বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারে দ্বিমুখী নীতি কতটা যৌক্তিক
লেখক: মাহমুদুল হাসান | রবিবার, ১৪ অক্টোবর ২০১২, ২৯ আশ্বিন ১৪১৯
পারমাণবিক শক্তিকে শান্তির কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন চুক্তি করা হয়। সেই চুক্তিগুলো কতটুকু শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার জন্য কাজ করেছে তা অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। আমি সেই চুক্তিগুলোকে তারা কি ধরনের দ্বিমুখী আচরণ করে বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছে সে সম্পর্কেও সামান্য আলোকপাত করবো।
চুক্তির মূল বিষয় হল বিশ্বের পাঁচটি দেশ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনকে পরমাণু শক্তিধর দেশ বলে মেনে নেয়া হবে। যাকে বলে একেবারে এক পেশে নীতি। এই পাঁচটি দেশ এই চুক্তিতে সই না করা অন্য কোন দেশকে পারমাণবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি সরবরাহ করবে না। যে সমস্ত দেশ এই চুক্তিতে সই করবে তাদের মেনে নিতে হবে, তারা কোনভাবেই পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত কোনও গবেষণা করবে না। এই চুক্তিকে একবারে শুভঙ্করের ফাঁকি তা মাকির্নীদের আচরণ দেখে বোঝা যায়। তবে যারা চুক্তিতে সই করবে না তারা পারমাণবিক প্রযুক্তি বা জ্বালানি পাবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পন্ন করার জন্য। কিন্তু এই সমস্ত দেশগুলোকে নিজেদের পারমাণবিক চুল্লিগুলো ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সী’ বা ‘আইএইএ’ র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। যাতে ‘আইএইএ’ র দল দরকার হলে পরীক্ষা করতে পারে এই পারমাণবিক চুল্লিগুলো শুধুই পারমাণবিক বিদ্যুত্ তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, না পরমাণু অস্ত্রের জন্য ফিসাইল মেটেরিয়াল তৈরি করা হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করবে। চুক্তির মধ্যে এই চালাকির কথা ভারত, ইরান, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তানসহ আরো কিছু দেশ বারবার বলে এসেছে। তাই এসব দেশের পক্ষে ‘এনপিটি’ চুক্তি সই করা সম্ভব হয়নি। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারত প্রথম পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করে ১৯৭৪ সালে। পরে আবার দ্বিতীয় পরীক্ষা করে ১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী আমলে। ভারতের দ্বিতীয় পরীক্ষার পরে পরেই পাকিস্তান তাদের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করে। এরপরে ২০০৬ সালে উত্তর কোরিয়াও সেরে ফেলে তাদের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা। সেই অর্থে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা না করলেও ধরে নেয়া হয় ইসরাঈলের কাছেও পরমাণু অস্ত্র আছে। ফলে ‘এনপিটি’তে স্বীকৃত পাঁচ পরমাণু দেশ ছাড়াও এই মুহূর্তে ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া আর ইসরাঈল এখন পরমাণু শক্তি সম্পন্ন দেশ। এর মধ্যে ভারতই প্রথম ঘোষণা করে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত না হলে কখনই পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে না। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া একসময় ‘এনপিটি’তে সই করেও পরে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আব্দুল কাদির খান পরমাণু প্রযুক্তি অন্য দেশে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েন। আর ইসরাঈল এখনও পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা না করায় অনেক বিশেষজ্ঞই নিশ্চিত নন তাদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতদূর। এইরকম অবস্থায় আমেরিকাসহ ‘এনপিটি’ স্বীকৃত পাঁচ পরমাণু শক্তিধর দেশ এখন