বাংলাদেশে
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তি আসছে
না কেন
ড.
সা'দত
হুসাইন
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে
এরশাদ সরকারের
পতনের পর
১৯৯১ সালের
সাধারণ নির্বাচনের
মাধ্যমে দেশে
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়। এর
আগে দেশের
সাধারণ নির্বাচনগুলো
শাসক দলের
কঠোর নিয়ন্ত্রণে
অনুষ্ঠিত হয়েছে
এবং প্রতিটি
নির্বাচনে শাসক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন
পেয়ে আবার
মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে
বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ
আসন পেয়ে
সরকার গঠন
করে।
আওয়ামী লীগ
প্রধান বিরোধী
দল হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করে। তার পর
থেকে দুই
যুগ ধরে
দেশের শাসনভার
আওয়ামী লীগ
এবং বিএনপি-
এই দুই
দলের মধ্যেই
অদল-বদল
হয়েছে; প্রতি
নির্বাচনেই ক্ষমতার পালাবদল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তৃতীয়
এবং চতুর্থ
স্থানে রয়েছে
জাতীয় পার্টি
এবং জামায়াতে
ইসলামী।
কয়েকটি ছোটখাটো
দলের নেতৃস্থানীয়
প্রার্থী নির্বাচনে
জয়লাভ করলেও
তাঁদের আসনসংখ্যা
অত্যন্ত নগণ্য;
বেশির ভাগ
প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
আওয়ামী
লীগ এবং
বিএনপি একা
বা তাদের
জোটভুক্ত দলকে
নিয়ে পালাক্রমে
সরকার গঠন
করলেও আমজনতা
তথা ভোটাররা
ক্ষমতাসীন অবস্থায় তাদের কার্যকলাপে চরম
অসন্তুষ্ট হয়েছিল। মানসিকভাবে সংক্ষুব্ধ
হয়ে পড়েছিল
এমনটি বললেও
অত্যুক্তি হবে না। ক্ষমতাসীন
দল যখন
অত্যাচার-অনাচারে
লিপ্ত হয়,
বিরোধী দল
তখন প্রতিবাদী
শক্তি হিসেবে
আবির্ভূত হয়। জনতা
তখন সেই
দলে শামিল
হয়, পরবর্তী
নির্বাচনে নির্যাতিত প্রতিবাদী দল হিসেবে
তাদের সমর্থন
করে, ভোট
দিয়ে ক্ষমতায়
বসায়।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হয়ে এ
দল এমন
সব কাজ
করে যে
জনতা আবার
বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আগের
ক্ষমতাসীন দল, যারা বর্তমানে বিরোধী
দল, এবার
প্রতিবাদী গোষ্ঠীরূপে আবির্ভূত হয়।
জনতা নিপীড়িত
প্রতিবাদী দল হিসেবে তাদের সমর্থন
করে, তারা
আবার নির্বাচিত
হয়।
জনতা প্রথমে
দারুণ খুশি
হয়, ধীরে
ধীরে তাদের
কার্যকলাপে, তথা অপকর্মে হতাশ হয়,
বিক্ষুব্ধ হয়। তারা দেখতে
পায় প্রকৃতপক্ষে
তারা বারবার
পরাজিত হয়েছে। অবশেষে
নিজেদের স্বার্থে
এবং জাতীয়
স্বার্থে তারা
বিকল্প সংগঠন,
দল বা
নেতৃত্বের সন্ধান করছে। এই
বিকল্পকেই কেউ কেউ তৃতীয় শক্তি
হিসেবে অভিহিত
করছে।
তবে
যোগরূঢ় অর্থে
তৃতীয় শক্তি
বলতে সামরিক
শক্তি বা
সামরিক সংগঠনকে
বোঝায়।
আজ থেকে
সাত-আট
বছর আগে
বিকল্প চিন্তাধারার
বেসামরিক সংগঠনকেও
তৃতীয় শক্তি
হিসেবে মাঝেমধ্যে
উল্লেখ করা
