চাপে আছে হিজবুল্লাহ
লেখক: প্রীতিলতা পারভীন | সোমবার, ১৫ অক্টোবর ২০১২, ৩০ আশ্বিন ১৪১৯
সিরিয়ায় চলমান ১৮ মাসের বিক্ষোভ মধ্যপ্রাচ্য এবং সারা বিশ্বের জন্য ‘তীব্র মাথাব্যথা’র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই সমস্যার দ্রুত সমাধান চাইলেও সিরিয়া সরকার ও বিরোধী পক্ষ এবং পশ্চিমাদের সদয় ইচ্ছা না থাকায় তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ বিশ্লেষক। সিরিয়া-সংকটের কারণে সমস্যায় আছে প্রতিবেশী দেশ লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপ। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করায় দেশের ভেতরে-বাইরে হিজবুল্লাহর শক্তিশালী ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—হয়ে পড়ছে দুর্বল। এখন নিজেদের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। অবশ্য কেউ কেউ মনে করছেন—আপাত নীরবতা হিজবুল্লাহর কৌশল মাত্র।
হিজুবল্লাহ যে চাপে আছে, এর প্রমাণও মিলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ-এর মধ্যকার বৈঠক থেকেই। সিরিয়ার পাশাপাশি হিজবুল্লাহর ওপর চাপ বাড়াতে করণীয় নিয়েই তারা বৈঠক করেন। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র পরক্ষভাবে লেবাননে ঘাঁটি গাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবকে সমর্থন দিয়েছে লেবাননের রাজনৈতিক দলের জোট মার্চ-ফোরটিন। লেবাননের উত্তরাঞ্চলে সিরিয়া-সীমান্তে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পার্লামেন্টে ভোটাভুটির জন্য তারা উপস্থাপন করে। হিজবুল্লাহর ক্ষমতা খর্ব করতেই ২০০৫ সালে মার্চ-ফোরটিন জোটের জন্ম হয়।
সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা মার্চ-ফোরটিন জনসম্মুখেই বলেছে। ২০০৭ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধকালে ইসরায়েলের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সমর্থিত আন্তর্জাতিক বাহিনী ব্যবহার করা হয়। সরকার-বিরোধীরা উত্তর লেবাননের ত্রিপোলির ক্লেইয়াত বিমানবন্দর আধুনিকায়নের দাবি জানিয়েছে।
সুন্নিসমৃদ্ধ আখার এলাকার নিকটবর্তী ক্লেইয়াত বিমানবন্দরটি আধুনিক করার জন্য অনেক দিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বিরোধীরা। লেবাননের পার্লামেন্টের এক সদস্য বলেছেন, ‘আমেরিকান এবং কিছু দেশি নেতা ক্লেইয়াত বিমানবন্দরটি আধুনিকীকরণের ফাইলটি ফেলে রেখেছেন। এর একটি কারণ হচ্ছে, বিমানবন্দরটির সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে আন্তর্জাতিক বাহিনী এটি প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র এবং রসদ মজুদ ও সরবরাহের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে।’
সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার জেফরি ফেল্টম্যানের পরিকল্পনাটিই বছর চারেক আগে প্রকাশ পায়। আর এর মাধ্যমে এখানে ‘ভৌগলিকভাবে মুক্ত এলাকা’ গঠন করার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতে এখানে একটি পশ্চিমা রসদ গুদামজাতের ঘাঁটি গড়ে তোলা যাবে। সিরিয়ার চলমান সংকটের কারণে ফেল্টম্যানের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ এসেছে পেন্টাগন ও তাদের মিত্রদের সামনে। ক্লেইয়াত বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২০০৮ সালে ক্লেইয়াত বিমানবন্দরের রানওয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল। তাদের ভাষ্যমতে—সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহযোগিতা করতে তারা এ ঘাঁটি ব্যবহার করবে।
বিমানবন্দর পরিদর্শনের পর পেন্টাগন মার্কিন কংগ্রেসে বলেছে, ‘ক্লেইয়াতের সার্বিক অবস্থা ভালো। সামরিক সরঞ্জামবাহী বিমান ওঠা-নামা করতে পারবে এখানে। তবে বেসামরিক বিমানবন্দর হিসেবে এটি ব্যবহারের অনুপোযোগী।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে—এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে, তা লেবানিজ ন্যাশনাল রেসিসটেন্স-এর তীব্র বিরোধীতার মুখে পড়বে।
হিজবুল্লাহর মুখপাত্র শেখ নাইম কাশেম এ ধরনের পরিকল্পনাকে ‘দেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘সিরিয়া ইস্যুতে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র হিসেবে লেবাননকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। উত্তরাঞ্চলীয় ক্লেইয়াত বিমানবন্দরে কখনোই আন্তর্জাতিক বাহিনীকে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হবে না। সিরিয়ার মতো লেবাননকে ধ্বংস করার জন্য এটা ইহুদি পরিকল্পনা। সিরিয়াতে যখন পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই তারা লেবাননে ঘাঁটি তৈরির জন্য কাজ করছে। মার্চ-ফোরটিন গ্রুপ যদি লেবাননে উত্তরাঞ্চলে চোরচালান ও মিলিশিয়াদের তত্পরতা বন্ধ করতে না পারে, তবে সে দায় তাদের। সে সুযোগ নিয়ে বিদেশিদের এখানে প্রবেশের রাস্তা করে দেওয়া উচিত হবে না।’
