েছে। আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখার স্বাধীনতা আমরা এখন পর্যন্ত অটুট রেখেছি নিঃসন্দেহে, যদিও আমাদের পরিসীমার তিন পাশের ভারত আমাদের ছিটমহল সমস্যার সমাধানে আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়ে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। ছিটমহল সংক্রান্ত ভারতের দাবি বাংলাদেশ বহু আগেই পূরণ করলেও ভারত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ছিটমহল সংক্রান্ত যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করেনি এবং পূরণ করার কোনো আলামতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৫৪টি অভিন্ন নদীর যৌথ পানি প্রবাহের অংশীদারিত্ব নিয়ে সমস্যা। ফারাক্কা চুক্তি অসম হওয়ায় ও এতে গলদ থাকায় বাংলাদেশ এর ন্যায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল খরার কারণে ও পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের নিরন্তর অবাধে হত্যাযজ্ঞ, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের সমস্যা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সম্প্রতি বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভারতের স্বার্থে ও বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী ভারতের প্রতি নতজানু বৈদেশিক নীতি অনুসরণ। ফলে বিগত ৩৮ বছরের কর্মকাণ্ডে জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো জাতীয় উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি। এর ৩টি প্রধান কারণ দেশপ্রেমিক সচেতন মহলের কাছে পরিদৃশ্য।
প্রথমত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি এবং মতৈক্যের মেরুকরণ, যা রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় লক্ষণীয়ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ বিভ্রান্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সূচনাপর্ব নিয়ে মতানৈক্য এবং ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি ও চরিত্র বিশ্লেষণে ইতিহাস চেতনার ও ঐতিহাসিকতার অভাব। আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি খোঁজ করে ফিরছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় অভিষিক্তও করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের তথা ইতিহাসের পূর্ব বাংলার হাজার বছরের স্বাতন্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আমাদের একটি বুদ্ধিজীবীমহল ও রাজনৈতিকমহল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সূচনাপর্ব বলে মনে করে। যদি তাই হয়, তাহলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সম্মান তো বাংলাদেশের মানুষ কাউকে দিতে পারে না এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি খোঁজার চেষ্টারও কোনো যুক্তি ও আবশ্যকতা থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি বড় বিভ্রান্তি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ইসলামী চেতনা এবং মুসলমানিত্বের বিরুদ্ধে প্রদীপ্ত করার দৃষ্টিভঙ্গিগত রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা। এর সূত্র ধরে আমাদের সংবিধানে ঢুকে পড়েছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষও এই ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিরই ফসল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আরেকটি বিভ্রান্তিমূলক রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কৃতিত্বকে দলীয়করণ করত সমগ্র জাতিকে এই চেতনা ও কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করে, একটি মহল কর্তৃক নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি নামে আখ্যায়িত করে বিগত ৩৮ বছর ধরে জাতি বিভক্তির রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডকে উত্সাহিত করা। জাতি বিভক্তির রাজনীতি যে আসলে জাতিকে দুর্বল করে এবং এর ফলে জাতির অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, এ বিবেচনা ও বোধ এতে স্থান পায়নি।