হতো।
এসব সংগঠন
পরবর্তী সময়
কার্যকর কোনো
ভূমিকা রাখতে
ব্যর্থ হওয়ায়
তৃতীয় শক্তি
হিসেবে তাদের
অবস্থান এবং
অভিধার বিলোপ
ঘটে।
২০০৭ সালে
সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন
সরকার প্রতিষ্ঠিত
হলে সামরিক
বাহিনীর সঙ্গে
তৃতীয় শক্তি
নামকরণ যুক্ত
হয়ে যায়। বর্তমানে
তৃতীয় শক্তি
বলতে সাধারণ
মানুষ সামরিক
বাহিনীকেই বুঝে থাকে।
বর্তমানে
দুই বৃহৎ
রাজনৈতিক দলের
বিকল্প হিসেবে
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তির কথাই
মানুষ চিন্তা
করে।
তবে এ
চিন্তাধারার কিছু স্বাতন্ত্র্য বা অভিনবত্ব
রয়েছে।
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তি মানে
তৃতীয় বৃহত্তম
রাজনৈতিক দল
নয়।
তৃতীয় বৃহত্তম
রাজনৈতিক দল
হিসেবে জাতীয়
পার্টি অথবা
জামায়াতে ইসলামীকে
সহজেই চিহ্নিত
করা যায়। কিন্তু
তারা তৃতীয়
রাজনৈতিক শক্তি
নয়।
গতানুগতিক ধারার কোনো দলকে তৃতীয়
রাজনৈতিক শক্তি
হিসেবে বিবেচনা
করা হয়
না।
জাতীয় পার্টি
একসময় ক্ষমতায়
আসীন ছিল। সময়ান্তরে
তারা দুটি
বৃহৎ রাজনৈতিক
দলের সহযোগী
হিসেবে কাজ
করেছে।
তাদের কোনো
স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা কিংবা কর্মধারা
পরিলক্ষিত হয়নি। জামায়াত একটি
ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী রাজনৈতিক দল।
তারাও বিভিন্ন
সময়ে দুই
বৃহত্তম দলের
সহযোগী দল
ছিল, তবে
বিএনপির সঙ্গে
তাদের সংযোগ
বেশি।
তারা স্বাধীনতার
বিরুদ্ধে ছিল,
তাদের অনেক
কেন্দ্রীয় নেতা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত। সাধারণ
নাগরিকের কাছে
এ দুই
দলের কোনোটিই
সমাদৃত নয়। সাধারণ
মানুষ ধ্যানে-জ্ঞানে যাদের
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তি হিসেবে
দেখতে চায়,
এই দুই
দলের কোনোটিই
তার অন্তর্ভুক্ত
নয়।
চিন্তাচেতনার দিক থেকে বাম দলগুলোর
প্রতি এক
শ্রেণীর শিক্ষিত
নাগরিকদের সহানুভূতি থাকলেও এরা এত
বেশি বিভক্ত
এবং জনসমর্থনের
দিক থেকে
এতই দুর্বল
যে এদের
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তি হিসেবে
বিবেচনায় আনা
যায় না। এক
কথায়, বাম
দলগুলোর কোনো
গণ-আবেদন
নেই।
গণ-আবেদন রয়েছে
এমন দলকেই
জনগণ তৃতীয়
রাজনৈতিক দল
হিসেবে গ্রহণ
করতে চায়। গণ-আবেদনের জন্য
আকর্ষণীয় স্লোগান,
গণমনজয়ী কর্মসূচি
এবং বিশ্বাসযোগ্য
নেতৃত্বের প্রয়োজন। বিশদ কর্মসূচি
না থাকলেও
অন্ততপক্ষে সুলিখিত এবং সুসংহত প্রতিশ্রুতি
থাকতে হবে। প্রতিশ্রুতির
আঙ্গিক হবে
নিম্নরূপ- (১) মানবাধিকার এবং সুনির্বাচনসহ
গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা হবে,
(২) সর্বস্তরে
সুশাসন নিশ্চিত
করা হবে,
(৩) স্বাধীনতা
এবং এর
চিন্তাচেতনার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন
করা হবে,
