মুক্তিযুদ্ধের জয়রথের মাইলফলক
মুহম্মদ সবুর
সারা বাংলা তখন জেলখানা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দখল করে নিয়েছে বাংলার সীমান্ত অঞ্চলগুলো। প্রতিদিন চলছে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা, ঘরবাড়ি-দোকানপাটে অগি্নকাণ্ড, লুটপাট, ধর্ষণ, অপহরণ। বীভৎসতার ভেতর অবরুদ্ধ বাংলার সাত কোটি মানুষ। অর্ধকোটি শরণার্থী দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র, রসদ সরবরাহ নেই তেমন। শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য নেই ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও যথাযথ প্রশিক্ষণ। সাহায্যকারী এবং আশ্রয়দাতা দেশ ভারতও তখন প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র জোগানে দ্বিধাগ্রস্ত। তাদের সৈন্যরাও প্রত্যক্ষ সমরে তখনো দাঁড়ায়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত তখন সঙ্গীহীন। তাই তাকে নিতে হচ্ছে সতর্ক পদক্ষেপ। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান তবুও ভারত অব্যাহত রাখে। তাদের সেনাবাহিনী এই প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। জুলাই মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা বড় ধরনের হামলা চালাতে পারেনি। তবে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের হানাদার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে আঁতাত করে। গোপনে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার চীন সফর করেন জুলাই মাসে। চীন-মার্কিন আঁতাতে ভারত এবং বাংলাদেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যাকে শুধু সমর্থন নয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ দিয়ে সাহায্য করে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে এক অস্থির সংকটময় পরিস্থিতি। একদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান ত্রিশক্তি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান থেকে ভারতবিরোধিতায়। আর ভারত তখন বাংলাদেশের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠ সর্বার্থে। এ পরিস্থিতিতে সম্পাদিত হলো ভারত-সোভিয়েত ১৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি। ভারত ও বাংলার মুক্তিকামী জনগণ বুঝল, এই মৈত্রী চুক্তি সম্ভাব্য মার্কিন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য। এই চুক্তির পর পরই বাঙালি যোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায়। গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দূর হয়ে আসে। প্রবাসী সরকার সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে। চুক্তিতে প্রতিরক্ষা বিষয়ে একটি ধারা রাখা হয়। চুক্তির ৯ নম্বর ধারায় 'যেকোনো সংঘর্ষে এবং বাইরের শত্রুর হুমকি ও আক্রমণের সময় পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসার' প্রতিশ্রুতি রাখা হয়। এই যৌথ চুক্তি ভারতের জনগণ এবং ভারত সরকারের মনোবলও যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। এই চুক্তি তখন প্রমাণ করে, বিশ্ব অঙ্গনে ভারত আর একা নয়। তারা আশ্বস্ত হয়, বাংলাদেশ প্রশ্নে এবং শরণার্থীসহ এ সমস্যা সম্পর্কে ভারতের যেকোনো যৌক্তিক পদক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন লাভ করবে। বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত একা নয়। বরং বৃহৎ শক্তি তার পাশে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই চুক্তির আগে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় খুব সতর্ক এবং হিসেবি পদক্ষেপ নিয়েই এগোচ্ছিলেন। চুক্তি সইয়ের ফলে ইন্দিরা আরো বলিষ্ঠ এবং সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার পদক্ষেপ নেন। ভরসা তখন, এই সহায়তা দানে যদি ভারতের সংহতি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় কিংবা তাতে কোনো আক্রমণের সম্মুখীন হয়, তাহলে ভারতের সহায়তায় সরাসরি, প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মুক্তিযুদ্ধে এই চুক্তির প্রভাব সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশ_উভয় দেশের সরকার এবং জনগণের মধ্যে সাহস ও উদ্দীপনা সঞ্চারিত হলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এক নতুন উৎসাহ, শক্তি-সাহস ও অনুপ্রেরণা। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অনেকাংশে বেড়ে গেল। এই প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ নিউটনের আপেলের মতো যোদ্ধাদের পক্ষেই গড়িয়ে পড়ছে।
ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুন মোড় এনে দিয়েছিল। 'গণচীনের বিরুদ্ধে ভারত তার নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে'_এমনটা বিবেচনা করার পর ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সামরিক বাহিনীকে পরোক্ষ অবস্থান থেকে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন। 'নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপেক্ষা করে কোনো সরকারই সামরিক তৎপরতা পরিচালিত করতে পারে না'_ইন্দিরা গান্ধীর উপলব্ধিতে এটা ছিল। সেদিক থেকে পাকিস্তানের পক্ষে গণচীনের প্রত্যক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ হুমকি নিষ্ক্রিয় করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তিটি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এই চুক্তির সামরিক অংশ সংযোজনের পর ভারতের দৃঢ় অবস্থান অনেকটাই নিশ্চিত হয়। এরই প্রতিফলনে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ভারতীয় বাহিনী দূরপাল্লার ভারী কামান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অপারেশনেও নামে। ইন্দিরা গান্ধীর জানা ছিল, পাকিস্তানের পক্ষে এককভাবে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অবশ্য পাকিস্তান-চীন সম্মিলিত সামরিক তৎপরতা ভারতের জন্য যে বিপজ্জনক, সেই উপলব্ধি ইন্দিরা ১৯৭১ সালের জুনেই করেছিলেন। তবে চুক্তির পর ইন্দিরা নিশ্চিত হন, পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সরাসরি সামরিক তৎপরতা চালানো সম্ভব নয়। আর সেপ্টেম্বরে তো খোদ চীনের ক্ষমতা দখল নিয়ে মাওবাদীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব তুঙ্গে।
কোসিগিন ও ইন্দিরার পক্ষে সম্পাদিত মৈত্রী এবং সহায়তা চুক্তির ফলে বাংলাদেশের বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধারাও দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারও মার্কিন-চীন আঁতাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিল। এই দুই দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে তখনো সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন দিতে থাকে। বাংলাদেশ এ অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমর্থন লাভের জন্য সরাসরি প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু আশানুরূপভাবে ফলপ্রসূ হয়ে উঠছিল না। আর সোভিয়েত সমর্থনও ভারতের মাধ্যম ছাড়া পাওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। সেই সময় এই মৈত্রী চুক্তি যেন বাংলাদেশকে চীন-মার্কিন-পাকিস্তান_এই ত্রিশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে আরো দৃঢ় করে। মুক্তিযোদ্ধারা 'জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য' পদক্ষেপে শত্রু হননে মত্ত হয়। মার্কিন ও চীন মিলে বাংলাদেশের বিষয়টিকে মার্কিন বনাম রাশিয়ার মধ্যে একটি প্রতিযোগিতায় দাঁড় করিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি আঞ্চলিক সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করেছিল। যদিও নিঙ্ন বাংলাদেশের সমস্যাটিকে দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করার জন্য স্মৃতিকথায় বলেছেন। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এই চুক্তিকে একটি 'বম্বশেল' হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি নিশ্চিত করেন, ভারত এবার পাকিস্তান আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কিসিঞ্জার এর আগে সব সময় দাবি করে এসেছেন, ভারত পাকিস্তানকে গ্রাস করতে বদ্ধপরিকর। নিদেনপক্ষে 'আজাদ কাশ্মীর' দখলে নিতে সে দৃঢ়। কিন্তু মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞরা কিসিঞ্জারের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁদের ভাষ্য, এই চুক্তি মোটেই কোনো 'বম্বশেল' নয়। এ ধরনের একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে, এ কথা এক বছর আগে থেকেই সবার জানা ছিল। চুক্তি সইয়ের পরও এ নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট কোনো বাড়তি উত্তেজনা দেখায়নি। তাদের দৃষ্টিতে অবশ্য চুক্তিটি ইন্দিরা গান্ধীর জন্য অবশ্যই একটি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিজয় ছিল। সেই সময়কার বাস্তবতায় দেখা যায়, অভ্যন্তরীণভাবে এই চুক্তির ফলে দেশের ভেতর ইন্দিরা তাঁর অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে চীন এবং আমেরিকা তার পক্ষাবলম্বন করবে_এমন একটা আশঙ্কা ভারতের মতো বাংলাদেশের জনগণেরও অনেকের মধ্যেই ছিল। এই চুক্তির ফলে সেই ভয় দূর এবং যোদ্ধা ও জনগণের মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হয়েছিল। স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিল থেকে দেখা যায়, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আঁতাতের যে গোপন তৎপরতা চলছিল, ভারতের অগোচরে পাকিস্তানের হাত ধরে সেই পথে এগোনোর ফলে কিসিঞ্জার ও নিঙ্ন ভারতকে জোর করেই সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