ভারতকেই সবচেয়ে পরমাণু শক্তি সম্পন্ন দেশ বলে মনে করছে। তাই ভারত ‘এনপিটি’তে সই না করলে প্রথমতঃ এই চুক্তির গুরুত্বই কমে যায়। আর দ্বিতীয়তঃ ভারতের পরমাণু গবেষণার ওপরও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। ফলে ভারতকে যেনতেন প্রকারে ‘এনপিটি’তে সই করাতে উঠে পড়ে লেগেছিল সমস্ত স্বীকৃত পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো। কিন্তু ভারত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় এই চুক্তির দ্বিচারিতা না দূর করলে ভারতের পক্ষে এই চুক্তি সই করা সম্ভব নয়। ভারতের এমন আচরণের পরেও পশ্চিমা বিশ্ব ভারতের উপরে কোন প্রকার অবরোধ আরোপ না করে উল্টো অবরোধ আরোপ করছে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার উপর। এ দ্বিচারিতারও কিছু কারণ আছে।
ইরান মুসলীম রাষ্ট্র ২. ইরান তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ৩. ইরান পরমাণু বিদ্যুত্ শক্তিসম্পূর্ণ, শক্তিধর ও বিত্তশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের অবস্থান করবে ৪. মধ্যেপ্রাচ্যে আরব সাগরে ইরানের একটি কর্তৃত্ব আছে, তাছাড়া পরমাণু অস্ত্রের দ্বারা পশ্চিমারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তেজস্ক্রিতায় ক্ষতিগস্ত হবার ভয়তো আছেই।
তবে ইরানের মতো ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট বিচার করলে গত দশ বছরে ভারতের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তা ধরে রাখতে গেলে অন্যতম প্রয়োজনীয় হল ‘বিদ্যুত্’। কিছুদিন আগে দেখা গেছে ভারতের মুম্বাই শহর বিদ্যুতের অভাবে দুইদিন অন্ধকারে ছিল। ভারতে এখনও প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত্ পৌঁছায়নি। ২০৩০ সাল অবধি বিদ্যুত্ ঘাটতির পরিমাণ হবে প্রায় দেড় লক্ষ মেগাওয়াট। ২০৫০ সাল অবধি এই ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে চার লক্ষ মেগাওয়াট। কেমন করে আসবে বিদ্যুত্, যখন তেল প্রায় শূন্য। ভারতের কয়লা যা মজুদ আছে ২০৫০ সাল অবধি তা দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। অন্যান্য নন কনভেনশনাল শক্তি দিয়েও চাহিদার সামান্য ভগ্নাংশ ও মেটানো সম্ভব নয়। পারমাণবিক বিদ্যুত্ ছাড়া আর কোনও উপায় ভারতের কাছে নেই। এদিকে ভারতের প্রথম পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পরই তৈরি হয়েছে ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ’ বা ‘এনএসজি’। মূলতঃ ভারতের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরি হয়েছিল এই সংস্থা। বলা হয়েছিল ভারতকে অন্য দেশ (কানাডা), যে পারমাণবিক চুল্লি দিয়েছে শান্তিপূর্ণ শক্তির প্রসারের জন্য, ভারত তা ব্যবহার করেছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজে। এই রকম ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, তা আটকানোর জন্যই তৈরি হয় এই ‘এনএসজি’। যে সমস্ত দেশ, ইউরেনিয়াম অন্য কোনো দেশকে বিক্রি করতে চায়, তাদের নিয়ে তৈরি করা হয় এই গ্রুপ। যে সমস্ত দেশ, ‘এনএসজি’র সদস্য কোনো দেশ থেকে ইউরেনিয়াম কিনতে চায়, সেই সমস্ত দেশকে তাদের পারমাণবিক চুল্লি ‘আইএইএ’র তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।
উপরের সামান্য আলোচনা থেকে আমার মনে হয় কিছুটা হলেও আপনাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী কতটা স্বার্থবাদী আচরণ করছে সব শক্তিধর দেশগুলো। আমরা আশা করি শক্তিপূর্ণ দেশগুলো তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ি্বের জন্য নিজেদেরকে ধ্বংসকারী পারমাণবিক অস্ত্র উত্পাদন হতে বিরত রাখবে। তাহলে তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত পৃথিবীতে মানুব সভ্যতা আরো বেশি দিন টিকে থাকবে।
লেখক :শিক্ষার্থী
২য় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.