বিদেশি বিনিয়োগ : কখনো ভালো, কখনো খারাপ
আবু আহমেদ
আসলে সামান্য বিদেশি বিনিয়োগ পেয়ে কোনো দেশই তাদের দারিদ্র্য ঘোচাতে পারেনি। বিদেশি বিনিয়োগ পেয়ে যদি দরিদ্র দেশগুলো উন্নতি করতে পারত, তাহলে গত ৬০ বছরে আফ্রিকার দেশগুলো উন্নতি করে ফেলত। একই কথা খাটে বিদেশি এইড তথা সাহায্যের ক্ষেত্রেও। বিদেশি বিনিয়োগ আসে প্রাইভেট সেক্টর বা ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে। ছিটেফোঁটা এলে ওই বিনিয়োগ অনেক লাভ চায়। সেই বিনিয়োগ দেখে, ওই দেশে গিয়ে কোনো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে কি না। প্রতিযোগিতা না থাকলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে তারা ভালোবাসে। যেমন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানে বিদেশি অনেক ওষুধ কম্পানি বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু আশির দশকে স্বাধীন বাংলাদেশ যখন ওপেন একটা ওষুধনীতি গ্রহণ করে, তখন বিদেশি ওষুধ কম্পানিগুলো দারুণ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে তাদের অনেকে স্থানীয় ওষুধ কম্পানির কাছে পুরো সম্পদ বেচে এ দেশ থেকে বিনিয়োগ গুটিয়ে নেয়। একই অবস্থা হয়েছে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক দ্রব্যের কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও। একদিন তো হল্যান্ডের ফিলিপস ঘরে ঘরে পরিচিত ছিল। আজ সেই ফিলিপস বাংলাদেশে নেই। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিফোন ও গ্যাস ফিল্ড উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ লাভ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টেলিফোন খাতে এখন দারুণ প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হয়েছে। তবে এই প্রতিযোগিতা কোনো স্থানীয় বিনিয়োগের সঙ্গে নয়, এই প্রতিযোগিতা মূলত বিদেশি কম্পানিগুলোর মধ্যে। তবু তারা অনেক জনগণকে টেলিফোনের গ্রাহক বানিয়ে বড় ব্যবসা করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সামনে বাংলাদেশ টেলিফোন খাতে বাড়তি বিদেশি বিনিয়োগ আশা করতে পারে না। টেলিফোনের ক্ষেত্রেও একটা পর্যায় পর্যন্ত বাংলাদেশ মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসার মূল্য দিয়েছে। সবার মনে আছে, একসময় এ দেশের বৃহত্তম মোবাইল টেলিফোন কম্পানি প্রতি মিনিটে কলচার্জ নিত সাত টাকা। আর আজ সেই চার্জ হলো মাত্র ৫০ পয়সা! গ্যাস ব্লক ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারেনি। হয়তো সেটা সম্ভবও ছিল না। বিশ্বব্যাপী কতিপয় ইউরোপীয় ও আমেরিকান তেল-গ্যাস কম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করে চলেছে। বাংলাদেশেও তারা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হয় তাদের ইজারা অন্য কম্পানির কাছে অতি লাভে বিক্রি করে দিয়েছে, নতুবা নিত্যনতুন এমন কিছু শর্ত চুক্তির সঙ্গে এনে জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজের গ্যাস আরো বেশি মূল্যে কিনতে বাধ্য হচ্ছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের একটি গ্যাস ফিল্ড থেকে সান্টোস নামের একটি বিদেশি গ্যাস কম্পানিকে তৃতীয় পক্ষের কাছে, অন্য কথায় বাজার মূল্যে গ্যাস বেচার অনুমতি দিয়েছে। অথচ মূল চুক্তিতে পূর্বাহ্নে স্থিরকৃত মূল্যে শুধু পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বেচতে হবে বলে উল্লিখিত ছিল। বাংলাদেশের মতো দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে বিদেশি কম্পানিগুলো যখনই সুযোগ দেখে, তখনই টাকা ও ঘুষ দিয়ে অন্যায় শর্ত জুড়ে দিতে চেষ্টা করে। কোনো বিরোধ দেখা দিলে সেই বিরোধের মীমাংসা করতে হয় আবার আন্তর্জাতিক কোর্টগুলোতে- যেগুলোর রায় প্রায় ক্ষেত্রেই বিদেশি কম্পানির পক্ষে যায়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশি কোর্টে গিয়ে বেশির ভাগ মামলায় শুধু হেরেছে এবং বাংলাদেশ তার ন্যায্য পাওনা থেকে বারবার বঞ্চিত হয়েছে। একটা দেশ বিদেশি বিনিয়োগ থেকে কী পরিমাণ উপকৃত হবে সেটা নির্ভর করছে কী শর্তে বা কোন ধরনের চুক্তির মাধ্যমে ওই বিনিয়োগ আসছে। সবচেয়ে ভালো হয়, যে ক্ষেত্রে আসছে সে ক্ষেত্রে যদি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা যায়। এর বিকল্প হলো, ভালোভাবে দর কষাকষি করে বিদেশি বিনিয়োগ আনা। বিদেশি বিনিয়োগ থেকে লাভ পাওয়ার অন্যতম ভালো উপায় হলো, ওই সব বিনিয়োগে সরকার অথবা স্থানীয় জনগণের জন্য মালিকানা রাখার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশে গ্রামীণ টেলিফোনের বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে একটা ভালো উদাহরণ। জনগণের চাহিদার মুখে নরওয়ের টেলিফোন কম্পানি টেলিনর, যে কম্পানি গ্রামীণফোনের বেশির ভাগ অংশের মালিক। ১০ শতাংশ ইক্যুইটি বা মালিকানা জনগণের কাছে আইপিও বা গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে বেচতে বাধ্য হয়েছে। গ্রামীণফোন হলো একমাত্র বিদেশি টেলিফোন কম্পানি, যেটি আমাদের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এর অর্থ হলো, গ্রামীণফোন লাভ করলে সে লাভ আনুপাতিক হারে এ দেশের জনগণও পাবে। কিন্তু অন্যান্য টেলিফোন কম্পানির ক্ষেত্রে সেটা কেন হবে না। সেটার মালিক বিদেশি কম্পানি ওরাসকম। যতক্ষণ পর্যন্ত এরা শেয়ারবাজারে না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ দেশের জনগণ ওই ফোন কম্পানির লাভের কোনো অংশ পাবে না। শেষ কথা হলো, বাংলাদেশের মতো দেশে বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হলে আগে দেশীয় উৎস থেকে বিনিয়োগ
বাড়াতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.