(৪) দেশে
প্রকৃত অর্থে
ন্যায়াচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা
হবে, (৫)
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দলবাজির অবসান
করা হবে,
(৬) প্রতিহিংসার
রাজনীতি পরিত্যাজ্য
হবে, (৭)
সর্বস্তরে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হবে,
(৮) প্রশাসনে
নিয়মনিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সুরক্ষণ
করা হবে,
(৯) জনগণ
এবং দেশের
স্বার্থকে দল ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হবে,
(১০) কোনোভাবেই
সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে
না, (১১)
পরিবেশ বিধ্বংসী
সব রকম
কার্যকলাপ- বিশেষ করে খাল-বিল,
নদী, মাঠ,
জলাভূমি, বনের
দখলবাজি কার্যকরভাবে
প্রতিহত করা
হবে, (১২)
কোনো অজুহাতে
বিদেশিদের কাছে দেশীয় স্বার্থ বিকিয়ে
দেওয়া হবে
না।
তালিকা দীর্ঘ
করা যায়,
তবে বাস্তবতার
নিরিখে তা
যুক্তিসংগত মনে হলো না।
অবশ্য কোনো
কোনো ক্ষেত্রে
এর ব্যাখ্যা
এবং সম্প্রসারণের
প্রয়োজন হবে।
উপরোক্ত
নীতিগুলোকে সমর্থন করে এমন লোকের
অভাব নেই। বৈঠকী
আলাপে কিংবা
সেমিনার-ওয়ার্কশপে
এ নীতিগুলোর
পক্ষে বক্তব্য
রাখেন এমন
লোকের সংখ্যাও
খুব কম
নয়।
তবে নীতিগুলোর
সমর্থনে জনসমক্ষে
বক্তব্য রাখবেন
এবং জনমত
সৃষ্টিতে সক্রিয়
ভূমিকা রাখবেন-
এমন লোকের
সংখ্যা তেমন
বেশি নয়। কোনো
সংগঠনের মাধ্যমে
উল্লিখিত নীতিগুলোর
বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করতে রাজি
আছেন এমন
লোকের সংখ্যা
খুবই কম। হাতেগোনা
কয়েকজন হতে
পারে।
বিদ্যমান সংগঠনের
মাধ্যমে অথবা
নতুন সংগঠন
গড়ে নীতিগুলো
বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর নেতৃত্ব দিতে
পারেন এমন
লোক খুঁজে
পাওয়া বাংলাদেশে
বর্তমানে দুষ্কর
হয়ে পড়েছে। কার্যকর
নেতৃত্ব দিতে
হলে সংগ্রাম
করতে হবে,
জেল-জুলুম,
নিপীড়ন সহ্য
করতে হবে। সংগঠনকে
সক্রিয় রাখার
সামর্থ্য থাকতে
হবে।
সর্বোপরি জনগণের
আস্থা অর্জন
করে তাদের
নীতিগুলোর পক্ষে কাজ করার লক্ষ্যে
উদ্বুদ্ধ করতে
হবে।
জনগণের
দৃষ্টি আকর্ষণের
জন্য, তাদের
প্রাথমিক বিশ্বাস
ও আনুগত্য
অর্জনের জন্য
নেতৃত্বাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিকে সাধারণভাবে
সুপরিচিত হতে
হবে।
ব্যাপকভাবে খ্যাতিমান হলে আরো ভালো
হয়।
বিকল্প হিসেবে
কঠোর একাগ্রতা,
ধৈর্য, নিষ্ঠা
এবং সর্বোপরি
নেতৃত্বের দক্ষতা ও চিত্তাকর্ষক কর্মপদ্ধতি,
কর্মকৌশলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি নেতৃত্বে
সমাসীন হতে
পারেন।
এ ক্ষেত্রে
কৌশলী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে
তার নিজস্ব
নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত
করতে হবে। বাংলাদেশের