তৃতীয়ত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি বিভ্রান্তি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি। ভারত উপমহাদেশের সামিল একটি দেশ। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তি ও পাকিস্তানের সৃষ্টি ভারতীয় রাজনীতিকরা কখনও মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি এবং ভারত এখনও সেই অবিভক্ত ভারতের পুনরেকত্রীকরণে বিশ্বাসী। ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোতে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিদৃশ্য হচ্ছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। কিন্তু ভারত এসব আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আখ্যায়িত করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এদের দমন করছে। সেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ যা ছিল পাকিস্তানের সরকারের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে কেন সহযোগিতা করেছিল, কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত অংশগ্রহণ করেছিল এর যথার্থ ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিভ্রান্তি আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে রয়েছে। এই মহলটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি না তাকিয়ে কেবল বাংলাদেশকে ভারতের প্রতি নতজানু রেখে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সদা আগ্রহী ও ব্যস্ত। আমাদের জাতীয় জীবনে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত উল্লেখিত এই বিভ্রান্তিগুলোর মোচন ব্যতীত আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে না পারব আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালীভাবে নিশ্চিত করতে, না পারব স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটাতে কার্যকর করতে, না পারব গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এবং জাতীয় সংস্কৃতিকে স্বাতন্ত্রিকভাবে বিকশিত করতে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মহলটি নিজেদের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি বলে মনে করে তারাই এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। জাতির সামনে একটি সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল দিনবদলের ইশতেহার উপস্থাপন করে দেশের মানুষকে সোনার বাংলাদেশ (যদিও এই মহলটি সোনার বাংলা বলতেই অধিক অভ্যস্ত) উপহার দেয়ার স্বপ্নে বিভোর করে ক্ষমতায় এসেছে বলে দাবি করে। অথচ তাদের চৌদ্দ মাসের দেশ পরিচালনায় দিনবদলের কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারা দলকে দেশ মনে করে সর্বত্র দলীয়করণ করছে, যা ফ্যাসিবাদের রূপ পরিগ্রহ করার সমূহ সম্ভাবনা। ভারতের স্বার্থে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এরা ভিন্ন দেশের বাঙালি সংস্কৃতিকে যার মধ্যে বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতির কোনো প্রতিফলন নেই, তাকে বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উত্সাহিত করছে, মামলা-হামলা করে বিরোধী দলকে উচ্ছেদ করার মহোত্সবে মেতে উঠেছে, বাংলাদেশের হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, পুকুর, ডোবা, নালা, নর্দমা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, বিমানবন্দর সর্বত্র জাতীয় সম্পদকে দলের করায়ত্ত করার লক্ষ্যে দলীয় সন্ত্রাস কায়েম করেছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, লুটসহ কলেজের ছাত্রীদের সম্ভ্রমহানির রাজনীতিতে নিপতিত করে তারা এখন দৌরাত্ম্যের সঙ্গে দলীয় রাজত্ব কায়েমের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে। রাজনীতি ও ইতিহাসকে তারা এখন আইন আদালতের রায়ের কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার মসনদে থাকার কারণে তারা এই মুহূর্তে মনে করছে রাজনীতি ও ইতিহাসকে আদালতের রায়ের কাছে ইজারা দিয়ে তারা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে তাদের এ মুহূর্তে কোনো আন্দাজ নেই। আদালতের রায়ের মাধ্যমে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক এই গণ্যতা তাদের লাভ করতে হয়েছে। তারা এখনও বুঝতে অক্ষম যে, শেখ মুজিব তার কর্ম ও নেতৃত্ব দ্বারা দলীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতায় উত্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা এই জাতীয় নেতাকে শুধু দলীয় নেতার মর্যাদাতেই টেনে নামাচ্ছে না, এই মহান নেতার স্মৃতিময় ব্যক্তিত্বে বিতর্কের ও অশালীনতার কালিমা লেপন করে চলেছে। জাতীয় সংসদ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এই জাতীয় সংসদ সরকারি দলের চণ্ড আচরণের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। জাতীয় দুই মহান ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমান এই চণ্ড আচরণের শিকার। এই দুই মহান নেতা যদি কবর থেকে সশরীরে উঠে আসতে পারতেন তাহলে হয়তো বলতেন—তোরা ক্ষান্ত হ, তোদের অসম্মান প্রদর্শনে আমরা ক্ষত-বিক্ষত, স্বাধীনতার জন্য তোরা যোগ্য নস, তোদের স্বাধীনতার কোনো প্রয়োজন নেই, পরাধীনতাই তোদের ভাগ্যলিপি, পরাধীনতাই তোদের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা...।