Friday, July 26, 2013

বঙ্গবন্ধুর জনসম্মুখে দেয়া শেষ ভাষণ (এ ভাষণ নয়, বাংলার ইতিহাস)-১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ

বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায়ও এভাষণটি কতটা প্রাসঙ্গিক তা পড়তে গেলেই টের পাওয়া যায়। অনেক প্রশ্ন ও তার উত্তর ইতিহাসের ধুলোয় ঢেকে যাওয়া এভাষণটিতে রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু এই ভাষণটি জাতির উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন। এটাই তাঁর জীবনে জনসম্মুখে দেয়া শেষভাষণ। সুদীর্ঘ এই ভাষণটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তার বিরুদ্ধে করা অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, তার প্ল্যানিং,আশা-হতাশা,তৎকালীন বাস্তবতা, তাঁর সীমাবদ্ধতা, বিশ্বপরিস্থিতি প্রায় সবকিছুরই জবাব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষনটি যেমন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নির্দেশ করে ঠিক তেমনই ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চের এই অসাধারন ভাষনটি স্বাধীনতাপরবর্তি বাংলাদেশকে নির্দেশ করে। এই ভাষণটির অনুলিখন ১৯৭৯ সালের ১৫ই আগষ্ট তৎকালীন আওয়ামীলীগ থেকে প্রকাশিত স্মরনিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল। 

কি পরিস্থিতিতে তিনি দেশের হাল ধরেছিলেন। দেশের খাদ্য মজুদ কোন অবস্থায় তখন ছিলো, ভুট্টোকে কোন পরিস্তিতিতে ঢাকায় লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিলো, লুটেরা-সুযোগসন্ধানিরা কি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো, রাজনীতিতে কি ভয়াবহ অবস্থা তখন বিরাজমান ছিলো, তার সীমাবদ্ধতাও কতটা প্রকট ছিলো, দেশ নিয়ে তার নতুন কি প্ল্যান ছিলো সবকিছুরই ব্যাখ্যা তিনি তার এই ভাষণে দিয়েছিলেন।

এই ভাষনটা পড়ে ৭৫ এর আগষ্ট এর দুঃখজনক ঘটনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভাষণটি পাঠেই বোঝা যায়, আগষ্টের ভয়াবহ ঘটনা না ঘটাটাই অসম্ভবছিলো এ দুর্ভাগা দেশে। কারন তিনি এই ভাষনেই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন এদেশটাকে সোনার বাংলা করতে হলে কাদেরকে ডিএক্টিভেট করতে হবে। আর যারাই তার টার্গের্টে পরিনত হয়েছিলো এভাষণের পরপর তারাই তাঁকে সরিয়ে দেয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।

বর্তমান আওয়ামীলীগও বঙ্গবন্ধুর এভাষণটির প্রচারে আগ্রহী নয় কারন তাদের বর্তমান নীতির সাথে এভাষণের বঙ্গবন্ধু একটুও খাপ খায় না। আজ যদি বঙ্গবন্ধু ওপার থেকে এসে তার এই প্ল্যান কার্যকর করার চেষ্টা করেন তাহলে তার কন্ঠ স্তব্ধ করতে বর্তমান আওয়ামীলীগাররাই সবার আগে এগিয়ে আসবেন, বাকীদের কথা এখানে নাইবা বললাম।

ইতিহাসের ধুলোয় চাপা পড়ে যাওয়া সেই ভাষণটি হুবহু এখানে তুলে ধরা হলো: 

আমার ভাই ও বোনেরা আজ ২৬শে মার্চ। ২৫শে মার্চ রাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। সেদিন রাত্রে বি ডি আরের ক্যাম্পে, আমার বাড়ীতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চারদিকে আক্রমণ চালায় ও নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশবিক শক্তি নিয়ে। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়েছিলাম। ৭ই মার্চ আমি তাদের প্রস্তুত করে দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, সেই মুহূর্তে আবার আমি ডাক দিয়েছিলাম। আর নয়, মোকাবিলা কর। বাংলার মানুষও যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। বাংলার মাটি থেকে শত্রুকে উৎখাত করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

দুনিয়ার মানুষের কাছে আমি সাহায্য চেয়েছিলাম। আমার সামরিক বাহিনীতে যারা বাঙালী ছিল, তাদের এবং আমার বি ডি আর, আমার পুলিশ, আমার ছাত্র, যুবক ও কৃষকদের আমি আহবান করেছিলাম। বাংলার মানুষও রক্ত দিয়ে মোকাবিলা করেছিল। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছিল, শত শত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। দুনিয়ার জঘন্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানী শোষক শ্রেণী। দুনিয়ার ইতিহাসে এত রক্ত স্বাধীনতার জন্য কোন দেশ দেয় নাই, যা বাংলার মানুষ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা পঙ্কিলতা শুরু করলো। যা কিছু ছিল ধ্বংস করতে আরম্ভ করলো। ভারতে আমার এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল। তার জন্য আমরা নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব। আমি তাদের স্মরণ করি, খোদার কাছে তাদের মাগফেরাত কামনা করি, যারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, আত্মহুতি দিয়েছে। আমি তাদের স্মরণ করব, যে সকল মুক্তিবাহিনীর ছেলে, যেসব মা-বোনেরা, আমার যে কর্মী বাহিনী আত্মাহুতি দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এদেশ তাদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা জীবন দিয়েছিল বাংলার মাটিতে, আজ তাদের কথাও আমি স্মরণ করি।

এখানে একটা কথা। আপনাদের মনে আছে, পাকিস্তানীরা যাওয়ার পূর্বে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে, কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করব, সম্পদ ধ্বংস করব, বাঙালী স্বাধীনতা পেলেও এই স্বাধীনতা রাখতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ, বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা হয়েছে। বাংলার লোক স্বাধীন হয়েছে। বাংলার পতাকা আজ দুনিয়ায় ওড়ে। বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘের সদস্য। বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর সদস্য, কমনওয়েলথের সদস্য, ইসলামী সামিটের সদস্য। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।

ভাইয়েরা-বোনেরা আমার, আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি, জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রের সংগে বন্ধুত্ব চাই। আমরা জোটনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাস করি, আমরা কো-একজিস্টেন্সে বিশ্বাস করি। আমরা ভেবেছিলাম, পাকিস্তানীরা নিশ্চয়ই দুঃখিত হবে, আমার সম্পদ ফেরত দেবে। আমি ওয়াদা করেছিলাম, তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি। তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এই জন্য যে, এশিয়ায়-দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানীরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিল না। আমার বৈদেশিক মুদ্রার কোন অংশ আমাকে দিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভের কোন অংশ আমাকে দিল না। একখানা জাহাজও আমাকে দিল না। একখানা প্লেনও আমাকে দিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ এক পয়সাও দিল না। এবং যাবার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলো, রাস্তা ধ্বংস করলো, রেলওয়ে ধ্বংস করলো, জাহাজ ডুবিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত কারেন্সী নোট জ্বালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানীরা মনে করেছিল, বাংলাদেশকে যদি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে দেখাতে পারব যে, তোমরা কি করছো।

ভুট্টো সাহেব বক্তৃতা করেন। আমি তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম লাহোরে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বলে। ভুট্টো সাহেব বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কি? ভুট্টো সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ফ্রণ্টিয়ারের পাঠানদের অবস্থা কী? ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, বেলুচিস্তানের মানুষের অবস্থা কী? এরোপ্লেন দিয়ে গুলী করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর মানুষের অবস্থা কী? ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান। নিজের কথা চিন্তা করুন। পরের জন্য চিন্তা করবেন না। পরের সম্পদ লুট করে খেয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। আমার সম্পদ ফেরত দেওয়া না পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না। তোমরা আমার কি করেছো? আমি সবার বন্ধুত্ব কামনা করি। পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নাই। কিন্তু আমার সম্পদ তাকে দিতে হবে।

আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব চাই, কারো সাথে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই। আমার মানুষ দুঃখী, আমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন জেল থেকে বের হয়ে এলাম, তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। গত তিন চার বৎসরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে। বাইশ শ’ কোটি টাকার মত বিদেশ থেকে হেল্‌প আমরা পেয়েছি। সেজন্য যারা আমাদের সাহায্য করেছে, সে সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্রকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

কিন্তু আর একটি কথা। অনেকে প্রশ্ন করেন, আমরা কি করেছি? আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম, দেশের ভার নিলাম, তখন দেশের রাস্তাঘাট যে অবস্থায় পেলাম, তাকে রিপেয়ার করবার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনী নাই, প্রায় ধ্বংস করে গেছে। পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভাল করতে কী করি নাই? আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না। আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না, বৈদেশিক ডিপার্টম্নেট ছিল না, প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। এখানে কিছুই ছিল না। তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হল। যাঁরা শুধু কথা বলেন, তাঁরা বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করে বলুন, কী করেছি। এক কোটি লোককে ঘরবাড়ি দিয়েছি। রাষ্ট্রের লোককে খাওয়ানোর জন্য বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়েছে। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে।

এরপরও কথা আছে। আমি মানুষকে বললাম, আমার ভাইদের বললাম, মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের বললাম, তোমাদের অস্ত্র জমা দাও। তারা অস্ত্র জমা দিল। কিন্তু একদল লোক-আমার জানা আছে, যাদের পাকিস্তান অস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল তারা অস্ত্র জমা দেয় নাই। তারা এসব অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে আরম্ভ করলো। এমনকি, পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্যকেও তারা হত্যা করলো। তবুও আমি শাসনতন্ত্র দিয়ে নির্বাচন দিলাম। কিন্তু যদি বাংলার জনগণ নির্বাচনে আমাকেই ভোট দেয়, তাহলে সেটা আমার দোষ নয়। ৩১৫ টি সিট এর মধ্যে ৩০৭ টি সিট বাংলার মানুষ আমাকে দিল। কিন্তু একদল লোক বলে, কেন জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিল? কোনো দিন কোনো দেশ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে কাউকে এভাবে অধিকার দেয় না। কিন্তু অধিকার ভোগ করতে হলে তার জন্য যে রেসপনসিবিলিটি আছে, সেটা তারা ভুলে গেল। আমি বললাম, তোমরা অপজিশন সৃষ্টি কর। তারা তা সৃষ্টি করলো। বক্তৃতা করতে আরম্ভ করলো। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্ধকারে মানুষ হত্যা করতে আরম্ভ করলো। দরকার হলে অস্ত্র দিয়ে আমাদের মোকাবেলা করতে চায়। অস্ত্রের হুমকি দেওয়া হল। মানুষ হত্যা থেকে আরম্ভ করে রেল লাইন ধ্বংস করে, ফার্টিলাইজার ফেক্টরি ধ্বংস করে, জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করলো যাতে বিদেশী এজেন্ট যারা দেশের মধ্যে আছে, তারা সুযোগ পেয়ে গেল। আমাদের কর্তব্য মানুষকে বাঁচানো। চারিদিকে হাহাকার। স্বাধীনতা পাওয়ার সংগে সংগে সমস্ত দুনিয়ার সমস্ত জিনিষের দাম আস্তে আস্তে বেড়ে গেল। সমস্ত দুনিয়া থেকে আমাদের কিনতে হয়। খাবার কিনতে হয়, কাপড় কিনতে হয়, ঔষধ কিনতে হয়, তৈল কিনতে হয়। আমরা তো দুইশ’ বছর ইংরেজদের কলোনী ছিলাম, পঁচিশ বছর পাকিস্তানের কলোনী ছিলাম। আমাদের তো সব কিছুই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু তার পরেও বাংলার মানুষ কষ্ট স্বীকার করে কাজ করতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তারা তাদের এগোতে, কাজ করতে দেয় না।আর একদল বিদেশে সুযোগ পেল। তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলো। স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করবার চেষ্টা করলো। আজ এদিনে কেন বলছি একথা? অনেক বলেছি, এত বলার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার চোখের সামনে মানুষের মুখ ভাসে। আমার দেশের মানুষের রক্ত ভাসে। আমার চোখের সামনে ভাসে আমারই মানুষের আত্মা। আমার চোখের সামনে সে সমস্ত শহীদ ভাইয়েরা ভাসে, যারা ফুলের মত ঝরে গেল, শহীদ হল। রোজ কিয়ামতে তারা যখন বলবে, আমার রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, তোমরা স্বাধীনতা নস্যাৎ করছো, তোমরা রক্ষা করতে পার নাই, তখন তাদের আমি কী জবাব দেব?

আর একটি কথা। কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম ? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য। কথা হল, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, অফিসে যেয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যায়, সাইন করিয়ে নেয়। ফ্রি স্টাইল ! ফেক্টরিতে যেয়ে কাজ না করে টাকা দাবী করে। সাইন করিয়ে নেয়। যেন দেশে সরকার নাই। আবার, শ্লোগান হল- বঙ্গবন্ধু কঠোর হও।

বঙ্গবন্ধু কঠোর হবে। কঠোর ছিল, কঠোর আছে। কিন্তু দেখলাম, চেষ্টা করলাম, এত রক্ত, এত ব্যাথা, এত দুঃখ। তার মধ্যে ভাবলাম, দেখি, কি হয়, কিছু করতে পারি কিনা। আবদার করলাম, আবেদন করলাম, অনুরোধ করলাম, কামনা করলাম, কিন্তু কেউ কথা শোনে না। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।

ভাইয়েরা, বোনেরা আমার, আজকে যে সিস্টেম করেছি, তার আগেও ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না, ক্ষমতা বন্দুকের নলে। আমি বিশ্বাস করি ক্ষমতা বাংলার জনগণের কাছে। জনগন যেদিন বলবে, ‘বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও’। বঙ্গবন্ধু তারপর একদিনও রাষ্ট্রপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালবেসে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শোষণহীন সমাজ কায়েম করবার জন্য।

দুঃখের বিষয় তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্যকে হত্যা করেছে, তিন-চার হাজারের মত কর্মীকে হত্যা করেছে। আরেক দল দুর্নীতিবাজ টাকা-টাকা, পয়সা-পয়সা করে পাগল হয়ে গেছে। তবে যেখানে খালি দুর্নীতি ছিল, গত দুই মাসের মধ্যে ইনশাআল্লাহ্‌, কিছুটা অবস্থা ইম্প্রুভ করেছে। দুর্নীতি বন্ধ করবার জন্য আজকে কিছু করা হয়েছে।

হ্যা, প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্ম অব গভার্মেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্ট এর নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। জনগণ বাছবে, কে ভাল, কে মন্দ। আমরা চাই শোষিতের গনতন্ত্র। এটা পরিষ্কার।

আমি পোগ্রাম দিয়েছি। আজকে আমাদের সামনে কাজ কী? আজকে আমাদের সামনে অনেক কাজ। আমি সকলকে অনুরোধ করব, আপনারা মনে কিছু করবেন না, আমার কিছু উচিৎ কথা কইতে হবে। কারণ, আমি কোন দিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। সত্য কথা বলবার অভ্যাস আমার আছে। মিথ্যা বলবার অভ্যাস আমার নেই। কিন্তু কিছুটা অপ্রিয় কথা বলব।

বন্যা হল। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম! পাঁচ হাজার সাতশ’ লঙ্গরখানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য। আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কি স্বাধীনতা? আপনাদের মনে আছে, আমার কথার মধ্যে দুইটি কথা ছিল। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পড়তে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তা হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।

আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক-মার্কেটিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। যে মজুদ করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারাও দুর্নীতিবাজ, যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণেধরা ইংরেজ আমলের পাকিস্তানী আমলের যে শাসন ব্যবস্থা, তা চলতে পারে না। তাহলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে, না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখে শুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি। এবং তাই জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে শাসনতন্ত্রের মর্মকথা।

আজকে জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। আমার চেয়ে অধিক কে জানতে পারে? বাংলার কোন থানায় আমি ঘুরি নাই, বাংলার কোন যায়গায় আমি যাই নাই? বাংলার মানুষকে আমার মত কে ভাল করে জানে?