রাজনীতিতে এরূপ নেতৃত্বের আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে
উড়িয়ে দেওয়া
যায় না। আপাতত
এ ধরনের
উদীয়মান নেতৃত্বের
বিকাশ লক্ষ
করা যাচ্ছে
না।
জনগণের
দৃষ্টি এখন
সুপরিচিত, সুনামধারী ও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের
দিকে।
তাঁদের বিশ্বাস,
এই শ্রেণীর
ব্যক্তির মধ্য
থেকেই একজন
কেউ এগিয়ে
আসবেন।
জাতিকে নতুন
পথে চলার
সাহস এবং
শক্তি জোগাবেন। তাঁর
নেতৃত্বে তাঁরা
একটি সুখী-সমৃদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ,
দুর্নীতিমুক্ত এবং গণবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠা
করবে।
এ রকম
বেশ কয়েকজন
ব্যক্তির কথা
তাঁদের মনে
আসে।
কিন্তু এসব
ব্যক্তি এগিয়ে
আসার জন্য
প্রস্তুত হয়েছেন
বলে মনে
হয় না। তাঁরা
আদৌ এগিয়ে
আসবেন কি
না সে
সম্পর্কে নিশ্চিত
করে কিছু
বলা যায়
না।
এদের মধ্যে
দু-একজনের
যোগ্যতা এবং
বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে জনগণ যথেষ্ট আশাবাদী। এতদসত্ত্বেও
তাঁরা কেন
এগিয়ে আসছেন
না অথবা
যাঁরা নতুন
কিছু করবেন
বলে রাজনৈতিক
দল গঠন
করেছিলেন, তাঁরা কেন সফল হতে
পারেননি সে
সম্পর্কে কিছু
আলোচনা প্রাসঙ্গিক
হবে।
দু-একজন শিক্ষিত,
প্রজ্ঞাবান এবং সুখ্যাত ব্যক্তি নিজেদের
রাজনৈতিক দল
গঠন করে
দুর্নীতি এবং
অত্যাচার-অনাচারের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম
করার প্রত্যয়
ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু
জোরালো কোনো
আন্দোলন করার
শক্তি সঞ্চয়
করতে পারেননি। রাজনৈতিক
দলের মাধ্যমে
আন্দোলন-সংগ্রাম
জোরদার করতে
হলে নিজের
রাজনৈতিক দলকে
সুসংগঠিত এবং
জনপ্রিয় সংগঠন
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
করতে হয়। এ
জন্য যে
আন্তরিকতা, শ্রম এবং ত্যাগী মনোভাবের
প্রয়োজন হয়,
উল্লিখিত শিক্ষিত
এবং প্রজ্ঞাবান
ব্যক্তিবর্গের সে রকম আন্তরিকতা বা
মনোভাব আছে
বলে মনে
হয় না। এসব
শিক্ষিত এবং
প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি উচ্চ মধ্যবিত্ত।
তাঁরা আরাম-আয়েশ, রুজি-রোজগার এবং
বিদেশ ভ্রমণে
আসক্ত।
এসব ছেড়ে
নিরন্তর রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে তাঁরা রাজি
নন।
রাজনীতি তাঁদের
জন্য অনেকটা
ছুটিকালীন 'হবি'। এই জীবনধারা
নিয়ে ইস্যুভিত্তিক
বড় রকমের
রাজনৈতিক আন্দোলন
গড়ে তোলা
সম্ভব নয়। আবার
দেখা গেছে,
কোনো সু-উচ্চ মর্যাদার
অতিপরিচিত ব্যক্তি আদর্শভিত্তিক নতুন ধারার
রাজনীতি প্রবর্তনের
আশ্বাস দিয়ে
রাজনৈতিক দল
গঠন করেছেন। পরে
প্রতীয়মান হয়েছে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের
প্রতি আসলে
তাঁর কমিটমেন্ট
নেই, তিনি
কঠোর পরিশ্রম
করতে রাজি
নন, সবাইকে
নিয়ে এগিয়ে
যাওয়ার তাঁর
সামর্থ্য নেই,
বরং দলে
পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর প্রবল