১৯৬৯ সাল থেকে যে প্রক্রিয়া ইয়াহিয়ার মাধ্যমে নিঙ্ন-কিসিঞ্জার চালিয়ে আসছিলেন চীন-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে, সেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁদের জন্য যেন চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাসে নাম লেখানোর জন্য নিঙ্ন-কিসিঞ্জার ২৫ মার্চের ইয়াহিয়ার গণহত্যাসহ বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার নারকীয় বীভৎস অপকর্মকে সমর্থন দিতে থাকেন। ঢাকা ও দিলি্লর মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে প্রতিদিন গণহত্যা ও ধর্ষণসহ পাকিস্তানি বাহিনীর অপকর্মের ওপর প্রতিবেদন হোয়াইট হাউসে পাঠালেও নিঙ্ন-কিসিঞ্জার তা গ্রাহ্য না করে ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিতে থাকেন। অথচ পাকিস্তানি বাহিনী মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল। সামরিক সন্ত্রাসকে নিঙ্ন-কিসিঞ্জার শেষ পর্যন্ত সমর্থন করেছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়ে রাশিয়া ও পোল্যান্ড ছাড়া আর কোনো দেশকে সেই সময় পায়নি ভারত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আসে। আর প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে রাশিয়া দুই দফা ভোট দেয়। পরে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি এলে এর পক্ষে ছিল ১০৪টি দেশ আর বিপক্ষে ছিল মাত্র ১১টি দেশ। ভারত ও রাশিয়া তখন প্রায় একা। ভুটান ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ তখন ভারতকে সমর্থন জানায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে হুমকি দেওয়ার যে চেষ্টা করে, তাও অসার মাত্র। সেই নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পেঁৗছার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। নিঙ্ন ও কিসিঞ্জার পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন_চীনের সঙ্গে আঁতাত সেই সময় আমেরিকার জন্য সবচেয়ে প্রধান স্বার্থ ছিল।
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের কাছে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে মৃদু আপত্তি জানায়। তার পরই 'মস্কো-দিলি্ল প্রতিরক্ষা চুক্তি'র আলোচনা সামনে আসে। সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল গ্রোচকো চুক্তির যে খসড়া করেন, তাতে ১৯৭১ সালে এসে প্রতিরক্ষা ধারাটি সংযোজন করা হয়। ১৯৭০ সালের মার্চ মাস থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ২৮ মার্চ এক বার্তায় ইয়াহিয়া খানকে ঢাকায় রক্তপাত বন্ধ করার আহ্বান জানান। ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নিও সাধারণ মানুষের ওপর সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বার্তা পাঠান। এরপর ১৭ এপ্রিল আরো একটি বার্তা পাঠান কোসিগিন। বার্তায় উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। অবশ্য রাশিয়া চায়নি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে পাকিস্তানের অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে প্রভাব ও শক্তি বৃদ্ধি করুক। বাংলাদেশে গণহত্যা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলা ইত্যাকার ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ নীতি বজায় রেখে চলছিল। কিন্তু জুলাই মাসে চীন-যুক্তরাষ্ট্র আঁতাত সোভিয়েতকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এর পরই সোভিয়েত-ভারত চুক্তি সই হয়। পাকিস্তানিরা অবশ্য এই চুক্তিতে তেমন উদ্বিগ্ন হয়নি। তারা ধরে নিয়েছিল, এই চুক্তি পাকিস্তানবিরোধিতার চেয়ে অধিকতর চীনবিরোধী। আবার এই চুক্তির কোনো খবর চীনের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি। চুক্তি সইয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী ২৭ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফরে মস্কো যান এবং পরিস্থিতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাজি করান। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশও বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করে। জাতিসংঘে পোল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে প্রস্তাবও এনেছিল।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে এখন আর কিছু নেই। প্রায় সব ইউনিয়নই স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আছে ভারত এবং বাংলাদেশ। আর আছে ইতিহাস। সোভিয়েত-ভারত চুক্তিও সেই ১৯৮৬ থেকে নেই। তবু এর গুরুত্ব রয়েছে। কারণ তা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রেখেছিল। আর বাঙালি পেয়েছিল রক্তস্নাত স্বাধীনতা।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.