বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অভিন্ন। তাঁর জন্মই হয়েছিল তিনি এই দেশটাকে স্বাধীন করবেন বলে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সমস্তটা জীবন একটা চেষ্টাই করেছেন, একটাই ছিল তাঁর জীবনের সাধনা—বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলার মানুষের মুক্তি।
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হয়েই গেল, শেখ মুজিব কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা ছাত্রাবাসে জড়ো হওয়া ছাত্রকর্মীদের উদ্দেশে বললেন, এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা নয়। আমাদের যেতে হবে পূর্ব বাংলায়, নতুন করে শুরু করতে হবে সংগ্রাম।
শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান কথাটাও বলতে চাইতেন না। তিনি একে ডাকতেন পূর্ব বাংলা বলে, তারপর বলতেন বাংলাদেশ। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে “পূর্ব পাকিস্তান” নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে আপনারা এটাকে বাংলা বলে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য।’
অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবকে প্রশ্ন করি, বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’
‘শুনবেন?’ তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে।’
শেখ মুজিব এবং অন্যরা সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন, ১৯৪৮ সালে বড় ভাষা আন্দোলন হয়, মুজিব গ্রেপ্তার হন। এরপর তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। গোয়েন্দারা তাঁর কাছে কারাগারে গেছে, বলেছে, বন্ডসই দিয়ে মুক্তি নিন। তিনি বলেছেন, বন্ডসই দিয়ে মুক্তি তিনি নেবেন না। সেই সব গোয়েন্দা রিপোর্ট এখন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, এই বন্দীর মনোবল খুবই কঠোর। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফরিদপুর কারাগারে যখন তিনি অনশন করেন, তখন তাঁর হার্টে অসুখ। ওজন দ্রুত কমে আসছে। তিনি বুঝতে পারছেন তিনি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন। তখনো তিনি ভেবেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মরার মধ্যেও শান্তি আছে, গৌরব আছে। এতবার তিনি জেলে গেছেন যে, তাঁর সন্তান কামাল তাঁকে ছোটবেলায় দেখেছে খুব কম। তাই তো সে তার বড় বোন শেখ হাসিনাকে বলেছিল, খুব ছোটবেলায়—‘আপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকি?’ শেখ মুজিব তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন ও আর সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই, তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ রকম কতগুলো উপলব্ধির কথা লিখেছেন, যা আমাদের চিরকাল পথ দেখাতে পারে। ওই বই পড়ি, আর ভাবি, বঙ্গবন্ধু কী বলেছিলেন, আর তার অনুসারীরা কী করছেন?
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব নেতাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তখন মুজিব একবার করাচিতে গিয়ে খাজা নাজিমউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’ এই উপলব্ধি ১৯৫২ সালের, যখন শেখ মুজিবের বয়স মাত্র ৩২। ৩২ বছরে মুজিব যা উপলব্ধি করেছেন, আমরা কবে তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারব?
শেখ মুজিব একবার আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। কলকাতায় আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ছাপাখানা ছিল, যেটা মুজিবেরা চাঁদা তুলে গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪৭-এ হাশিম সাহেব সেই ছাপাখানা বিক্রি করে দেবেন। সবাই মুজিবকে ধরল, ‘তুমি গিয়ে বলো, তাহলে তিনি আর প্রেস বিক্রি করবেন না।’ সবার অনুরোধে মুজিব আবুল হাশিম সাহেবকে কঠোর ভাষায় বলে এলেন, ‘প্রেস বিক্রি করতে গেলে আমি বাধা দেব, দেখি কে আসে এই মিল্লাত প্রেস কিনতে?’ আবুল হাশিম সাহেব দুঃখ পেয়েছিলেন। তিনি খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করেছিলেন। মুজিব তাঁর কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। মুজিব তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি যাওয়াতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। তাঁর সাথে ভিন্নমত হতে পারি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটা তো ভোলা কষ্টকর। আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, সেটা স্বীকার করতে কোনো দিন কষ্ট হয় নাই। ভুল হলে সংশোধন করে নেব, মানুষেরই তো ভুল হয়ে থাকে।’ এই কথাটা শেখ মুজিব বলেই বলতে পারেন। আর আমরা দেখি, আজকের নেতা-নেত্রীরা কোনো কিছু ভুল করেন না। কোনো ভুল তাই তাঁদের স্বীকারও করতে হয় না। কোনো ভুলের সংশোধনীও তাঁদের করতে হয় না।
অসাধারণ একটা পর্যবেক্ষণ মুজিব করেছেন আমাদের সম্পর্কে। ‘পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে আছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষায়ই পাওয়া যাবে না “পরশ্রীকাতরতা”। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে “পরশ্রীকাতর” বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না।’
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকের কথা। লীগ মন্ত্রিসভা তখন অবিভক্ত বাংলায়। এমএলএ কেনাবেচা হচ্ছে। তরুণ মুসলিম লীগ কর্মী মুজিবের ওপর দায়িত্ব পড়ল এমএলএদের পাহারা দিয়ে রাখা, যাতে তাঁরা টাকা নিয়ে মত পাল্টাতে না পারেন। মুজিব তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি! আমার মনে আছে, আমাদের ওপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দলত্যাগ করে অন্য দলে যেতে না পারে। ...একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বার বার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।” আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনেও ভোট দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের!’