আপনারা দুঃখ পান, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। আপনাদের গায়ে কাপড় নাই। আপনাদের শিক্ষা দিতে পারছি না। কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিষ খাদ্য।

একটা কথা বলি আপনাদের কাছে। সরকারী আইন করে কোনো দিন দুর্নীতিবাজদের দুর করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একটি মাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে।আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে- এক নম্বর কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাব। ক্ষমা করব না। যাকে পাব, ছাড়ব না। একটা কাজ আপনাদের করতে হবে। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিষ বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিক বয়কট করতে হবে। একথা মনে রাখতে হবে। গ্রামে গ্রামে মিটিং করে দেখতে হবে, কোথায় আছে, ঐ চোর, ঐ ব্ল্যাক মার্কেটার, ঐ ঘুষখোর। ভয় নাই, আমি আছি। ইনশাল্লাহ, আপনাদের উপর অত্যাচার করতে দেব না। কিন্তু আপনাদের গ্রামে গ্রামে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে পারে কে? ছাত্র ভাইয়েরা পারে। পারে কে? যুবক ভাইয়েরা পারে। পারে কে? বুদ্ধিজীবিরা পারে। পারে কে? জনগণ পারে। আপনারা সংঘবদ্ধ হন। ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করবার জন্য, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করবার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গেছে, কিন্তু এই চোর রেখে গেছে। এই চোর তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম। কিছু দালাল গেছে, চোর গেলে বেঁচে যেতাম।

দ্বিতীয় কথা, আপনারা জানেন, আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুন বেশি ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে ডাবল ফসল করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না, ভিক্ষা করতে হবে না।

ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। একটা লোককে আপনারা ভিক্ষা দেন এক টাকা কি, আট আনা। তারপর তার দিকে কিভাবে চান? বলেন, ‘ও বেটা ভিক্কুক। যা বেটা, নিয়ে যা আট আনা পয়সা।’ কোন জাতি যখন ভিক্ষুক হয়, মানুষের কাছে হাত পারে, মানুষকে বলে, ‘আমাকে খাবার দাও, আমাকে টাকা দাও,’ তার তখন ইজ্জত থাকতে পারে না। আমি সেই ভিক্ষুক জাতির নেতা থাকতে চাই না।

আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে- যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট-পরা কাপড় পরা ভদ্রলোক, তাদের কাছেও চাই, – জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করূন আজ থেকে ঐ শহীদদের কথা স্মরণ করে ডাবল ফসল করতে হবে। যদি ডাবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাবও, ইনশাআল্লাহ্‌, হবে না। কারো কাছে ভিক্ষুকের মত হাত পাততে হবে না।

আমি পাগল হয়ে যাই চিন্তা করে। এ-বৎসর, ১৯৭৫ সালে, আমাকে ছয় কোটি মণ খাবার আনতে হবে। কি করে মানুষকে বাঁচাব? কি করে অন্যান্য জিনিষ কিনব? বন্ধু রাষ্ট্র সাহায্য দিচ্ছে বলে বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ন হয়ে নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে হবে জাতি হিসেবে।

ভাইয়েরা আমার, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ্য লোক বাড়ে, তাহলে ২৫/৩০ বৎসরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না হাল চাষ করবার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হল তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হল – দুর্নীতিবাজ খতম করা। দুই নম্বর হল – কলে কারখানায়, ক্ষেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান। তিন নম্বর হল – পপুলেশন প্ল্যানিং। চার নম্বর হল – জাতীয় ঐক্য।

জাতীয় ঐক্য গড়বার জন্য একদল করা হয়েছে। যারা বাংলাকে ভালবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে, তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবে। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয়, এতে তাদের স্থান নাই। সরকারী কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ, তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে – যে যেখানে আছি, একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগতে হবে।

ভাইয়েরা, বোনেরা আমার, এই জাতীয় দলের আপাতত পাঁচটা ব্রাঞ্চ হবে। একটা শ্রমিক ভাইদের অঙ্গদল, কৃষক ভাইদের একটা, যুবক ভাইদের একটা, ছাত্রদের একটা এবং মহিলাদের একটা। এই পাঁচটা অঙ্গদল মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। আমাকে অনেকে বলে, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তো হল। কিন্তু আমাদের কী হবে? আমি বলি আওয়ামী মানে তো জনগণ। ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ, সরকারী কর্মচারী, সকলে মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।

শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটা কথা। আমরা শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যে, এর বাইরে নয়।

শিক্ষিত সমাজকে আর একটা কথা বলব। আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে, লুঙ্গী পরে, আমরা বলব, ‘এই বেটা, কোত্থেকে আইছিস, বাইরে বয়, বাইরে বয়।’ একজন শ্রমিক যদি আসে বলি ‘ঐখানে দাড়া।’ ‘এই রিক্সাওয়ালা, ঐভাবে চলিস না।’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের তুচ্ছ করেন। এর পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।

সরকারী কর্মচারী বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মত। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ, ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।

একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি, কিছু মনে করবেন না। আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? আমার বাপ-মা। আমরা বলি, বাপ-মা। লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারী পাশ করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? সায়েন্স পাশ করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুখী জনগণের টাকায়। একজন ডাক্তার হতে সোয়া লাখ টাকার মত খরচ পড়ে। একজন ইঞ্জিনিয়ার করতে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকার মত খরচ পড়ে। বাংলার জনগণ গরীব। কিন্তু এরাই ইঞ্জিনিয়ার বানাতে টাকা দেয়, মেডিকেলের টাকা দেয় একটা অংশ।

আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইয়েরা, আপনাদের লেখাপড়ার যে খরচ জনগণ দিয়েছে, তা শুধু আপনাদের সংসার দেখবার জন্য নয়। আপনাদের ছেলেমেয়েদের দেখবার জন্য নয়। দিয়েছে এই জন্য যে, তাদের জন্য আপনারা কাজ করবেন, তাদের সেবা করবেন। তাদের আপনারা কী দিয়েছেন? কী ফেরত দিয়েছেন, কতটুকু দিচ্ছেন? তাদের টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, তাদের টাকায় ডাক্তার সাহব, তাদের টাকায় রাজনীতিবিদ সাহেব, তাদের টাকায় মেম্বার সাহেব, তাদের টাকায় সব সাহেব। আপনারা দিচ্ছেন কী? কী ফেরত দিচ্ছেন? আত্মসমালোচনা করুন। বক্তৃতা করে লাভ নাই। রাতের অন্ধকারে খবরের কাগজের কাগজ ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সকাল বেলা বড় বড় কথা লেখার দাম নেই। রাতের বেলা ঔষধ ব্ল্যাক মার্কেটিং করে বড় বড় কথা বলার দাম নাই। হোটেল ইন্টারকন্টিনেণ্টালে মদ খেয়ে অনেস্টি এর কথা বলার দাম নেই। আত্মসমালোচনা করুন, আত্মশুদ্ধি করুন। তাহলেই হবেন মানুষ।

এই যে কি হয়েছে সমাজের! সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই। যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের, সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি, আপনাদের সমর্থন আছে।

কিন্তু একটা কথা এই, যে নতুন সিষ্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব। তা নয় পাঁচ বৎসরের প্ল্যান এ বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেক গ্রামে এই কো-অপারেটিভ। এর জমি মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ – যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভ এর সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস পোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল এ যারা টাউট আছেন, তাদের বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্য ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে যে, পাঁচ বৎসরের প্ল্যান এ প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচ শত থেকে এক হাজার ফ্যামিলি নিয়ে কম্পল্সারি কো-অপারেটিভ হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভ এর হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্ট এর হাতে।

