Wednesday, September 05, 2012

এবারের তেহরান সম্মেলন (NAM)


ন্যাম

এবারের তেহরান সম্মেলন

ফারুক চৌধুরী | তারিখ: ০৫-০৯-২০১২
‘ন্যাম’ কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নয়। ‘ন্যাম’, অর্থাৎ জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন তার নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই, একটি আন্দোলন। এর কোনো সদর দপ্তর নেই, নেই কোনো সচিবালয়। ন্যামের কোনো মহাসচিব বা কর্মকর্তা নেই যে তিনি বিশ্বময় সফর করে বেড়াবেন; কোথাও সমস্যার আগুন জ্বললে তা নির্বাপিত করতে তাৎক্ষণিকভাবে সচেষ্ট হবেন। ১৯৬১ সালে ন্যাম যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেডে যাত্রা শুরু করল। সেই যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রই এখন বিলুপ্ত। যে দুই পরাশক্তি থেকে নিরপেক্ষ থাকার অভিপ্রায়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার একটি পরাশক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ ভেঙে খান খান। অবশ্য সেই সময়ের পৃথিবীর বর্ণনায় একটি কথা চালু ছিল। তা হলো যে পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নই দুটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। অন্যরাই এই দুই দেশের কারও না কারও পক্ষের! বর্তমান পৃথিবী বহু মেরুর না এক মেরুর (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র), তা নিয়ে পণ্ডিতেরা বিবাদ করতে পারেন, তবে কেউই বলবেন না যে পৃথিবীটি এখন দ্বিমেরুর।
তবু তিন বছর অন্তর ন্যাম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০০৯ সালে তা হয়েছিল মিসরের শারম আল শেখে, এ বছর হলো তেহরানে আর ২০১৫ সালে তা হবে ভেনেজুয়েলায়। ন্যামের কোনো গঠনতন্ত্র নেই, নেই কোনো নির্ধারিত ভোট গ্রহণ পদ্ধতি। সেখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মতৈক্যের মাধ্যমে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নেই কোনো প্রক্রিয়া। আর যেখানে মতৈক্য সম্ভব নয় সেখানে আন্দোলনটি কোনো অবস্থানই গ্রহণ করে না। তবু ন্যামের তাৎপর্য রয়েছে। নইলে প্রতি তিন বছরে ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্মেলনটি কেন অনুষ্ঠিত হবে?
আমার মতে, তেহরান সম্মেলনের প্রধান তাৎপর্য ছিল সম্মেলনটি তেহরানে অনুষ্ঠিত হলো এবং ১২০টি দেশের রাজা, উজির, আমলা তাতে অংশ নিলেন। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর এত বড় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন সে দেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। তাও হলো এমন একটি সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র আর তার তল্পিবাহক ইসরায়েল ইরানকে একঘরে করতে সদা তৎপর রয়েছে। কারণ হচ্ছে এই কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে ইরান বলছে যে তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কেবল পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য। ইরান বলছে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং সেই চুক্তির শর্ত তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। ইমাম খামেনি তো এই সম্মেলনেই বললেন যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা ‘পাপেরই’ শামিল। এদিকে যে দুটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল, ‘নেকড়ে এল, নেকড়ে এল’ বলে হইচই করছে, তারা ভালোভাবেই জানে যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির স্বাক্ষরকারী না হয়েও ইসরায়েলের কাছে একটি সমৃদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার রয়েছে। এক অর্থে তাই তেহরানে ১২০টি রাষ্ট্রের এই সমাগম এই বৈষম্যমূলক বিচারের বিরুদ্ধেই একটি প্রতিবাদ।
ইরান একটি ভদ্র দেশ। ইরানিরা, প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের জাতিসংঘে কড়া সব উক্তি সত্ত্বেও, একটি ভদ্র জাতি। গত বছরের অর্থাৎ ২০১১ সালের মে মাসে ইমাম খোমেনি ত্রাণ ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে আমি ইরান গিয়েছিলাম। প্রত্যক্ষ করেছি যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার দংশন সত্ত্বেও, ইরান সুস্বাদু খাবার, সুদর্শন নারী-পুরুষ, সুশ্যামল পার্ক, সুনিয়ন্ত্রিত স্কয়ার এবং সর্বোপরি হাজার হাজার বছরের সভ্যতার, সুললিত ভাষাভাষী মানুষের ঐতিহ্যবাহী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি দেশ। ইরানিরা আত্মবিশ্বাসী, তবে উগ্র নয়। আমি ইরানিদের এই সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সাধুবাদ জানাই। পৃথিবীতে খুব বেশি উন্নয়নশীল দেশ নেই যারা এই মাপের উৎকর্ষ ব্যবস্থাপনায় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে পারবে। ইসলামিক কনফারেন্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন এবং ঢাকায় দুটি সার্ক সম্মেলন করার আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুবিশাল ‘ন্যাম’ কনফারেন্সের তুলনায় তা কিছুই নয়। তবু সেগুলো অনুষ্ঠিত করতে আমরা হিমশিম খেয়ে যাই। তাদের বহু প্রকার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, যে যথার্থ ব্যবস্থাপনায় ইরানিরা এই সম্মেলন করতে পেরেছে তা তাদের, জাতি হিসেবে দক্ষতারই পরিচায়ক।
আরব বসন্তেরই ফসল, মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসি এই সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ডে দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের মুরসি রক্ষণশীল ও উগ্রপন্থী হবেন—পাশ্চাত্যের এ ধারণা অমূলকই মনে হচ্ছে। সিরিয়া সম্বন্ধে ইরান ও মিসরের অবস্থান বিপরীত। ইরান আসাদ সরকারকে সমর্থন করে আর মিসরের অবস্থান সেই দেশের বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মুরসি প্রস্তাব করেছেন যে তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান ও মিসরকে নিয়ে একটি ‘কনট্যাক্ট গ্রুপ’ সিরিয়া সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানে সচেষ্ট হোক। প্রস্তাবটি দূরদর্শী, পরিপক্ব ও সাহসী। বিপরীত অবস্থানে থেকেও যে মিসর ও ইরান সহযোগিতায় কাজ করতে প্রস্তুত, তা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি সুখবর।
যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করেও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন তেহরানে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই দেশের নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইরান এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করে তার দায়িত্বশীলতারই প্রমাণ রেখেছে। আগামী তিন বছর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ইরানের একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালনের অবকাশ রয়েছে। একটি মনগড়া অজুহাতে ইসরায়েল ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ স্থাপনাগুলোর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতে পারে বলে যে ভীতি ছিল, তেহরানের এ সম্মেলন তা অনেকটাই তিরোহিত করল।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। কলাম লেখক।

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.