হায় বঙ্গবন্ধু মুজিব, আপনি যদি জানতেন, এমএলএরা চিরটাকালই টাকা নিয়েছে! এখন এমন এমপিও আছেন, খবরের কাগজে পড়েছি, যিনি এলাকার বেকার যুবকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন একই পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য, টাকা নিয়েছেন, কিন্তু চাকরিও দেননি।
আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতা বইয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ নামের একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। একজন ইংরেজ বিচারককে একজন ভারতীয় বলেছিল, দুর্নীতিবাজ অফিসার দুই রকমের। একদল আছে, ঘুষ খেয়ে কাজ করে। আরেক দল আছে শুয়োরের বাচ্চা। তারা ঘুষ নেয়, কিন্তু কাজ করে না।
থাক, আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে যখন অনশন করেন, তখন তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দেন মহিউদ্দিন আহমদ। মহিউদ্দিন ছিলেন মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের ঘোরতর বিরোধী, অর্থাৎ মুজিবদের বিরোধী পক্ষের। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সামপ্রদায়িক দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর। কাজেই মুজিবভক্ত নেতা-কর্মীরা কেউ চায়নি, মহিউদ্দিন ও মুজিব একসঙ্গে অনশন করুন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’
এইভাবে মুজিব অনেক শত্রুকে তাঁর মিত্রে পরিণত করেছিলেন। এটাই তো রাজনৈতিক কৌশল। আমার শত্রুকে আমি বন্ধুতে পরিণত করব, অন্তত তাকে নিরপেক্ষ বানিয়ে ছাড়ব, বন্ধুকে করে তুলব আরও বন্ধু। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে কী দেখছি আমরা? নিরপেক্ষকে শত্রুতে পরিণত করা হচ্ছে, বন্ধুকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অকারণ শত্রুতা অকারণ পরশ্রীকাতরতা আমাদের বহু সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একবার এক সভায় মওলানা ভাসানীকে সভাপতিত্ব করতে না বলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে সভাপতিত্ব করতে বলা হয়। ভাসানী রাগ করেন। খাওয়া বন্ধ করে দেন। শেখ মুজিব তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘মাওলানা ভাসানীর উদারতার অভাব, তবুও তাঁকে আমি শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। কারণ, তিনি জনগণের জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত। যে কোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই--আমার বিশ্বাস।’
বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। বারবার মৃত্যু তাঁর সামনে এসেছে, তিনি ভয় পান নাই, এটা তাঁর মুখের কথা নয়, অন্তরের কথা। একাত্তরে পাকিস্তানের জেলে তাঁর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হলে তিনি যা বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরও বলেছি, তোমরা (আমাকে) মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’
নিজের জীবনটা দান করে দিয়ে শেখ মুজিব তাঁর কথা রেখেছেন। তাঁর অনুসারীরা কে কী ত্যাগ করছেন, আর কী কী অর্জন করছেন, কয়টা প্লট নিলেন, কত বড় গাড়িতে চড়েন, সেই খবর নিতে গেলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে নাকি?
সবাই নিশ্চয়ই এক রকম নয়। এই দেশে ত্যাগী মানুষ, ত্যাগী নেতা নিশ্চয়ই আছেন। তা না হলে মুজিবের এই বাংলায় সূর্য কেন আজও ওঠে, কেন আজও বৃষ্টি হয়, ফুল ফোটে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.