দ্বিতীয়তঃ থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী বা সরকারী কর্মচারী যেই হন, একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এর সরকারী কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুব প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে। তারাই থানাকে চালাবে।

আর, জেলা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে এডমিনিষ্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। তার চেয়ারম্যান থাকবে। সব কর্মচারীরা এক সঙ্গে তার মধ্যে থাকবে। এর মধ্যে পিপলস রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে। পার্টি রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে। সেখানে তারা সরকার চালাবে। এইভাবে আমি একটা সিস্টেম চিন্তা করেছি এবং করব বলে ইনশাআল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আমি আপনাদের সাহায্য ও সহানুভূতি চাই।

ভাই ও বোনেরা আমার, আজকে আর একটা কথা বলি। আমি জানি, শ্রমিক, ভাইয়েরা, আপনাদের কষ্ট আছে। কী কষ্ট, আমি জানি। তা আমি ভুলতে পারছি না। বিশেষ করে ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ এর কষ্টের সীমা নাই। কিন্তু কোথায় থেকে কী হবে? টাকা ছাপিয়ে বাড়িয়ে দিলেই তো দেশের মুক্তি হবে না। ইনফ্লেশন হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে পারলে তার পরেই আপনাদের উন্নতি হবে। না হলে উন্নতি হবে না। আমি এই-ই জানি। যেমন আমরা আজকে দেখছি।

কপাল, আমাদের কপাল! আমরা গরীব দেশ। আমাদের কপাল, – আমার পাটের দাম নাই, আমার চায়ের দাম নাই। আমরা বেচতে গেলে অল্প পয়সায় আমাদের বিক্রি করতে হয়। আর, আমি যখন কিনে আনি, যারা বড় বড় দেশ, তারা তাদের জিনিষের দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা বাঁচতে পারি না। আমরা এই জন্য বলি, তোমরা মেহেরবানি করে যুদ্ধের মনোভাব বন্ধ করো। আর্মামেন্ট রেইস বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। আজকে তোমরা মনে করেছ, আমরা গরীব, – আমাদের তাই কোন মূল্য নাই। 

কিন্তু-হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছঅপমানঅপমান হতে হবে তাহাদেরসবার সমান।

তোমরা মনে করেছ আমরা গরীব, আমাদের তাই যে দামেই হোক, বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এই দিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেষ্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি তবে ইনশাআল্লাহ্‌ এ দিন থাকবে না। তোমরা আজকে সুযোগ পেয়ে জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে দাও। আর তাই আমাদের কিনতে হয়। আমরা এখানে না খেয়ে মরি, আমাদের ইনফ্লেশন হয়, আমরা বাঁচতে পারি না। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাই, তোমরা কিছু খয়রাত দিয়ে একটু মিষ্টি হাসো। হাসো, হাসো, হাসো। দুঃখে পড়েছি, বিক্রীত হয়েছি। তোমাদের কাছে হাত পাততে হবে, হাসো। অনেকে হেসেছে, – যুগ যুগ ধরে হেসেছে। হাসো! আরব ভাইয়েরাও গরীব ছিল।

আরব ভাইদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করেছি। প্যালেস্টাই এর আরব ভাইদের ন্যায্য দাবী সমর্থন করে বাংলার মানুষ। আরব ভাইদের পিছনে তারা থাকবে প্যালেস্টাইন উদ্ধার করবার জন্য। এও আমাদের পলিসি। সেখানে নির্যাতিত দুঃখী মানুষ, সেখানে আমরা থাকব।

শ্রমিক ভাইয়েরা, আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করছি। আপনাদের প্রতিনিধি ইন্ডাষ্ট্রিয়াস ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্ট এর প্রতিনিধি বসে একটা প্ল্যান করতে হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কি করে আমরা বাঁচতে পারি তার বন্দোবস্ত করতে হবে।

ছাত্র ভাইয়েরা, লেখাপড়া করুন। আমি দেখে খুশী হয়েছি, আপনারা নকল-টকল বন্ধ করেছেন একটু। কিন্তু একটা কথা আমি বলব। আমি পেপারে দেখেছি যে এবারে প্রায় এক পার্সেন্ট পাশ, দুই পার্সেন্ট পাশ, তিন পার্সেন্ট পাশ। শিক্ষক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আকুল আবেদন, ফেল করাবেন না। নকল বন্ধ করেছি। আপনাদের একটা কর্তব্য আছে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে। ফেল করানোতে আপনাদের তেমন বাহাদুরি নাই, পাশ করালেই বাহাদুরি আছে। আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। খালি ফেল করিয়ে বাহাদুরি নেবেন, তা হয় না। তাদের মানুষ করুন। আমি তো শিক্ষকদের বেতন দেব। আমরা সব আদায় করব। আপনারা লেখাপড়া শেখান, আপনারা তাদের মানুষও করুন। শৃংখলা ফিরিয়ে আনুন, রাজনীতি একটু কম করুন। তাদের একটু মানুষ করবার চেষ্টা করুন। একটু সংখ্যা বাড়ান শুধু এক পার্সেন্ট, দুই পার্সেন্ট, পাঁচ পার্সেন্ট দিয়ে বাহুদুরি দেখিয়ে বলবেন খুব স্ট্রিক্ট হয়েছি? আমিও স্ট্রিক্ট চাই। নকল করতে দেবেন না। তবে, আপনাদের কাছে আবেদন, আপনারা মেহেরবানী করে আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। ছেলেদের মানুষ করবার চেষ্টা করুন পাশের সংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা করুন। ওদের মানুষ হিসাবে তৈরি করুন। সেটাই ভাল হবে। রাগ করবেন না। আপনারা আবার আমার উপর রাগ করেন। আমি বুদ্ধিজীবিদের কিছু বলি না। তাঁদের সম্মান করি। শুধু এটুকুই বলি যে, বুদ্ধিটা জনগণের খেদমতে ব্যয় করুন। এর বেশী কিছু বলি না। বাবা, বলে কি মারা যাব! আবার কে বই লিখে ফেলবে। খালি সমালোচনা করলে লাভ হবে না।

আমার যুবক ভাইয়েরা, যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে, এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গী পরতে হবে। আর, গ্রামে গ্রামে যেয়ে এই কো-অপারেটিভ কে সাক্সেসফুল করবার জন্য কাজ করতে হবে। এ কাজে যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।

আর একটি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস দিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, তিন বছর, চার বছরের আগে শেষ হয়ে না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে গড়তে হবে। থানায় ট্রাইবুনাল করবার চেষ্টা করছি। সেখানে যাতে মানুষ এক বছর, দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়, তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে।

এখন আমি আপনাদের কাছ থেকে একটি কথা জানতে চাই। এই যে চারটি পোগ্রাম দিলাম, এই যে, আমি কো-অপারেটিভ করব, থানা কাউিন্সিল করব, সাব-ডিভিশনাল কাউন্সিল করব আর আমি যে আপনাদের কাছ থেকে ডাবল ফসল চেয়েছি, জমিতে যে ফসল হয়, তার ডাবল চাই, এই সম্পর্কে আপনাদের মত কী?

সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা, একটু ডিসিপ্লিন এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করুন। আপনাদের কষ্ট আছে আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করুন। জনগণের পেটে খাবার নাই। তাদের ওপর ট্যাক্স বসিয়ে আমি আপনাদের পুষতে পারব না। প্রোডাকশন বাড়ালে আপনাদের এদের সঙ্গে উন্নতি হবে। এই যে কথাগুলি আমি বললাম, এতে আপনারা আমাকে সমর্থন করেন কিনা, আমার আমার উপর আপনাদের আস্থা আছে কিনা আমাকে দুই হাত তুলে দেখিয়ে দিন।

ভাইয়েরা, আবার দেখা হবে। ইনশাআল্লাহ্‌ আবার দেখা হবে। আপনারা বহু দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন। গ্রামে গ্রামে ফিরে যান। যেয়ে বলবেন, দুর্নীতিবাজদের খতম করতে হবে। ক্ষেতে-খামারে, কলে কারখানায় প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারাও কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য হবেন। আপনারা প্রাণ দিয়ে কাজ করুন। ইনশাআল্লাহ্‌, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।খোদা হাফেজ, জয় বাংলা।

Wednesday, July 24, 2013

৪৭ ও ৭১ এর স্বাধীনতা: ইতিহাস বিশ্বাস ও মীথ


১৬০০ সালের দিকে ইংল্যান্ড বা বৃটেনের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিলনা। তাই তারা সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ইংরেজদের আদি ব্যবসা ছিল জলদস্যুতা। তাদের পূর্বপুরুষরা পাইরেটস হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। কালক্রমে তারা ধন ও শক্তি সংগ্রহ করে অভিজাতদের সাথে আত্মীয়তা করে। এভাবেই ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের উত্‍পত্তি হয়। ১৬০০ সালের দিকেই লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিস্ঠা হয়। সেই কোম্পানীই ভারতে ব্যবসা করতে আসে। তখন মোগল বাদশাহদের রমরমা অবস্থা। ওই  একই সময়ে ব্যবসা করার জন্যে ভারতে ফরাসী পর্তুগীজ ও  ওলন্দাজরা  আসে। এর বহু আগেই আরবরা ভারতে আসে ব্যবসা করার জন্যে। মূলত  তারা ভারতের উপকূলীয় এলাকায় ব্যবসার কেন্দ্র স্থাপন করে। বিশেষ করে সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে বহু আরব মুসলমান ব্যবসায়ী ও প্রচারকরা এদেশে আসেন। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দের মিশেল পাওয়া যায়। স্থল পথেও বাংলাদেশেমুসলমান শাসক বণিক ও ধর্ম প্রচারকরা এসেছেন। ১২০০ সালের দিকে বাংলাদেশ মুসলমান শাসনের অধীনে আসে। দিল্লীতেও মুসলমান  শাসন কায়েম হয় ১২০০ সালের দিকে। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা  যড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলার শাসন দখল করে। ১৮৫৮ সালে প্রকাশ্যে ভারতীয়  সৈনিকরা  বাহাদুর শাহকে তাদের নেতা মেনে নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। এটাই ছিল ভারতীয়দের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু। এর আগে ১৭৫৭ থেকে ইংরেজদের অধীনতা অস্বীকার করে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আলেম সমাজের নেতৃত্বে বাংলার কৃষকরা বিদ্রোহ করে। ইংরেজদের দখলদারিত্ব অস্বীকার করে সারা ভারতে মুসলমান আলেম সমাজই প্রথম ১০০ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যায়। ইংরেজ দখলদারিত্বের ফলে এদেশে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের মুসলমান সমাজ। ৭১১ সাল থেকে হিসাব করলে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে  প্রায় এক হাজার বছর মুসলমান শাসন চলেছে। ১২০০ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল নাগাদ লাগাতার প্রায় ৭শ’ বছর মুসলমান চলেছে। এ দীর্ঘ সময়ই ছিল ভারতের স্বর্ণযুগ। ১৮৫৮ সালে শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর জাফরের কাছ থেকে সারা ভারতের শাসন ভার দখল করে নেয়। বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রেঙুনে নির্বাসনে পাঠায়। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ইংরেজরা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত শাসন করে। এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রায় দেড়শ’ বছর হিন্দু নেতারা ইংরেজ সরকারকে সহযোগিতা করে। ইংরেজ শাসন আমলের শেষের দিকে মুসলমান নেতারা, বিশেষ করে আলিগড় আন্দোলনের নেতা স্যার সৈয়দ ইংরেজী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সাথে সাথে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু বিত্তবান উচ্চ শ্রেণীর  মুসলমান নেতা স্যার সৈয়দকে সমর্থন করেন। স্যার সৈয়দ ও অন্যান্য মুসলমান নেতাদের আহ্বানে মুসলমান তরুনরা ইংরেজী শিক্ষায় আগ্রহী হয়। হিন্দুদের ভিতর রাজা রাম মোহনকে নব জাগরনের দূত হিসাবে অভিহিত করা হয়। ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে সকল সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্যে অক্ষয় দত্ত, বিদ্যাসাগর , মধুসুদন রাম মোহনের ভাবধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। হিন্দু জাতিকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্যে এরা সকলেই পাশ্চাত্য শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন। তাদের মাথায় তখন মুসলমানদের সাথে নিয়ে চলার কোন চিন্তা ভাবনা ছিলনা। কারণ তখন মুসলমানরা একেবারেই পতিত ছিল। ১৮২৩ সালের  ১১ই  ডিসেম্বর  রাজা রাম মোহন হিন্দুদের আধুনিক শিক্ষার ব্যাপারে ভাইসরয় লর্ড আমহার্স্টকে এক চিঠি দেন। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী  ওই চিঠিকে ‘নবযুগের শংখধ্বনি’ বলে অভিহিত করেছেন। ডিরোজিও রাম মোহনের চিন্তাধারার একজন বড় শিষ্য ছিলেন। তাঁরাই সকলে মিলে হিন্দু কলেজ প্রতিস্ঠা করেন। এই সময়ে ডিরোজিওর শিষ্য ছিলেন  রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, দিক্ষিণারণঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ,ও রাধানাথ। একই ভাব ধারায় মহারাস্ট্রে কাজ শুরু করেছিলেন  মহাদেব গোবিন্দ রানাড়ে, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে এবং বালগঙাধর তিলক। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে এর আগেই ১৮৩৮ সালে জমিদার রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে জমিদার সভা প্রতিস্ঠিত হয়। তারপর ১৮৪৩ সালে প্রতিস্ঠিত হয় বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। ১৮৫১ সালে প্রতিস্ঠিত হয় বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন। এ ধরনের আরও বহু সমিতি গঠন করে হিন্দুরা সারা ভারতে। এর ইংরেজদের সরাসরি সমর্থন ছিল। ১৮৮৩ সালে হিন্দুরা সর্ব ভারতীয় সম্মেলনের আয়েজন করে। এর পরেই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিস্ঠিত হয় লর্ড হিউমের নেতৃত্বে ১৮৮৫ সালে। ফলে ভারতীয় হিন্দুরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারকে সমর্থন দিতে থাকে।
ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে হিন্দু নেতারা সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রতিস্ঠার আন্দোলন বলিয়া মনে করিতেন।তাহারা ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতেই পরিচালিত করিতে চাহিয়া ছিলেন। ১৯২১ সালে ইক্যবদ্ধ খেলাফত আন্দোলনের সময় গান্ধীজী  হঠাত্‍ বলে বসলেন, ‘ আমি নিজেকে একজন সনাতনী হিন্দু বলিয়া ঘোষণা করিতেছি। কারণ, ১। বেদ উপনিষদ পুরাণ যাহা কিছু হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বলিয়া পরিচিত তাহার সকল কিছুতেই আমি বিশ্বাস করি,সুতরাং অবতার আর পূণর্জন্মেও আমার দৃঢ বিশা্বাস আছে। ২। বর্ণাশ্রম ধর্মে আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ। সেই বর্ণাশ্রম ধর্ম বর্তমান কালের লৌকিক ধারণা বা স্থুল অর্থ ে নহে, তাহা এক অর্থে আমার মতে সম্পুর্ণ  বেদ ভিত্তিক ৩। গোরক্ষা সম্বন্ধেও আমার বিশ্বাস অতি দৃঢ। আমি মুর্তি পুজায়ও বিশ্বাস করি। ‘সনাতনী হিন্দু, বলিতে কি বুঝায় ? গান্ধীজীর একনিস্ঠ অনুচর পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু স্বয়ং এর ব্যাখ্যা দিয়াছেন। তিনি লিখেছেন, সনাতনীরা পশ্চাত্‍গতির দৌড়ের প্রিযোগিতায় হিন্দু মহাসভাকেও বহুদূর পিছনে ফেলিয়া যায়। এই সনাতনীরা এক চরম আকারের ধর্মীয় রহস্যবাদের সহিত বৃটিশ শাসনের প্রতি একাগ্র অনুরক্তি যোজনা করিয়া থাকে। গান্ধীজী হিন্দু বলিতে আমরা বলিতেন আর মুসলমান বলিতে তাহারা বলিতেন। পন্ডিত জওহরলাল অন্তরে ছিলেন বামপন্থী  আর বাইরে ছিলেন দক্ষিণপন্থিদের নেতা। ভারতের বামপন্থী নেতারা গান্ধীজীকে বৃটিশ শাসক , জমিদার ও সামন্তবাদীদের প্রকাশ্য এজেন্ট বলে অভিহিত করেছেন। লেনিনের মতে অহিংস আন্দোলনের মূল দর্শন ছিল জনগনের সংগ্রামী চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। গান্ধীজীর স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল মালিক-শ্রমিক, জমিদার-প্রজা ও বৃটিশদের মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে দাবী আদায় করা। কংগ্রেস বহুকাল গান্ধীজীর পথ অনুসরন করে অবশেষে কঠের ভাষায় দাবী আদায়ের কথা বলতে থাকে।
ভারতের মুসলমান নেতৃবৃন্দ যখন  দেখলেন কংগ্রেসে থেকে এক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলন করা যাবেনা তখনই তারা পৃথক সংগঠন বা প্ল্যাটফরম থেকে কথা বলে দাবী আদায়ের চিন্তা করতে থাকলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলীম লীগ প্রতিস্ঠিত হয়। কংগ্রেস মুসলীম লীগকে সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আখ্যায়িত করে। আর নিজেদের সর্বভারতীয় সার্বজনীন রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রচার করে। কংগ্রেস নেতারা  বৃটিশ সরকারের কাছে কংগ্রেসকে ভারতবাসীর একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রমান করার চেস্টা করতে লাগলেন। মুসলমান নেতারাও বসে থাকলেননা। তারাও জানান দিলেন, কংগ্রেস একটি হিন্দু সংগঠন এবং হিন্দুদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কংগ্রেস নেতারা  শিখ বৌদ্ধ জৈন ও খৃস্টান জনগনের কথা একেবারেই ভুলে গেলেন। ক্ষুদ্র ধর্ম গোস্ঠি ও জাতিগুলো নিজেদের আলাদা করে প্রতিস্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কট্টর হিন্দু নেতা গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্বপ্ন ছিল ইংরেজদের কাছ থেকে তারা একাই ক্ষমতা বুঝে নিবে। প্রথম দিকে মুসলমান নেতারা কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস করেছিলেন। এমন কি ১৯৩৪ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলীম লীগের সভাপতি হওয়ার পরও জিন্নাহ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চেস্টা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন অখন্ড ভারতে মুসলমানেরা তাদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে পাবে। কিন্তু দু:খের বিষয় কংগ্রেস নেতারা মুসলীম লীগের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায়নি। মুসলমানরা ভারতীয় হলেও তাদের আলাদা স্বত্তা আছে একথা হিন্দু নেতারা কখনই মেনে নিতে চাননি। কংগ্রেসের এই মনোভাবকে শাসক গোস্ঠিও পছন্দ করেনি। এমনি করেই এক সময় পাকিস্তান প্রস্তাব সামনে এসে যায় এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠে খুবই অল্প সময়ে। আজ ভারতীয় নেতারাও অনুভব করছেন, কংগ্রেসের  উদারতা সহনশীলতার অভাবেই ভারত বিভক্ত হয়েছে। ভারতের নতুন প্রজন্ম বুঝতে পেরেছে কংগ্রেসের হীনমন্যতা ও হিন্দুত্ববাদীতাই ভারত বিভক্তির জন্য দায়ী। মুসলমানরা একটি আলাদা জাতি একথা প্রমান করার জন্যেই তারা পাকিস্তান প্রস্তাবকে সামনে নিয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস বিভক্ত ভারতে একটি হিন্দু রাস্ট্র প্রতিস্ঠা করেই ছাড়লো। কংগ্রেস যদি হিন্দু ভারত না চাইতো তাহলে ভারত ভাগ হতোনা এবং নতুন মুসলীম রাস্ট্র পাকিস্তানও প্রতিস্ঠা হতেনা।
এতক্ষন যা বলেছি তার সবই পুরাণো কথা এবং ইতিহাসের পাতা থেকে নেয়া। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্ম ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান সৃস্টির বিষয়টা আজও ভাল করে জানেনা। তাই পুরাণো কথা গুলো নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে বলতে হয়েছে। শিক্ষিত সমাজের ৯০ ভাগই জানেন বা বলেন জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্বের কারণে ভারত ভাগ হয়েছে। হাঁ, জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু কখন এবং কেন? কংগ্রেস যদি হিন্দু রা্স্ট্র ভারত না চাইতো তাহলে পাকিস্তান হতেনা। আগেই  বলেছি  কংগ্রেস যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্ব না করতো তাহলে মুসলীম লীগের জন্মই হতোনা। ভারতের মুসলমানরা এখনও  দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোস্ঠি। সে হিসাবে তারা এখনও অধিকার বঞ্চিত। এমন কি পশ্চিম বংগে অসম্প্রদায়িক বলে কথিত কমিউনিস্ট পার্টি ৩৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুসলমান জনগোস্ঠির সুবিচার করা হয়নি। ভারতের সকল রাজনৈতিক দলই মোটামুটি হিন্দু ভারতে বিশ্বাসী। ৪৭ সালেও কংগ্রেস মুসলীম মেজরিটি এলাকা পাঞ্জাব এবং বাংলাকে বিভক্ত করে। বাংগালীরা হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ ভাবে স্বাধীন অখন্ড বাংলাদেশ চেয়েছিল। সেটাও কংগ্রেস মানেনি।
৪৭ সালে পাকিস্তান রাস্ট্র  যখন প্রতিস্ঠিত হয় তখন এর রাজধানী নির্ধারন করা হয়  সিন্ধু প্রদেশের করাচীতে। ঢাকা প্রাদেশিক সরকারের রাজধানীতে পরিণত হয়। প্রাক  ৪৭  সময়ে সারা ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে বাংগালী মুসলমানের তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব ছিলনা। ফলে পাকিস্তান প্রতিস্ঠার পর সামরিক বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসের উচ্চ পদ গুলিতে চাকুরী লাভ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের অফিসারগণ। এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পদ গুলিতেও অবাংগালী অফিসারগণ নিয়োগ লাভ করেন। ভারত বিভক্তির ফলে ভারত থেকে  লাখ লাখ অবাংগালী সরকারী কর্মচারী পূর্ব পাকিস্তানে আসতে শুরু করে। এদের পূণর্বাসনের দায়িত্ব পড়ে প্রদেশিক সরকারের উপর। আজকের মোহাম্মদপুর সে সময়েরই সৃস্টি। রেলের বড় বড় চাকুরী গুলো লাভ করেন অবাংগালী অফিসারেরা। পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে ছিল এক বিরাট চাকুরীদাতা। প্রদেশের জেলাগুলোতে অনেক অবাংগালী ডিসি , ডিএম ও এসপি চাকুরী পান। পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের নাম থখন ছিল ইস্ট বেংগল। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একজন গভর্ণর ও একজন চীফ সেক্রেটারী প্রদেশে থাকতো। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান ছিল খুবই অনগ্রসর। মূলত: একটি কৃষি প্রধান প্রদেশ। কল কারখানা যা ছিল তার মালিকরা থাকতেন কোলকাতায়। অধিবাসীদের ৯০ ভাগই ছিলেন  কৃষক। সত্যি কথা বলতে কি প্রদেশটি দীর্ঘকাল ইংরেজ শোষন ও হিন্দু জমিদারদের শোষণের ফলে নি:স্ব হয়ে পড়েছিল। সচিবালয়ে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে কর্মচারীরা কাজ করেছেন। মন্ত্রীরা তিন-চার জন মিলে একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ১৯০৫ সালে গঠিত প্রদেশ ব্যবস্থা যদি টিকে থাকতো তাহলে সদ্য স্বাধীন প্রদেশের এমন দূরবস্থা হতোনা। রেডী প্রশাসনিক কাঠামো পাওয়া যেতো। যা অন্য প্রদেশের ক্ষেত্রে বিদ্ধমান ছিল।