ঝোঁক।
তাঁর অনুসারীরা
একে একে
তাঁকে ছেড়ে
চলে গেছে। এখন
তিনি একা। তাঁর
পক্ষে আর
কিছু করা
সম্ভব হবে
বলে মনে
হয় না।
এ
ছাড়া বিশাল
মাপের মুক্তিযোদ্ধা,
সুপ্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতা, স্বাধীনতাযুদ্ধের
অন্যতম সংগঠক,
অতীতে উচ্চপদে
অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা
অনেকেই রাজনৈতিক
দল করে
এগোতে চেষ্টা
করেছেন।
কিন্তু তাঁদের
প্রাক-রাজনৈতিক
এবং রাজনীতি
করাকালীন জীবন-বৃত্তান্ত এমন
যে তাঁদের
প্রতি জনসাধারণ
আকৃষ্ট হয়নি। জনতা
আকর্ষণ করার
মতো সম্মোহনী
শক্তি তাঁদের
নেই।
অথবা জনতা
তাঁদের ব্যাপারে
আগে থেকেই
মোহমুক্ত।
আইয়ুব খানের
মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে বিষণ্ন
জুলফিকার আলী
ভুট্টো ইসলামাবাদ
থেকে করাচির
ট্রেনে যাত্রা
শুরু করেছিলেন। ট্রেন
লাহোরে থামার
পর হাজার
হাজার জনতা
'জিয়ে ভুট্টো,
জিয়ে ভুট্টো'
স্লোগান দিয়ে
ট্রেনটি ঘিরে
ধরে।
ভুট্টোর জীবনে
নতুন যাত্রা
এবং পাকিস্তানের
রাজনীতিতে নতুন মাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশে
যাঁরা নতুন
ধারার রাজনীতির
কথা বলে
যাত্রা শুরু
করেছেন, তাঁরা
জনতাকে সেভাবে
আকৃষ্ট করতে
পারেননি।
পথযাত্রায় কিংবা জনসভায় লোক আকর্ষণের
দিক থেকে
এখন পর্যন্ত
হাসিনা-খালেদার
কোনো জুড়ি
আছে বলে
মনে হয়
না।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হিসেবে অন্য কোনো
রাজনৈতিক নেতা
মাঠে আসেননি।
দেশের
বর্তমান অবস্থায়
প্রায় সব
শিক্ষিত সুজন
দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। ড্রইংরুমের আলোচনায়
তাঁরা খুবই
সোচ্চার।
মনে হয়
যেন তাঁদের
ক্ষোভের সীমা-পরিসীমা নেই। তাঁরা
মনে-প্রাণে
এই অবস্থার
দ্রুত পরিবর্তন
চান।
এ লক্ষ্যে
নতুন কোনো
রাজনৈতিক নেতা
কেন এগিয়ে
আসছেন না
সে জন্য
তাঁদের ক্ষোভের
সীমা নেই। তাঁরা
নিজেরা কেউ
এগিয়ে আসতে
রাজি নন। প্রশ্নোত্তরে
বিশদ আলোচনা
করে আমি
জানতে পেরেছি
তাঁদের এগিয়ে
না আসার
কারণ।
তাঁরা আরাম-আয়েশের জীবনে
আসক্ত।
হামলা-মামলা,
জেল-জুলুমকে
তাঁদের দারুণ
ভয়।
দেশের একজন
রাষ্ট্রপতিকে নতুন দল করার কারণে
রেললাইন ধরে
অমানবিকভাবে তাড়া করা হয়েছে, নিজেদের
দলের সাবেক
সংসদ সদস্যের
কারখানা ভাঙচুর
করা হয়েছে,
সাবেক প্রতিমন্ত্রীর
বাড়ি জ্বালিয়ে
দেওয়া হয়েছে। মামলার
তো শেষ
নেই।
যে লোকই
শাসক দলের
বিরুদ্ধে কথা
বলে, তার
বিরুদ্ধে বিভিন্ন
জেলায় নানা
অজুহাতে মামলা
করা হয়। সেসব
জেলার কোর্ট-কাছারিতে উপস্থিত
হওয়া যেমন
হয়রানিমূলক, তেমনি দলীয় ক্যাডারের আক্রমণের
শিকার হওয়া
রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ
এবং বিব্রতকর। মামলায়
জেল-হাজতবাস
অস্বাভাবিক কিছু নয়। শিক্ষিত
সুজনরা এসব
