লেখক: ওয়াজিফা খান | বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২, ১২ আশ্বিন ১৪১৯
প্রায় এক যুগ পর নেতৃত্ব পরিবর্তনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আগামী মাসের শেষের দিকে দল ও সরকারের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এ জন্য যতটুকু সম্ভব, তার চেয়েও বেশি সম্প্রীতিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সামাজিক আবহ তৈরির চেষ্টা করছে সরকার। চীনের একমাত্র রাজনৈতিক দল যখন এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত অতিক্রম করছে, ঠিক সেই সময় পুরনো এক শত্রুর সঙ্গে ফের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে দেশটির। কয়েকটি দ্বীপের মালিকানা-সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে চীনের জনগণের মধ্যে জাপান-বিরোধী চেতনা হঠাত্ করেই তীব্র আলোড়ন তৈরি করেছে। ছোট-বড়—সব ধরনের শহরে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—জাতীয়তাবাদী এই চেতনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি তৈরির পাশপাশি কমিউনিস্ট পার্টির জন্যও চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
পূর্ব চীন-সাগরে এক দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়েই গত কয়েক সপ্তাহে চীন-জাপান সম্পর্ক পেছনের দিকে মোড় নিতে শুরু করেছে। পাঁচটি দ্বীপ এবং তিনটি ভাসমান পাথুরে টিলা—এই আটটি ভূ-খণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপপুঞ্জ জাপানে সেনকাকু এবং চীনে দিয়াওউ নামে পরিচিতি। তাইওয়ানি ভাষায় তিয়াওউতাই বলেও ডাকা হয় এটিকে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে দ্বীপগুলো জাপানের নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে চীন এগুলোর মালিকানা দাবি করে। ইতিহাসগতভাবেই এগুলো চীনের অংশ বলে দাবি চীনাদের। তাইওয়ানও দ্বীপগুলোর মালিকানা দাবি করছে।
সম্প্রতি জাপান সরকার সেখানকার ব্যক্তিমালিকানাধীন তিনটি দ্বীপ কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর পরই চীন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। ‘সার্ববৌমত্বের দাবি’ তুলে চীন সরকার বিরোধপূর্ণ জলসীমায় কয়েকটি টহল জাহাজ পাঠায়। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জাপানের উদ্দেশে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে, ‘ভূ-খণ্ডর সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ হলে চীন সরকার বসে বসে তা দেখবে না।’ ‘চীন সাত সার্বভৌম অঞ্চলের এক ইঞ্চি জায়গাও ছেড়ে দেবে না’ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়াবাও। জাপানি প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোদাকে দ্বীপ কেনার ব্যাপারে অগ্রসর না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জাপান সরকারের দ্বীপ কেনার ঘোষণাকে তাইওয়ান ‘চূড়ান্ত বৈরি’ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করে। সেনকাকু বা দিয়াওউ-র জলসীমার খুব কছে এখন ১২টি চীনা ও একটি তাইওয়ানি জাহাজ অবস্থান করছে। অবশ্য তাইওয়ান তাদের জাহাজটিকে সাধারণ মাছ ধরার জাহাজ বলে উল্লেখ করেছে।
এ দিকে দ্বীপ নিয়ে বিরোধ শুরুর পরই চীনের জনগণ জাপান-বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। প্রায় ৮৪টি শহরে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে পচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে। জাপানি কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। রাজধানী বেইজিংয়ের জাপানি দূতাবাসও অবরোধ করার চেষ্টা করে তারা। হামলা ও সহিংসতার আতঙ্কে জাপানি ইলেক্ট্রনিক্স কম্পানি প্যানাসনিক ও ক্যানন চীনে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়। জাপানি নাগরিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে চীনের প্রতি আহ্বান জানায় জাপান সরকার। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করে—তারা জাপানি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং জাপানি নাগরিকদের রক্ষার চেষ্টা করছে এবং চীনা বিক্ষোভকারীদের আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
বাণিজ্যিক সম্পর্কে টানাপোড়েন