খুব বেশী পিছিয়ে পড়া এই প্রদেশের উন্নতির জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের যে সব জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল তা তারা নিতে পারেননি। হয়ত তাঁরা এর প্রয়োজন বোধ করেননি। হয়ত প্রদেশ সম্পর্কে তাদের সুস্পস্ট কোন ধারনা ছিলনা। বারোশ’ মাইল দূরে অবস্থিত এই প্রদেশের সাথে কেন্দ্রের শক্তিশালী টেলি যোগাযোগ বা বিমান যোগাযোগ ছিলনা। ফলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিলম্ব হয়ে যেতো। নুরুল আমিন সাহেবের অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায় বিষয়টি খুবই স্পস্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। পুর্ব পাকিস্তানের জন্যে যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল তা কেন্দ্র কখনই অনুভব করেনি। অথবা তারা পুরো বিষয়টাকে অবহেলা করেছে। প্রাদেশিক মুসলীম লীগের রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানীকে অবজ্ঞা করা মোটেই বুদ্ধির পরিচায়ক হয়নি। প্রাদেশিক মুসলীম লীগ নেতাদের খামখেয়ালীপনা ও অদূরদর্শিতার ফলেই মাওলানা ভাসানী মধ্যবিত্ত তরুণ নেতাদের নিয়ে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করেন।দূর্বল মুসলীম লীগ সংগঠনের বিপরীতে আওয়ামী মুসলীম লীগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রদেশের সাধারন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভাষাকে কেন্দ্র করে প্রদেশের সাধারন মানুষের ভিতর এক নতুন জাগরনের সৃস্টি হয়।মুসলীম লীগকে রাজনীতি থেকে বিদায় দেয়ার জন্যে মাওলানা ভাসানী ৫৪ সালের নির্বাচনের জন্যে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে যুক্তফ্রন্ট গঠণ করেন। নির্বাচনে মুসলীম লীগের ভরাডুবি হয়। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম লীগ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অথচ এই দলটি নির্যাতিত মুসলমানদের বাঁচানোর তাগিদেই  ৪৭ সালে পাকিস্তান নামক  রাস্ট্রটি প্রতিস্ঠা করেছি। হিন্দু প্রাধান্যের সামনে তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্যেই পাকিস্তানের জন্যে জান দিয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের মাথায় প্রদেশের মুসলমানেরা নিজেদের বাংগালী ভাবতে শুরু করে। ৭০ এর সাধারন নির্বাচন অনুস্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ধরনের গণভোটের মতো। এই নির্বাচন ছিল বাংগালী অবাংগালীর নির্বাচন। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোস্ঠি তা একেবারেই অনুধাবন করতে পারেনি। তারা আলোচনার দুয়ার বন্ধ করে দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে পাকিস্তান রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়নি। ১৬ই ডিসেম্বর’৭১ এ পাকিস্তানের পরাজয়ের পর পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেল। আমরা এবার ষোলয়ানা বাংগালী হিসাবে স্বাধীন হলাম। ৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছিলাম মুসলমান হিসাবে। মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তান খন্ডিত হয়ে গেল। এটাই পাকিস্তানের ডেস্টিনি ছিল। ১৬ ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন,‘ হাজার সালকা বদলা লিয়া’। কেন বলেছিলেন তা এক লম্বা ইতিহাস। ইতিহাস সচেতন সব মুসলমানেরই জানার কথা। শুরু হলো বাংগালী মুসলমানের নব যাত্রা। ৭১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর। আমাদের আত্মপরিচয় এখনও নির্ধারিত হয়নি। আমরা বাংগালী না বাংলাদেশী তাও ঠিক করে বলতে পারিনা। আমরা মুসলমান না বাংগালী? একদল বলেন পাকিস্তানের বিদায়ের সাথে সাথে দ্বিজাতি তত্বের কবর হয়েছে। বাংলাদেশ সৃস্টি হয়েছে বাংগালী তত্ত্বের ভিত্তিতে। এসব হচ্ছে রাজনীতির বাহাস বা বিতর্ক। রাজনীতিকরা বিতর্ক করেন তাদের ভোট এবং রাজনীতির জন্যে। কিন্তু গবেষকরা বলবেন প্রতিস্ঠিত গবেষণার ভিত্তিতে। আওয়ামী লীগ এবং তার দলীয় ও ভক্তরা মনে করেন আমাদের জাতীয়তা এবং ঐতিহ্য হচ্ছে ভাষা ভিত্তিক। যা  কোলকাতা আর দিল্লীর রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের মাথায় ঢুকিয়েছে। শুধু ভাষাই হতো তাহলেতো ৪৭ সালেই বাংগদেশ অখন্ড এক থাকার কথা ছিল। এক থাকেনি , কারণ কংগ্রেস তা চায়নি। কারণ অখন্ড বংগদেশে মুসলমানেরা ছিল মেজরিটি। এখনও দুই বাংলা মিলে মুসলমানেরা মিলে মুসলমানেরা মেজরিটি। খোদা কখনও বেকুবদের হেফাজত করেন না। যে ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিস্ঠার বিরোধীতা করেছেন আর ১৯০৫ সালের  বংগভংগ রদের জন্যে আন্দোলন করেছেন তিনিই এখন আমাদের জাতীয় দর্শন হতে চলেছেন। যিনি বৈদিক ধর্ম ও আদর্শে বিশ্বাস করেন তারই বন্দনায় আমরা পাগল হতে চলেছেন। যিনি জমিদার হিসাবে এক সময়ে এদেশের গরীব কৃষকদের শোষণ করেছেন। তাঁর অত্যাচারের নমুনা কি ছিল তা কাংগাল হরিনাথ আর গগন হরকরার লেখা পড়লেই বুঝতে পারবেন। এই মহা ভাগ্যবান মহাপুরুষের জন্ম জয়ন্তী উত্‍সব পালনের জন্যে বহুজাতিক কোম্পানীর অর্থের ভান্ডার সব সময় খোলা থাকে। মানবতার কবি নজরুলের এসব আয়োজন কখনই জোটেনা। এর রহস্য কি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখনও ভাবার সুযোগ পান না।
বাংলাদেশের অধিবাসীর  ৯০ ভাগ মুসলমান। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে আমাদের ধর্ম ও ধর্মীয় দর্শন  নিবিড়ভাবে জড়িত। ধর্মকে আমেদের জীবন থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। যেমন গান্ধীজী বলেছিলেন,তিনি প্রথমে হিন্দু তারপরে জাতীয়তাবাদী। ধর্মের বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতাও চান না। তিনিই হচ্ছেন ভারতের বাপুজী। তিনি তাঁর হিন্দুত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই ভারত বিভক্তিকে সমর্থন করেছেন। আর আমরা জিন্নাহকে সাম্প্রদায়িক বলে গালআগাল দিই। ভারতের কট্টর হিন্দুবাদীরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নতুন তত্ত্ব  দিয়েছেন। তাহলো ভারতবাসী সকলেই ভৌগলিক কারণে হিন্দু। মুসলমানদের বলতে হবে, হিন্দু মুসলমান। ভারতের হিন্দু নেতারা এখনও স্বপ্ন দেখেন অখন্ড ভারতের এবং হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিস্ঠার। আমাদের দেশে যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলেন তারা জ্ঞানপাপী আর হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তারা জেনে শুনে আমাদের জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কারন আমাদের জাতিসত্ত্বার প্রধান উপাদান হচ্ছে আমাদের ধর্ম। এই ধর্মই আমাদের ৪৭ সালে ভারত থেকে আলাদা করেছে। এই ধর্মের কারনেই ১৭৫৭ সালে হিন্দুরা  ক্লাইভকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এই ধর্মের কারনেই হিন্দুরা  ১৫০ বছর ইংরেজ শাসনকে সমর্থন করেছে। ৭১ সালে আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছি অর্থনৈতিক কারনে। বাংগালী বলে নয়। ৬ দফা ছিল অর্থনেতিক শ্লোগান ও দাবী। ৬ দফায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা বাংগালী বলে কোন শ্লোগান ছিলনা। পাকিস্তানী শাসক গোস্ঠি যদি ৬ দফা মেনে নিত তাহলে পাকিস্তান আজ খুব বেশী হলে একটি  কনফেডারেশন হতো। বংগবন্ধুও হয়ত  তাই চেয়েছিলেন। তাই তিনি স্বাধীনতার কোন প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি। কিছুলোক এখন তাঁর নামে নানা ধরনের ঘোষণা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। জিন্নাহ ভারত ভাগ করেছেন আর বংগবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন হচ্ছে রামায়ন মহাভারতের মতো একটা মীথ। ভারতের হিন্দুরা এই মহাকাব্য দুটিকে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা একটা হচ্ছে ইতিহাস আরেকটা হচ্ছে মীথ। অনেক সময় মীথ ইতিহাসের চেয়ে বহু গুণে শক্তিশালী হয়। ( নয়া দিগন্ত, জুন ৪, ২০১১ )