জেল-জুলুম-অত্যাচারের মধ্যে
যেতে চান
না।
এমনকি রোদের
মধ্যে রাস্তায়
হেঁটে মিছিল
করা বা
দাঁড়িয়ে মানববন্ধন
করাকেও তাঁরা
অনেকে সহনীয়
কাজ বলে
মনে করেন
না।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
কক্ষে সভা-সম্মেলনে যেতে
তাঁরা রাজি
আছেন।
জেলখানার কক্ষ
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
হলে প্রতিবাদ
আন্দোলনে যোগ
দিতে তাঁদের
হয়তো তত
আপত্তি থাকত
না।
বর্তমান অবস্থায়
ড্রইংরুমের প্রতিবাদী আড্ডা কিংবা গোলটেবিল
আলোচনার মধ্যেই
তাঁদের কর্মতৎপরতা
সীমিত রাখার
পক্ষপাতী।
তাঁদের
চিন্তাধারা অযৌক্তিক বা অসংগতিপূর্ণ এমনটি
বলা ঠিক
হবে না। তাঁরা
মনে করেন,
শাসক দলকে
ভোট দিয়ে
তাঁরা প্রতারিত
হয়েছেন।
পরবর্তী জাতীয়
নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে ভোট
দিয়ে তাঁরা
এর প্রতিশোধ
নেবেন।
কালক্রমে যদি
ভিন্ন প্রকৃতির
কোনো শাসকগোষ্ঠী
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হয়ে উল্লিখিত
স্লোগান দিয়ে
রাজনৈতিক দল
গঠন করে,
তবে তাঁদের
অনেকেই সে
দলে যোগ
দেবেন।
এক কথায়,
শাসক দলের
অন্যায়-অত্যাচারকে
তাঁরা ঘৃণা
করেন; কিন্তু
শাসক দলের
হাতে তাঁরা
নিগৃহীত হতে
চান না। হত্যা,
গুমের রাজনীতি
শুরু হওয়ার
পর তাঁরা
আরো আতঙ্কিত। জীবন-মৃত্যু আল্লাহর
ইচ্ছায়, অথবা
ভাগ্যের হাতে-
এ বিশ্বাসে
বলীয়ান হয়ে
অন্তত এক
বছর কারাবাসের
জন্য মানসিক
প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগদানের
সংকল্প তাঁদের
চিন্তার বাইরে।
মধ্যবিত্তের
খপ্পরে পড়েছে
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তির উত্থানের
সম্ভাবনা।
উদার গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় (Liberal Democratic
Dispensation) অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে
শ্রেণী-সংগ্রামে
বিশ্বাসী কোনো
সর্বহারা দলের
তৃতীয় রাজনৈতিক
শক্তি হিসেবে
আবির্ভূত হওয়ার
সম্ভাবনা নেই। শিক্ষিত
সুজন কোনো
ব্যক্তির নেতৃত্বে
শুধু একটি
উদার গণতান্ত্রিক
দল এ
সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। তিনটি
অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এই নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত
করবে।
এগুলো হচ্ছে
সাহস, সংকল্প
এবং উদাত্ত
আহ্বান (courage, commitment and clarion
call)। এই তিন
বৈশিষ্ট্যের সমাহারে সুগঠিত নেতৃত্ব বাংলাদেশে
পাওয়া যাচ্ছে
না।
কখন পাওয়া
যাবে অথবা
আদৌ পাওয়া
যাবে কি
না সে
সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা
যাচ্ছে না। যদি
কখনো পাওয়া
যায়, তবেই
ঘটবে তৃতীয়
রাজনৈতিক শক্তির
উত্থান।
লেখক
: সাবেক চেয়ারম্যান,
পিএসসি ও
সাবেক
মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.