ফিলিস্তিনে উপনিবেশ বজায় রাখতে লেবাননের আকাশসীমা ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তবে এ জন্য তারা লেবানন সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি। এরই ধারাবহিকতায় সিরিয়াকে ঘায়েল করতে এবার তারা ক্লেইয়াত বিমানবন্দরকে ব্যবহারের ফন্দি আটছে। এ ছাড়া আরেকটি লক্ষ্য হলো হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য জঙ্গি দলকে দমিয়ে রাখা।
লেবানন ও সিরিয়ায় সক্রিয় থাকা আল-কায়েদা সহযোগী আবদাল্লাহ আজম ব্রিগেডসকে হিজবুল্লাহ ও শিয়াদের বিরুদ্ধে সহিংস তত্পরতা বৃদ্ধির জন্য বারবার সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে লেবাননে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধির শঙ্কাও করা হচ্ছে। গত ১৭ আগস্ট জিহাদি ওয়েবসাইটে পাঠানো এক অডিও বার্তায় মার্চ-ফোরটিন শিয়াদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ‘হিজবুল্লাহ ও আমল মুভমেন্টকে সিরিয়ায় কখনোই তোমাদের (শিয়া) স্বার্থ হাসিল করতে দেওয়া হবে না। তারা যদি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বজায় রাখে, তাহলে এর শাস্তি ও মূল্য তোমাদেরই দিতে হবে। আর এ জন্য তোমাদের নিজেদেরকে দায়ী করা ছাড়া আর কোনো পথ পাবে না।’
বৈরুতের আমেরিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ইসলামের রাজনীতি বিষয়ে বিষেশজ্ঞ ড. আহমেদ মৌসালির মতে, ‘লেবানন ও সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি আল-কায়েদার শাখাটির জন্য সোনালি সময়। কারণ, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এমন সুবর্ণ সুযোগ এর আগে তারা কখনোই পায়নি। সুযোগ বুঝে তারা সিরিয়া থেকে লেবাননে যোদ্ধা পাঠাবে হিজবুল্লাহ এবং তার সমর্থকদের ওপর হামলা করার জন্য।
‘আরব বসন্ত’ ও ‘ইসলামি জাগরণ’-এর প্রতি হিজবুল্লাহর সমর্থন রয়েছে। আবার আসাদের প্রতিও তাদের সমর্থন রয়েছে। এই ইস্যু এবং হিজবুল্লাহর অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিবেশী এলাকায় আল-কায়েদার সহযোগীরা বিভ্রান্তি ছড়াবে। হিজবুল্লাহর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন—লেবানন এবং এ অঞ্চলে বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের জন্য কাজ করা সহজ নয়। তবে আন্তর্জাতিক বাধার মুখে শিয়া-সমর্থিত এ দলটির কাজ করে যাওয়া বেশ কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিরিয়া ইস্যুতে হিজবুল্লাহর নীরব ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন লেবানিজ ফোর্সের প্রধান সামির জিয়াজিয়া। তিনি বলেন, ‘হিজবুল্লাহর নীবর ভূমিকা থেকে এটা প্রমাণিত যে, তাদের মদতেই সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সিরিয়ায় চলমান ঘটনার নিন্দা না করেই হিজবুল্লাহর মহাসচিব সৈয়দ হাসান নাসারাল্লা বলছেন—পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে সিরিয়া-সংকটে তার পুরোপুরি সায় রয়েছে।’
বিশেষজ্ঞ হানিন গাদার-এর মতে, ‘কখনো কখনো মৌলিক বিষয়গুলোর পরিবর্তন হয়। লেবাননে দীর্ঘ দিন ধরে সিরিয়া সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বর্তমানে পরাহত। নিজ দেশেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। নিজেদের রক্ষা করতেই এখন ব্যস্ত হিজবুল্লাহ।’
মার্চ-ফোরটিন সম্প্রতি হিজবুল্লাহ-সমর্থিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদনান মানসুরের পদত্যাগের দাবিতে মিছিল করেছে। সাবেক তথ্যমন্ত্রী আল-আসাদ মাইকেল সামাহাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি সিরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান জেনারেল আলী মামলুকের সঙ্গে মিলে লেবাননের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছেন। এ ছাড়া সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সঙ্গে হিজবুল্লাহর কিছু নেতার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক থাকার বিষয়ে গুজবও শোনা গেছে।
লেবাননের জাতীয় স্বার্থে, ইসরায়েলি দখদারিত্ব থেকে মুক্ত থাকতে এবং আবর বিশ্বে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরির জন্য সম্পর্কের ভারসাম্য আনার প্রয়োজনীয়তা বিষয়টি হিজবুল্লাহ অবশ্য এখন অনুধাবন করতে পারছে। এ জন্য তারা এবং শিয়া সম্প্র্রদায়-বিরোধীদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে সংলাপ ও অংশীদারিত্বের পথ উন্মুক্ত করেছে। আগামী বছর পার্লামেন্ট নির্বাচন, কাজেই এখন দেখার বিষয় হিজবুল্লাহ দেশে এবং দেশের বাইরে তাদের অবস্থা ধরে রাখতে কতটা সক্ষম।
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.