মনোজিৎ মিত্র
'বিশ্ববিদ্যালয়' নামের মাহাত্ম্য বাংলার বুকে আজ সাদামাটা শুকনো খড়খড়ি। সেই কবেকার নালন্দার স্বপ্ন আজ অতীতের অতিকল্পনা। এমনকি এই সময়ের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধাত্রীমাতা 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' কেবলই সুবিধা লাভের নামফলক। শহরের মোড়ে মোড়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয়। টাকার জোরে ঘরে বসে ডিগ্রি লাভের দিন আর খুব বেশি দূরে নয়। হয়তো গোপনে চলেও এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কী বা কেন বিশ্ববিদ্যালয়_ এসব প্রশ্নের অন্তরালে প্রায়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ঢাকা পড়ে যায়। মৃতপ্রায় জীর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী শিখছি? এই শেখার জায়গা থেকে বিচার করতে বসলে দেখা যায়, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমরা আসলে ভাবছি, তা কেবলই এক সংকীর্ণ কূপমণ্ডূক শিক্ষা কারখানা। শিক্ষার্থীরা এখানে বেকারি কারখানার ময়দা বা আটার মতো, বিস্কুট বা পাউরুটি হয়ে কেবল বেরিয়ে যাওয়া। এই বেরিয়ে যাওয়ার ভেতরেই চলে মূল প্রতিযোগিতা। কে কীভাবে বের হলো? কার ফ্লেভার কেমন? দর্শন বা ইতিহাস বা বাংলার ফ্লেভার একেবারের পাতে তোলার অযোগ্য। মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, আরে বাব্বা কাড়াকাড়ির কী বাড়াবাড়ি! এই যেখানে শেখানো হয় তার পেছনে হাজারো বিশ্ববিদ্যালয় লাগানো থাকলেও তা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় নয়। দ্বিতীয়ত, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল মুখস্থ করে পাস করে যায় সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। সর্বোপরি কোনো শিক্ষার দোকান বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না।
একটি চাকরি, স্রেফ ভালো একজন চাকর হওয়ার জন্য যে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে থাকে তার কাছে বিশ্বের সন্ধান মিলবে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে স্কুল-কলেজের এত চেনামুখের সবাই কোথায় হারিয়ে যায়? কীভাবে হারায়? কেন হারায়? এ বিষয়ে খুব সহজ একটা প্রতারক উত্তর সমাজে প্রচলিত আছে_ 'তুমি যোগ্য তাই, টিকে আছ।' একজন ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না, কিংবা আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছাত্র যখন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না, তখন তাদের দুইয়ের অবস্থা একই দাঁড়ায়। আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার কৌশলী ধারা এই হীনম্মন্যতাকেই সবসময় পরিপুষ্ট করে রাখে। যাতে সত্যিকারের শিক্ষার আবেদন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে না পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রক্রিয়ায় পুরোটা জুড়ে কেবল শিক্ষা নামের আপাত লেবাস। যার অন্তরালে কেবল অশিক্ষা আর কুশিক্ষার কুৎসিত দেহ। সবচেয়ে প্রধান দুই উপাদান শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক কেবল ক্লাসের রোলকল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রকে জোর করে ক্লাসে আটকে রাখার জন্য প্রশাসনের কী আপ্রাণ প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগের শিক্ষাজীবন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়েই কাটে, সেহেতু তিনি জানেন এর সব খারাপটা। এই খারাপ দেখে দেখেই তার বেড়ে ওঠা, ফলে তিনি বের হতে পারেন না এই বৃত্ত থেকে। আজকের অধিকাংশ তরুণ শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সত্যিকারের শিক্ষা না
পেয়েই শিক্ষা শেষ করেছেন। ফলে তাদের কাছে যারা শিখছে তাদের অবস্থা আরও গুরুতর এবং পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এর শিক্ষা প্রক্রিয়া দ্রুতই এ ব্যবস্থার প্রতি তার বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। এসব বিরূপতা এখন অসন্তোষের দিকে একটু একটু করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় তো আজ কেবল একটি সার্টিফিকেট দেওয়ায় মাধ্যম মাত্র। এখানে পদার্থবিদ্যা যা ভূগোলও তাই। কোনো বিজ্ঞানী তো দূরের কথা একজন বিজ্ঞানমনস্ক লোকও আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় গড়ে ওঠা সম্ভব কি?