ইতিহাসগত কিছু বিরোধ থাকলেও চীন ও জাপানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ গভীর। দেশ দুটি যথক্রমে বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্ অর্থনীতির দেশ। মাত্র দুই বছর আগেই চীনের কাছে দ্বিতীয় বৃহত্ অর্থনীতির অবস্থানটি হারিয়েছে চীন। তবে এখনো চীনই জাপানের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। গতবছর দেশদুটি ৩৪ হাজার ডলারেরও বেশি অর্থের লেনদেন করেছে। তবে দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধে এই অংশীদারিত্ব ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রীত একটি সংবাদ মাধ্যম হুমকি দিয়েছে—দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধের জের ধরে জাপানের ওপর চীন অবরোধ আরোপ করতে পারে। আগামী ২০ বছরেও এর ক্ষতি জাপান পুষিয়ে উঠতে পারবে না। ২০১১ সালের সুনামির পর জাপানের আর্থিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি চীনের অর্থনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিক থেকে চীনের চতুর্থ বড় অংশীদার হলো জাপান। ২০০৩ সাল নাগাদ জাপানই চীনের সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক অংশীদার ছিল। গত জুন নাগাদ চীনে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে জাপানই সবচেয়ে এগিয়ে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে জাপান প্রায় আট হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ চীনে বিনিয়োগ করেছে।
বেকায়দায় কমিউনিস্ট সরকার
চীন সরকার যেকোনো ধরনের গণ-আন্দোলনকেই সন্দেহের চোখে দেখে এবং কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু এবার জাপান-বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি তারা নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। এই সুযোগে জাপান-বিরোধী বিক্ষোভ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র বেইজিং ও শাংহাইতে পরিস্থিতি খুব একটা উত্তাল না হওয়ায় সরকার বেশ স্বস্তি প্রকাশ করছে। কিন্তু এই গণ-আন্দোলন কমিউনিস্ট নেতাদের জন্য বিষফোড়া হয়ে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রায় এক দশক পর আগামী মাসে চীনের সরকার এবং একমাত্র রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসছে। বিভিন্ন পর্যায়ে কমিউনিস্ট সরকারের দুর্নীতি ও দমননীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস নিয়ে জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে, জাপান-বিরোধী আন্দোলনের সুযোগে সরকারের বিরুদ্ধেই তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগভিত্তিক ওয়েবসাইটের ব্যাপক প্রসারের কারণে খুব দ্রুত জনমত গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে দেশটিতে। ওয়েবসাইটগুলোতে প্রায়ই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। চলমান জাপান-বিরোধী বিক্ষোভের সময় রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমগুলোর উসকানিমূলক অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলোতে বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। আঞ্চলিক বিরোধের কারণে জাপানি পণ্য বর্জন করা উচিত কি না—এ ধরনের একটি অনলাইন জরিপের উত্তরদাতাদের অর্ধেকের বেশি (৫০ হাজারেরও বেশি) ‘না’ জবাব দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগজনক অবস্থান
এই মাসের শুরুতে এশিয়া সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আঞ্চলিক বিরোধের ব্যাপারে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আহ্বান জানান। যদিও আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটানোকেই গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। হিলারির মন্তব্যকে ‘রাজনৈতিক ইন্ধন’ হিসেবে বিবেচনা করে চীন। আঞ্চলিক বিরোধে কোনো পক্ষ না নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেয় দেশটি।
গত সপ্তাহে চীন ও জাপানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই প্রথমে টোকিও এবং পরে বেইজিং সফর করেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা। অবনতশীল চীন-জাপান সম্পর্ক উন্নয়নে কূটনৈতিক চেষ্টার আহ্বান জানান তিনি। উভয় পক্ষের ভুল বোঝাবুঝির কারণে সংঘাত তৈরি হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তবে এরই মধ্যে জাপানে নতুন ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জাপানি ও মার্কিন কর্মকর্তারা একমত হন। দুই পক্ষ থেকেই যদিও দাবি করা হয়েছে—চীনকে লক্ষ্য করে নয়, বরং উত্তর কোরিয়ার হুমকি প্রতিরোধের লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। কোনো পক্ষ সমর্থন না করার অঙ্গীকারের পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন গতিবিধি চীনের আক্রোষ বাড়িয়ে দিতে পারে।