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন। তারা একজন অন্যজনের প্রতিযোগী কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। একজন রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিকশিত হয়েছিলেন রাজনীতি করে ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে। অন্যজন রাজনীতিক ছিলেন না, কিন্তু দেশে সৃষ্ট ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে অসম সাহসিকতার সঙ্গে প্রবল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন বিধায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়ার জীবনে কেবলই সফলতা ছিল, ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতা ছিল না, একথা বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের সফলতা ব্যর্থতাকে ঢেকে দিয়েছে। দু’জনই জাতির কাছে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছেন। একজনকে অন্যজনের সঙ্গে তুল্য করার দৃষ্টিভঙ্গিটাই একটি বড় ভুল। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা খর্ব কিংবা খাটো হয়ে গেল এমন মনে করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জাগ্রত ও উদ্বেলিত না করলে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার দুর্লভ ওই ঐতিহাসিক সুযোগ পেতেন না, আবার মেজর জিয়া ওই সন্ধিক্ষণে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে জাতি ত্বরিতগতিতে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেত না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এখন আর কোনো দলের নন, সমগ্র জাতির। অথচ বিভ্রান্তি ও হীনতার কারণে আমরা এই দুই মহান ব্যক্তিকে বিতর্কিত করছি, তাদের স্মৃতি ও কর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি, ফলে দেশে জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জাতীয় বিভক্তিকে সম্প্রসারিত করছি।
এই দুই জাতীয় নেতাকে আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত দলীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার অসুস্থ ও অযৌক্তিক রাজনৈতিক কসরত্ থেকে নিবৃত্ত না হব ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের ইতিবাচক প্রভাব। জনজীবনে কার্যকর করা যাবে না। যখন যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম ও স্মৃতিকে, কেউই নাম বদল করে, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। আমাদের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই বোধোদয় না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের জীবনে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। দেশের কোনো উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হবে না। এই বোধোদয় সৃষ্টিতে সরকারি দলকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে, হিংসা ও বিদ্বেষকে পরিত্যাগ করতে হবে। সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদানকে স্বীকার করে নিয়ে সম্মান প্রদর্শনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সরকারি দলকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের মানুষের জীবনে স্বাধীনতা প্রাপ্তি অর্থবহ হয়ে উঠবে। আমাদের সবার মনে রাখা আবশ্যক যে, স্বাধীনতা অর্জন তখনই সার্থক হয় যদি তা রক্ষা করা যায়, নতুবা নয়।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জাতীয় ব্যক্তিত্বের নাম ও অবদান। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী, গীতিকার, সঙ্গীত শিল্পী, পেশাজীবী এবং দেশের সাধারণ জনগণ থেকে উঠে আসা অসাধারণ মানুষেরা। দেশের নাগরিকদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কার্যকর করতে হলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নবপ্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করতে হলে, এসব ব্যক্তিত্বের অবদানকেই প্রথমে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতি ও ইতিহাস চর্চায় তা ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনাকে অবশ্যই হতে হবে দলীয় রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের আবেগের প্রভাবমুক্ত। না হলে সেই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ ইতিহাস হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাদের সংশ্রব ও সম্পৃক্ততা ছিল, খুব স্বাভাবিক কারণেই এদের কলম দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচিত হবে না, কেননা যারা ইতিহাসে ঘটনা সৃষ্টি করেন তারা সেই ঘটনার নিরপেক্ষ ও সঠিক ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম নন। এটিই ইতিহাস রচনার শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচিত হবে আগামী প্রজন্মের ইতিহাস রচয়িতাদের হাতে, যারা ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত লেখকরা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম যে যেভাবে দেখেছে, যেটি যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেগুলো তথ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করতে পারেন বটে, কিন্তু বিশ্লেষণে গেলেই নিরপেক্ষতা হারানোর সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর এ কারণেই আমরা আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিগত ৩৮ বছর তর্ক-বিতর্ক করছি, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছি, সঠিক ইতিহাসের নামে দলীয় কৃতিত্বের ইতিহাস রচনা করছি এবং এ প্রবণতার দ্বারা একদিকে জাতীয় নেতৃত্বের অবমাননা করছি ও জাতীয় ইতিহাসকে জাতির কাছ থেকে ছিনতাই করে দলের সম্পদ ও কৃতিত্ব রূপায়িত করতে চাচ্ছি।

পদ্মা সেতু এবং পদ্মার ঢেউ


লেখক: ড.এ কে এম শাহনাওয়াজ  বুধবার, ২৯ অগাষ্টu-এ ২০১২, ১৪ ভাদ্র ১৪১৯
পদ্মার সেই প্রমত্তা রূপ নেই। ঢেউয়ে উত্তাল হয় না মাঝির নৌকা। এখন অবশ্য পালতোলা গুনটানা নৌকা নেই বললেই চলে। সব শ্যালো ইঞ্জিন বসানো নৌকা। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে ক্ষীণতোয়া হয়ে যাচ্ছে নদীটি। এককালে পদ্মার হাত থেকে রাজশাহী শহর বাঁচাতে শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন বাঁধ রয়েছে; কিন্তু সরে গেছে পদ্মা। পদ্মা দেখতে গিয়ে প্রকৃতি প্রেমিকরা দেখে ধু-ধু বালুচর। আর দূরে চরের ফাঁক-ফোকরে পানি ঝিলিক দিলে লাফিয়ে উঠে বলে ঐ দেখ পদ্মা দেখা যায়। পদ্মা এখন অপেক্ষাকৃত বেশি দৃশ্যমান বিক্রমপুর, শরিয়তপুর ও মানিকগঞ্জের সীমারেখায়। বর্ষা ছাড়া বাকি সময় এসব অঞ্চলে অসংখ্য ডুবো আর দৃশ্যমান চরের ফাঁকে ফাঁকে পদ্মা বয়ে চলে। তবে বর্ষাকালে পাড় ভেঙ্গে লোকালয় আর ফসলি জমি গ্রাস করে পদ্মা নিজের যৌবনকালের কথা এখনো মনে করিয়ে দেয়। পদ্মার সগর্জন ফেনিল ঢেউয়ের কথা যথার্থই মনে করিয়ে দিয়ে এদেশের মানুষকে স্মৃতি ও মর্মকাতর করে দিয়েছে এবারের আওয়ামী লীগ সরকার। অনেক বেশি ঢেউয়ের দাপাদাপি হয়েছে। প্রথমে পদ্মার পাড়ে বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর তৈরি করতে গিয়ে, তারপরে পদ্মা সেতুর উপাখ্যান তৈরি করে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু তৈরি করতে গিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক নাটক তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চিরকেলে রাজনৈতিক ঝগড়া থেকে রেহাই পায়নি পদ্মা সেতু প্রকল্প। প্রথম তর্কের শুরু সেতু      বাস্তবায়নের স্থান নির্বাচন নিয়ে। পাটুরিয়া ঘাট না মাওয়া ঘাট কোন অঞ্চলটি অধিক যোগ্য জায়গা হবে এ নিয়ে চললো শুরুর বিতর্ক। ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদ অঞ্চলের মানুষ চাইলো পাটুরিয়া-দৌলদিয়ার কাছাকাছি হোক এই স্বপ্নের সেতু। বেঁকে বসলো শরিয়তপুর, মাদারীপুর, খুলনার মানুষ। মাওয়ার কাছে সেতু তৈরি হলে তাদের  সুবিধা। যুক্তি হলো এখানে সেতু হলে দেশ বেশি উপকৃত হবে। চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা থেকে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে অনেকগুলো ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। শেষ পর্যন্ত স্থির হলো মাওয়া পয়েন্টে হবে পদ্মা সেতু। জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রাথমিক কাজও চলতে থাকলো। বিশ্বব্যাংক এবং এর সহযোগী এডিবি জাইকার সাথে ঋণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হলো। কিন্তু বিরোধী পক্ষের প্রশ্নের মধ্যে থাকলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন নাকি চাকরি, প্রমোশন আর বদলিতে সুবিধাভোগী অগ্রসর জেলা গোপালগঞ্জের মানুষ। এ কারণে মাওয়া পয়েন্টে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো বিরোধী পক্ষ। কিলোমিটারের হিসাব শুরু হলো পাটুরিয়া না মাওয়া কোন পথে গোপালগঞ্জ কাছে হবে।
রাজনৈতিক ঝগড়ার অংশীদার বিএনপি সকল পক্ষকে খুশি করতে বলে দিল তারা ক্ষমতায় এলে একটি নয় দুই পয়েন্টে দুটি সেতু বানাবে। পদ্মা সেতু বানানোর জ্বালাটা কি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ করে এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক পরিবেশে। তাই বিএনপির দুটি সেতুর স্বপ্ন আপাতত তোলা থাকলো। কিন্তু তাইবা কেন হবে। বিশ্বব্যাংক পিছিয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এদেশের মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে পড়েছিল। নিজ টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল সরকারি উদ্যোগে। চাঁদা তোলার ফর্মুলাও তৈরি হয়ে গেছে। অতি উত্সাহী কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে কোটি কোটি টাকার চেক তুলে দেয়ার মহড়াও দিয়েছিল। এই সুযোগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিকে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত করতে সচেষ্ট হলেন। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পদ্মা সেতু তহবিল গঠনে উত্সাহিত করেন। প্রবাসী আওয়ামী লীগাররা লন্ডনে প্রিয় নেত্রীকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাদের টাকায় একটি-দুটি নয়, চারটি পদ্মা সেতু বানানো কোনো ব্যাপার নয় জানিয়ে দিলেন। এত কিছুর পরও খেই হারাতে থাকলো সরকার। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ আওয়ামী নেতারা যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে অনাবিল স্বাধীনতায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করতে লাগলেন। বিশ্বব্যাংক চুক্তি থেকে পিছিয়ে গেল। অভিযোগ করা হলো সেতু বাস্তবায়নের শুরুতেই দুর্নীতির গন্ধ তারা পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-উপদেষ্টারা দুর্নীতির রূপরেখা তৈরি করেছেন। সুতরাং এসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠী চুক্তি বাতিল করবে। সরকার যথারীতি অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিল। শুধু তাই নয়মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উল্টো বিশ্বব্যাংককেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী যোগাযোগ শুরু করলেন মালয়েশিয়ার সাথে। বিশ্বব্যাংকের চেয়েও কম সুদে টাকা পাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে একটি ‘চমক’ দেখানোর ইঙ্গিত দিলেন। কিন্তু দেশবাসী বিস্মিত হয়ে দেখলো এতসব সরকারি বিপ্লবী আচরণের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের মান ভাঙানোর জন্য তদ্বির চালিয়ে যেতে থাকলো সরকারি শক্তি। আরো একটি অদ্ভুত বিষয় যুক্ত হলো। এখন যেমন সরকারের ঘোরতর অসঙ্গতির সমালোচনা করলেই বলা হয় ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ বানচাল করার জন্য এসব অপতত্পরতা, একইভাবে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের পিছিয়ে আসাকে বলা হতে লাগলো নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের বৈরি প্রভাবের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক নামি-দামি কলাম লেখকের লেখনিতে তা প্রমাণ করারও চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনো বিপ্লবী আচরণ করেও দাঁড়াতে পারছিল না সরকার। ফাঁদে পড়ে চুরি না করেও সরকার চুরির দায় স্বীকার করতে থাকলো। একে একে মানতে থাকলো বিশ্বব্যাংকের শর্ত। কিন্তু নৈতিকভাবে খুব গর্হিত মনে হলো যখন একজন সত্, দেশপ্রেমিক মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেনকে বিশ্বব্যাংকের চাপে দুর্নীতিবাজ তকমা কপালে সেঁটে পদত্যাগ করানো হলো। এই অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের নৈতিক, প্রশাসনিক এবং পররাষ্ট্রীয় অবস্থানের দীনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উন্মোচিত হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে সরকারি অবস্থানকে এখন মানুষ সন্দেহের চোখে দেখছে। এত কিছুর পরও এখন পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়ার জন্য মরিয়া সরকার। বিশ্বব্যাংকের শেষ শর্ত পূরণের জন্য এখন অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের পদত্যাগের কথা উঠেছে। ড. রহমান সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করেছেন কোনো ধরনের দুর্নীতির সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। দুর্নীতির দায়ে তাকে পদত্যাগ করতে হলে আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবিও তিনি করেছেন। হিসেবমতো জাইকা এডিবির সাথে নবায়নকৃত চুক্তির মেয়াদ ৩১ আগস্টের মধ্যে শেষ হচ্ছে। বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে হলে এই কয়টিদিনের মধ্যেই সংকট নিরসন করতে হবে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই এক মাস ঝুলিয়ে রাখার পর শেষ পর্যন্ত জনাব আবুল হোসেনের পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়ার গেজেট প্রকাশ করতে হলো। ড. রহমানের পদত্যাগ ছাড়া বিশ্বব্যাংককে টলানো যাবে না বিবেচনা করলে এবং অন্তিম সময়ে তেমন আশ্বাস পেলে অর্থ উপদেষ্টাকেও হয়তো ‘বলি’ হতে হবে। আত্ম অহংকারী দেশপ্রেমিক মানুষের এখানেই প্রশ্ন থাকবে দেশের সম্মান বিকিয়ে দেয়ার বিনিময়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণে পদ্মা সেতু করা জরুরি কিনা। যদি সত্যিই সরকারের ভেতরে দুর্নীতিবাজদের অবস্থান থাকে এবং পদ্মা সেতু প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, উপদেষ্টা বা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি চিহ্নিত হয় তাহলে ভিন্ন প্রশ্ন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা সরকারযন্ত্রের জন্য গর্হিত হবে এদের রক্ষার চেষ্টা করা। কিন্তু যদি তারা সত্ ও নিরপরাধী হন তবে বিশ্বব্যাংকের অন্যায় দাবি মানার প্রয়োজনে তাদের কলঙ্কিত করা মুক্তিযুদ্ধস্নাত জাতির মাথা বিশ্ববাসীর সামনে হেঁট করে দেয়ার শামিল হবে। অন্যায় লজ্জার তিলক পরার চেয়ে বিশ্বব্যাংকের টাকায় পদ্মা সেতু না বানানো অনেক সম্মানের। সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশের সামর্থ্যে পদ্মা সেতু বানানোতে আমরা মনোসংযোগ করবো না কেন? আমরা টেলিভিশনে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে লন্ডন প্রবাসীরা চারটি সেতুর টাকা দেয়া কোনো বিষয় নয় বলে জানিয়েছেন। আপাতত না হয় তাদের কাছ থেকে একটি সেতুর টাকা এনে সেতু বানিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ পশ্চিমা বিশ্বের থোতা মুখ ভোঁতা করে দেই না কেন! নানা নাটকীয়তার পরও বিশ্বব্যাংকের মনোরঞ্জনের জন্য ছোটাছুটি এবং একের পর এক বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানার মধ্য দিয়ে সরকার একদিকে দুর্নীতির অভিযোগ কবুল করে নিজেদের মিথ্যে আস্ফাালনকে মেনে নিচ্ছে আর অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অপরিহার্যতার কথাও নিশ্চিত করছে। তাহলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংককে এত বকাঝকা কেন? বিশ্বব্যাংককেই উল্টো অনিয়ম আর অন্যায়ের আখড়া বলার মতো মাঠ গরমের বক্তৃতা করা কেন! নাকি এসবও আমাদের রাজনীতিকদের মতো প্রচলিত ভাষ্য যে ‘...আমাদের এসব কথা আমলে নেবেন না, কারণ এসব হচ্ছে রাজনৈতিক বক্তব্য’। দেশের বোকাসোকা মানুষের মধ্যে ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ দেয়ার আনন্দ থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিত্তি না থাকলে এসব কথা গৃহীত হবে না। নিজ অর্থায়নে সেতু বানানোর সামর্থ্য যদি না থাকে তাহলে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজদের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামানো হলো কেন? এতে এসব লাঠিয়াল কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা কি আওয়ামী নীতিনির্ধারকদের অজানা ছিল? অমন বালখিল্যতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক তরুণের জীবন পর্যন্ত গেল। এই মৃত্যুর দায় কে নেবে?
গত ২৭ আগস্ট রাতে টেলিভিশনে মাননীয় অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের যেভাবে এড়ালেন তাতে সন্দেহ হয় সম্ভবত এত করেও বিশ্বব্যাংককে ম্যানেজ করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত যদি বিশ্বব্যাংক এগিয়ে না আসে তাহলে হয়তো এযাত্রায় ড. মশিউর রহমান টিকে গেলেন। অন্যদিকে সরকারি আফসোস থেকে যাবে আবুল হোসেনের জন্য। অবশ্য অগাধ ক্ষমতাশালী সরকার তার জন্য একটা নতুন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে ফেলবে। কারণ সামনে নির্বাচন। এখন আবুল হোসেনদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
আমরা বিশ্বাস করি যে দলই সরকার গঠন করুক দেশের সম্মান রক্ষা ও দেশবাসীর ভাগ্যনিয়ন্তা সে দলের ক্ষমতাবানদেরই হতে হয়। ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে জনগণের দলে পরিণত না হতে পারলে এই দায়িত্ব কারো পক্ষেই পালন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার গঠন করে কোনো দলই ঘোরতর দলীয় সরকার হওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি। ক্ষমতায় নিজেদের বর্তমান অবস্থান নিষ্কণ্টক করা ও ভবিষ্যতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করার জন্য মূর্খ বলে বিবেচিত সাধারণ মানুষকে নানা আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েছে। হাজার বছর ধরে উজ্জ্বল ঐতিহ্য ধারণ করা এদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের অহংকারী মানুষের গর্বিত মাথাকে বিশ্ববাসীর সামনে হেঁট করার দায় নিশ্চয়ই রাজনৈতিক কূপমণ্ডূকতায় বিবর্ণ রাজনীতিকদেরই বহন করতে হবে। আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে, যদি আপনাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিটে-ফোঁটা সামান্য অবশিষ্ট থাকে তবে দেশের জন্য ক্ষতিকর সব বেফাস কথা আর অমন নীতিনির্ধারণ থেকে বেরিয়ে আসুন। দেশের সম্মানের চেয়ে অন্য কিছু বড় নয়। আত্মমর্যাদা রক্ষা করে পদ্মা সেতু আজ তৈরি করা গেলে খুব ভালো; অভিন্ন কারণে যদি কাল করতে হয় তাতেও কিছুমাত্র আফসোস হবে না এ জাতির। আমরা প্রত্যাশা করবো এই বর্ষায় পদ্মার ঢেউ ক্ষমতাবানদের অপরিণত অমার্জিত নানা চিন্তা ভাসিয়ে নেবে।
n লেখক:অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com