জাতীয় নবজাগৃতি এবং বঙ্গবন্ধু
হারুন হাবীব
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তির পর অল্পদিনেই প্রমাণিত হয়, এই বিভক্তি শুধুই পতাকা পরিবর্তনের। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি এই বিভক্তি। বরং এক উপনিবেশবাদ বিদায় হওয়ার পর জেঁকে বসেছে আরেক উপনিবেশবাদ। কিন্তু লড়াকু বাঙালি মর্যাদার সংগ্রাম থেকে কখনো পিছপা হয়নি। তারা অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ছাত্রসমাজের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের বাংলাভাষী গণমানুষের এই মনোজাগতিক জাগরণ দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করে।
কিন্তু ধর্ম ও সেনাকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকরা সত্তরের নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায়কে নির্লজ্জভাবে অস্বীকার করে। তারা নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার আগে ২৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মার্চ মাসটি সে কারণে আমাদের ইতিহাসের অগ্নিঝরা অমলিন অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পর্যন্ত গোটা জাতি ছিল অগ্নিগর্ভ, ঐক্যবদ্ধ ও অপ্রতিরোধ্য। একদিকে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অন্যদিকে সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত মানুষের বজ্রকঠিন শপথ। স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালি এক ও একাত্ম।
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে ছাত্র-জনতা উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ৭ই মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ইতিহাসখ্যাত ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন, জাতিকে সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে বাঙালির ৯ মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধ, যা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
অন্যান্য দেশের মতোই জাতীয় স্বাধীনতার এই যুদ্ধ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবলই ইতিহাসচর্চার বিষয় হতে পারত; কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় তা হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে, ইতিহাসের চাকাকে তারা ভিন্ন পথে চালনা করার ষড়যন্ত্র করেছে। বলা বাহুল্য, ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পালাবদলের পর থেকে পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছে। সেনা ও আধাসামরিক শাসনের ছত্রচ্ছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির ওপর খৰ নেমে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, তারা নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে।
কিন্তু সুখের খবর হচ্ছে এই যে এত কিছুর পরও প্রতিরোধশূন্য হয়নি বাংলাদেশ। হৃত জাতীয় গৌরব পুনরুদ্ধারের আন্দোলন বিফলে যায়নি। বাঙালি বহুলাংশেই সফল হয়েছে। আক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধ আবারও বলদর্পী চেতনায় ফিরে এসেছে। ব্যাপক মনোজাগতিক বিবর্তন ঘটেছে তারুণ্যের মধ্যে। এ পরিবর্তন বা বিবর্তন নতুন আশা জাগিয়েছে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক শক্তি মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি সফল পাল্টা অভিযান সম্পন্ন করেছিল। দুই দশকব্যাপী বিজাতীয় এই আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে কুচক্রীরা নতুন প্রজন্মের তাৎপর্যময় একটি অংশকে কেবল বিভ্রান্তই করেনি, একই সঙ্গে তারা সীমিত আকারে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে নতুন করে পাকিস্তানি মনোভাবের প্রবর্তন করতেও সক্ষম হয়েছিল। বলতেই হবে, এ প্রবর্তন যেমন দুর্ভাগ্যজনক, তেমনি আতঙ্কজনকও।
এসব কারণে বাংলাদেশের বেলায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি কেবল ইতিহাসচর্চায়ই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এর চর্চা নতুন জাতীয় প্রতিরোধ যুদ্ধের অংশীদার হতে যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছে। ফলে ১৯৭১ সালের চেতনা ও ইতিহাসকে কেন্দ্র করে নতুন প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধপন্থী সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে। আমাদের সৌভাগ্য যে পঁচাত্তর-পরবর্তী এই প্রতিরোধ যুদ্ধটি দীর্ঘ হলেও আজ তা এমন একটি পর্যায়ে উপনীত যে একে আর পেছনে টানার সুযোগ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের আত্মাকে অবমাননা করে, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে আর কখনোই কোনো রাষ্ট্রশক্তি স্থায়িত্ব লাভ করতে পারবে না। কখনো যদি সে চেষ্টা ঘটে, আমি বলতে বাধ্য, সেই বিজাতীয় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাবল্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্রতর হতে বাধ্য।
