Sunday, October 21, 2012

আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে


আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে

লেখক: মো. আবদুল লতিফ মন্ডল  |  রবিবার, ২১ অক্টোবর ২০১২, ৬ কার্তিক ১৪১৯
গত ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক জোসি গ্রাজিয়ানো দ্য সিল্ভা বলেছেন, সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং এজন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন। তিনি আরও বলেছেন, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কোনো একক দেশের পক্ষে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এর আগে এফএও-এর ৯ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১২ সময়কালে বিশ্বে ৮৬ কোটি  ৮০ লাখ মানুষ অর্থাত্ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ খাদ্যাভাবে ভুগেছে। অর্থাত্ বিশ্বের প্রতি ৮ জনে ১ জন মানুষ খাদ্যাভাবে আছে।
খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞানুযায়ী তখনই খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান যখন সবার কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ এবং পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। ১৯৯৬ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে যোগদানরত স্ব স্ব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য প্রাপ্তিকে প্রত্যেক মানুষের অধিকার হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমাদের জাতীয় খাদ্যনীতিতে (২০০৬) খাদ্যনিরাপত্তায় চিহ্নিত তিনটি নিয়ামক হলো----খাদ্যের লভ্যতা (availability of food), খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষমতা (access to food) এবং খাদ্যের জৈবিক ব্যবহার (utilization of food). সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা প্রশ্নে সব কয়টি নিয়ামক গুরুত্বপূর্ণ এবং এদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পারস্পরিক নির্ভরতা বিদ্যমান থাকায় খাদ্যনিরাপত্তা-সম্পর্কিত সব বিষয়ের মধ্যে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।
এখন দেখা যাক, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা কোন পর্যায়ে। সার্বিক খাদ্যকে মোটামুটি ১১টি শ্রেণীতে ভাগ করা হলেও জীবন ধারণও সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যশস্য (চাল, গম), শাকসবজি, ডাল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দরকারি খাদ্যশস্য চাল। কারণ আমাদের খাদ্যশস্যের চাহিদার কমবেশি ৯৩ শতাংশ পূরণ করে চাল। ক্যালরির ৭৫ শতাংশ আসে চাল থেকে। এটি সত্য, স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও চালের উত্পাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০১১-১২ অর্থবছর দেশে চালের উত্পাদন ৩ কোটি ৩৮ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। এ থেকে সিড, ফিড ও অপচয় বাদ দিয়ে মানুষের খাবার প্রয়োজন মিটিয়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।
 তবে খাদ্যশস্য হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা গমের (খাদ্যশস্যের চাহিদার কমবেশি ৭ শতাংশ পূরণ করে) উত্পাদন প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ। বছরে ৩০ লাখ টনের বেশি গম আমদানি করতে হচ্ছে। বিজ্ঞজনরা বলছেন, চালের তুলনায় গমজাতীয় খাদ্যের দাম কিছুটা কম হওয়ায় এবং মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসায় গমের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে যাবে।
এখন দেখা যাক আমাদের আমিষ জাতীয় খাদ্যপণ্যের উত্পাদন অবস্থা। খাদ্যপণ্য মাছ-মাংস, ডিম, দুধ মানুষের আমিষের চাহিদা মেটায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটে গবেষণার ফলাফলের বরাত দিয়ে ১৯ মে একটি বাংলা দৈনিকের (বণিক বার্তা) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে দেশে মাংসের ঘাটতি হবে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন ও দুধের ঘাটতি হবে ১০ লাখ ৮ হাজার টন। এছাড়া মাছের ঘাটতি  ৫ লাখ ৪ হাজার টন এবং ডিমের ঘাটতি হবে ১০৯ কোটি ৯০ লাখ। এসব পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি আগামী তিন বছরে ক্রমান্বয়ে বাড়বে। ২০১৩ সালে মাংসের ঘাটতি হবে ১৭ লাখ ৮০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ২৩ লাখ ও ২৯ লাখ ৬০ হাজার টনে। ২০১৩ সালে ডিমের ঘাটতি হবে ১৪৬ কোটি ৩০ লাখ, যা পরের দুই বছরে গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৮৭ কোটি ২০ লাখ  এবং ২৩২ কোটি ৮০ লাখে। আগামী বছর দুধের ঘাটতি থাকবে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা হবে যথাক্রমে ২২ লাখ এবং ২৯ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০১৩ সালে মাছের ঘাটতি হবে ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৭ লাখ ৬০ হাজার এবং ৮ লাখ ৫০ হাজার টন। বর্তমানে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা  পুরণ করা হচ্ছে। এছাড়া আমিষের আর একটি চমত্কার উত্স ডালের মোট চাহিদার কমবেশি ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশে প্রাণীজ খাদ্যের---যথা দুধ, মাংস এবং ডিমের চাহিদার তুলনায় উত্পাদনে ঘাটতি রয়েছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