তারপরও প্রতি বছর হাজার হাজার প্রাণোচ্ছল শিক্ষার্থী নতুন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে আর সবকিছু হারিয়ে কেবল একটি সার্টিফিকেট নিয়ে প্রাণসর্বস্ব হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তবে এই মানুষগুলোর মাঝে বর্তমানে ভোগী, কপট, স্বার্থপর কুশিক্ষার বদলে নতুন মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা আনার চিন্তাও বাড়ছে।
য় মনোজিৎ মিত্র : শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কী বা কেন বিশ্ববিদ্যালয়_ এসব প্রশ্নের অন্তরালে প্রায়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি ঢাকা পড়ে যায়। মৃতপ্রায় জীর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী শিখছি? এই শেখার জায়গা থেকে বিচার করতে বসলে দেখা যায়, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমরা আসলে ভাবছি, তা কেবলই এক সংকীর্ণ কূপমণ্ডূক শিক্ষা কারখানা। শিক্ষার্থীরা এখানে বেকারি কারখানার ময়দা বা আটার মতো, বিস্কুট বা পাউরুটি হয়ে কেবল বেরিয়ে যাওয়া। এই বেরিয়ে যাওয়ার ভেতরেই চলে মূল প্রতিযোগিতা। কে কীভাবে বের হলো? কার ফ্লেভার কেমন? দর্শন বা ইতিহাস বা বাংলার ফ্লেভার একেবারের পাতে তোলার অযোগ্য। মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, আরে বাব্বা কাড়াকাড়ির কী বাড়াবাড়ি! এই যেখানে শেখানো হয় তার পেছনে হাজারো বিশ্ববিদ্যালয় লাগানো থাকলেও তা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় নয়। দ্বিতীয়ত, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল মুখস্থ করে পাস করে যায় সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় নয়। সর্বোপরি কোনো শিক্ষার দোকান বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না।
একটি চাকরি, স্রেফ ভালো একজন চাকর হওয়ার জন্য যে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে থাকে তার কাছে বিশ্বের সন্ধান মিলবে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে স্কুল-কলেজের এত চেনামুখের সবাই কোথায় হারিয়ে যায়? কীভাবে হারায়? কেন হারায়? এ বিষয়ে খুব সহজ একটা প্রতারক উত্তর সমাজে প্রচলিত আছে_ 'তুমি যোগ্য তাই, টিকে আছ।' একজন ছাত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না, কিংবা আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছাত্র যখন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না, তখন তাদের দুইয়ের অবস্থা একই দাঁড়ায়। আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার কৌশলী ধারা এই হীনম্মন্যতাকেই সবসময় পরিপুষ্ট করে রাখে। যাতে সত্যিকারের শিক্ষার আবেদন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে না পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রক্রিয়ায় পুরোটা জুড়ে কেবল শিক্ষা নামের আপাত লেবাস। যার অন্তরালে কেবল অশিক্ষা আর কুশিক্ষার কুৎসিত দেহ। সবচেয়ে প্রধান দুই উপাদান শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক কেবল ক্লাসের রোলকল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রকে জোর করে ক্লাসে আটকে রাখার জন্য প্রশাসনের কী আপ্রাণ প্রচেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগের শিক্ষাজীবন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়েই কাটে, সেহেতু তিনি জানেন এর সব খারাপটা। এই খারাপ দেখে দেখেই তার বেড়ে ওঠা, ফলে তিনি বের হতে পারেন না এই বৃত্ত থেকে। আজকের অধিকাংশ তরুণ শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সত্যিকারের শিক্ষা না
পেয়েই শিক্ষা শেষ করেছেন। ফলে তাদের কাছে যারা শিখছে তাদের অবস্থা আরও গুরুতর এবং পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এর শিক্ষা প্রক্রিয়া দ্রুতই এ ব্যবস্থার প্রতি তার বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। এসব বিরূপতা এখন অসন্তোষের দিকে একটু একটু করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় তো আজ কেবল একটি সার্টিফিকেট দেওয়ায় মাধ্যম মাত্র। এখানে পদার্থবিদ্যা যা ভূগোলও তাই। কোনো বিজ্ঞানী তো দূরের কথা একজন বিজ্ঞানমনস্ক লোকও আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় গড়ে ওঠা সম্ভব কি?
তারপরও প্রতি বছর হাজার হাজার প্রাণোচ্ছল শিক্ষার্থী নতুন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে আর সবকিছু হারিয়ে কেবল একটি সার্টিফিকেট নিয়ে প্রাণসর্বস্ব হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তবে এই মানুষগুলোর মাঝে বর্তমানে ভোগী, কপট, স্বার্থপর কুশিক্ষার বদলে নতুন মানবিক শিক্ষা ব্যবস্থা আনার চিন্তাও বাড়ছে।
য় মনোজিৎ মিত্র : শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.