বর্তমান সময়টিকে আমি আমাদের জাতীয় নবজাগৃতির কাল হিসেবে বিবেচনা করি। এর প্রথম কারণটি হচ্ছে, ৩৪ বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এ বিচার সংগত কারণেই জাতীয় ও বিশ্ব ইতিহাসে অনন্যসাধারণ। দ্বিতীয়টি, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে স্থানীয়রা বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হয়ে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম অপরাধ করেছিল, লাখো মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানি করেছিল, নির্বিচারে ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছিল, অকথ্য নির্যাতন, অপহরণ এবং এক কোটি মানুষকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল- মানবতাবিরোধী সেই অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কোনো ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাকিস্তানি সেনাতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের লাগাতার নিপীড়ন, সেই সঙ্গে সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের উদগ্র দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিপীড়িত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যেকোনো নাগরিকই মনে করতে বাধ্য হবেন যে ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত পালাবদলের পর গণতন্ত্র ও সুশাসনের বদলে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিবর্জিত দুঃসহ একটি সময়, যা সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় রত থেকেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক ও আধাসামরিক শাসকরা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে অস্বীকার করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি নগ্ন অশ্রদ্ধা দেখিয়েছে, বাঙালির যা কিছু অর্জন, যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গল, তাকেই এরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। কাজেই সত্যসন্ধানী নতুন প্রজন্মকে একই সঙ্গে ঘৃণা করতে হবে পঁচাত্তরের খুনিদের সঙ্গে তাদের দোসরদেরও, যারা খুনিদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিল, তাদের রক্ষা করেছিল এবং পুনর্বাসন করেছিল।
আমরা যখন স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি, তখন স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু-মিত্রের চেহারাগুলো ভেসে ওঠে। বিশেষ করে ভেসে ওঠে সেই সব ঘাতক, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীর মুখ, যারা ধর্মের নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে নির্বিচার গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অপহরণ ও অগ্নিসংযোগ করে নিজেদের ঘৃণ্য অপকর্মের স্বাক্ষর রেখেছিল।
এসব ঘৃণ্য অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা মানবসভ্যতা রক্ষা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে জরুরি। মুক্তিযুুদ্ধের অগণিত শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতে, মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গ করতে এসব অপরাধীর বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের একটি বড় কলঙ্ক মোচন হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করে। জাতির ললাট থেকে আরেকটি বড় কলঙ্কচিহ্ন মোচন হবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের এই অমোঘ দাবি থেকে সরে যাওয়ার কোনোই সুযোগ নেই।
২৫ মার্চ ২০১০ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। দৃশ্যতই দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা যেকোনো মূল্যে এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ বা বিঘি্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এও দেখা যাচ্ছে যে একাত্তরের ঘাতক ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকলেও চেতনার কোনোই অমিল নেই।
আমি বিশ্বাস করি, সংকট বা সীমাবদ্ধতা যতই থাক না কেন, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠিত হবে, চিহ্নিত মানবতাবিরোধীরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। কারণ এই বিচার সেনা ও ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তানের উদর থেকে জন্মলাভ করা জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, বাঙালির জাতীয় মর্যাদা ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এ বিচার সম্পন্ন হলে লাখো শহীদের আত্মা শান্তি লাভ করবে, বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হবে এবং মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধীরা একদিন না একদিন যে তাদের দুষ্কর্মের শাস্তি পাবে, সেই চিরন্তন সত্যটাই আবারও প্রতিষ্ঠিত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবলই ইতিহাস নন, তিনি আমাদের জাগরূক অবিনাশী জাতীয় সত্তা। বাঙালির স্বাধিকার জাগরণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা তিনি। পঁচাত্তরে তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরও তিনি যেমন আমাদের অনুপ্রেরণা ও শক্তি, তেমনি তাঁর মৃত্যুর বহুকাল পরও তিনি এই অধুনা নবজাগৃতির মূল কাণ্ডারি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.