খাদ্যের লভ্যতা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার খাদ্য কেনার সামর্থ। বাংলাদেশের ষষ্ঠ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে দরিদ্র জনসংখ্যার হার ১৯৯১-৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে নেমে ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আবার একই সঙ্গে বলা হয়েছে, “ Poverty still remains at a very high level and the number of people living below poverty line remains almost the same as it was in 1991-92” অর্থাত্ দারিদ্রের হার এখনও অনেক বেশি এবং দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৯৯১-৯২ সালের পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৯১-৯২ সালে দেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটির ওপরে এবং এখন তা’ দাঁড়িয়েছে পৌনে পাঁচ কোটিতে। অর্থাত্ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তেমন কমছে না। না কমার কারণ মুলত দু’টি----এক. শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে এরা দারিদ্র্য চক্র হতে বের হয়ে আসতে পারছে না। ১৯৯১ সালের আদমশুমারির সাড়ে ১০ কোটির কিছুটা বেশি জনসংখ্যার সঙ্গে গত দু’দশকে প্রায় পাঁচ কোটি জনসংখ্যা যোগ হয়েছে। এদের বেশিরভাগ এসেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী থেকে। দুই. বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের আয়-বৈষম্য আর একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পভার্টি মনিটরিং সার্ভে রিপোর্ট-২০০৪ থেকে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে খানা (household) প্রতি মাসিক আয় ছিল চার হাজার ৮১২ টাকা, তা ২০০৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় পাঁচ হাজার ৩০২ টাকা। শতকরা বৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গরীব খানার আয় ১৯৯৯-এর তুলনায় ২০০৪ সালে কমে যায়; অন্যদিকে ১৯৯৯ সালে ধনী খানার মাসিক আয় ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে যায়। বিবিএস-এর হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস)-২০০৫ থেকেও আমরা ধনী-গরীব খানার আয় বৃদ্ধি বৈষম্যের অনুরূপ চিত্র পাই। এইচআইইএস ২০১০ থেকে দেখা যায়, আয় কেন্দ্রীভূত হওয়া সামান্যই কমেছে। বলা হয়েছে, ‘The concentration of wealth has slightly decreased’। ‘কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ এবং পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্য’ সংগ্রহ করা এ বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা থেকে যাচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা বলয়ের বাইরে।
খাদ্যনিরাপত্তার তৃতীয় উপাদান পুষ্টি মানসম্পন্ন ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের নিচে অবস্থান করছে  বাংলাদেশ। নারী ও শিশুসহ দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টিসমস্যা প্রকটভাবে বিদ্যমান। এর কারণ আর্থিক ও খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহার। আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে আমিষ জাতীয় খাদ্য কেনা প্রায় সম্ভব হয় না। সুষম খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।  খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহারগুলো হলো---এক. পুরুষের তুলনায় নারী ও শিশুরা প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। ফলে তারা ভোগে অপুষ্টিতে। দুই. ত্রুটিপূর্ণ রন্ধন পদ্ধতির জন্য, বিশেষ করে শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যের উপাদান ত্রুটিপূর্ণভাবে কাটা, অতিরিক্ত ধোয়া এবং অত্যধিক তাপের কারণে এগুলোর পুষ্টিগুণ অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়।
খাদ্যনিরাপত্তার তিনটি নিয়ামক বিবেচনায় নিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তৈরি  ‘দ্য গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০১২’ বা বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা তালিকা-২০১২তে বিশ্বের ১০৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮১তম। তালিকা অনুযায়ী খাদ্যনিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
সবশেষে যা বলা প্রয়োজন তা হলো, এ মুহূর্তে প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও প্রয়োজনের তুলনায় আমিষ জাতীয় খাদ্যপণ্যের অভাব, এক বিরাট জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় ক্ষমতার অভাব, খাদ্যে পুষ্টিমানের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের জয়ী হতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব
E-mail:latifm43¦gmail.com

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.