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি


আমাদের স্মৃতিসৌধের ৭টি ফলক। এই পোস্ট সাজানো হয়েছে সেই ৭টি ফলকের আলোকে।
(১) ভাষা আন্দোলন
(২) ১৯৫৪ সালের নির্বাচন
(৩) ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন
(৪) শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬২
(৫) ৬ দফা, ১৯৬৬
(৬) গণ অভ্যুত্থান, ১৯৬৯
(৭) মুক্তিযুদ্ধ

লাহোর প্রস্তাবঃ
----------------
উত্থাপনঃ ২৩ মার্চ, ১৯৪০.
উত্থাপকঃ শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক।
স্থানঃ লাহোরে মুসলিম লীগের বৈঠক।
দফাঃ ৪ টি।
১. ভৌগলিক দিক থেকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন,
২. মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন,
৩. রাজ্যগুলো স্বায়ত্বশাসিত হবে,
৪. সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার বিধান।

দেশ বিভাগঃ
-------------
পাকিস্তান স্বাধীনতা পায়ঃ ১৪ আগষ্ট, ১৯৪৭
গভর্ণর জেনারেলঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
ভারত স্বাধীনতা পায়ঃ ১৫ আগষ্ট, ১৯৪৭
গভর্ণর জেনারেলঃ লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন।

ভাষা আন্দোলনঃ
-----------------
দেশ ভাগের সময় বাংলা ভাষাভাষীর শতকরা হারঃ
বাংলা- ৫৪.৬%, পাঞ্জাবী-২৭.১%, পশতু- ৬.১%, উর্দূ-৬%, সিন্ধী- ৪.৮%, ইংরেজী-১.৪%।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭: তমুদ্দুন মজলিশ গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এটাই সর্বপ্রথম সংগঠন।
সদস্যঃ ৩; 
সংগঠকঃ অধ্যাপক আবুল কাশেম (ঢাঃ বিঃ)।
বাকী সদস্যঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলম।

১৯৪৭ সালে করাচীতে কেন্দ্রীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবনার প্রতিবাদে জানুয়ারী, ১৯৪৮; ঢাকায় গঠিত হয় ’রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। এ পরিষদের দাবী ছিলঃ
১. বাংলা হবে শিক্ষার বাহন ও অফিস আদালতের মাধ্যম,
২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দূ
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮: পাকিস্তান প্রথম গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনে ’ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী প্রথম উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮: ধর্মঘট পালিত হয় পূর্ব বাংলায় এবং অব্যহত থাকে ১৫ মার্চ, ১৯৪৮ পর্যন্ত। পূর্ব বাংলার তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন দাবি সমর্থনের আশ্বাস দেন।
২১ মার্চ, ১৯৪৮: রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন- ’উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। 
২৪ মার্চ, ১৯৪৮: কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন- ’উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এর ফলে আন্দোলন আবার শুরু হয়।
১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খানও একই ঘোষণা দেন।
২৬ জানুয়ারী, ১৯৫২: পাকিস্তানের নব নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন- ’উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। 
৩০ জানুয়ারী, ১৯৫২: ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয় এবং এদিনই ’সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির বৈঠকে ২১ ফেব্রুয়ারীকে ভাষাদিবস ঘোষণা করে, ২১ ফেব্রুয়ারী , ১৯৫২; হরতাল আহবান করা হয়।
২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২: পূর্ব বাংলার গভর্ণর নূরুল আমিন, ২১ ফেব্রুয়ারীর কর্মসূচী নষ্ট করার জন্য ওইদিন ১৪৪ ধারা জারী করে। ভাষা আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল শুরু করে। তখন মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত শফিক সহ অনেকে শহীদ হন এবং প্রচুর আন্দোলনকারী আহত হন। আন্দোলন অব্যহত থাকে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার সিদ্ধান্ত পিছিয়ে যায়।
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২: প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউরের পিতা-মৌলভী মাহবুবুর রহমান।

যুক্তফ্রন্ট গঠনঃ 
---------------------
৪ ডিসেম্বর, ১৯৫৩।
প্রধান সংগঠকঃ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪: ১৯৪৮ সালে গঠিত গণ পরিষদ বাতিল হয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনঃ
-----------------------
যুক্তফ্রন্ট গঠিত হবার পর ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে- যার প্রথম দফা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা।
নির্বাচনের আসন সংখ্যাঃ ৩০৯ (স্পিকার সহ ৩১০)। মহিলা আসন ৯ টি।
মুসলিম আসনঃ ২৩৭
যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়ঃ ২২৩ টি আসনে।
৩ এপ্রিল, ১৯৫৪: যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক। 
৩০ মে, ১৯৫৪: কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে।

২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৬: পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র (দ্বিতীয় গণ পরিষদ কর্তৃক) গৃহীত হয়।
২৩ মার্চ, ১৯৫৬:
১. পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র কার্যকর হয়,
২. পূর্ব বাংলার নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান,
৩. বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় শাসনতন্ত্রের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে।

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনঃ
-----------------------------------------------------
৭ অক্টোবর, ১৯৫৮:
১. ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামরিক শাসন জারী করেন,
২. ২৩ মার্চ, ১৯৫৬ সালে গৃহীত শাসনতন্ত্র তিনি বাতিল করেন।
২৭ অক্টোবর, ১৯৫৮: ইস্কান্দর মির্জার স্থলে আইউব খান দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬২:
-------------------------
১৯৬২ সালে ’হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’ শিক্ষাকে এলিট শ্রেণীর উপযুক্ত বলে শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি করে দেয়। কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে শিক্ষাকে লাভজনক করার জন্য অবৈতনিক শিক্ষা অবাস্তব ঘোষণা করা হয়। যার ফলে, শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার করে তোলার জন্য আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
৩০ জানুয়ারী, ১৯৬২: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচীতে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট জারী হয়। গ্রেফতার হন, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শেখ মুজিবর রহমান এবং আবুল মনসুর আহমেদ।
১ মার্চ, ১৯৬২: পাকিস্তানের নতুন শাসনতন্ত্র জারী।
১৯ আগষ্ট, ১৯৬২: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২: ’হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবীতে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়, এবং তাতে কয়েকজন শহীদ হন। ১৭ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষা দিবস ঘোষণা করা হয়।
৭ অক্টোবর, ১৯৬২: সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়।

৬ দফা, ১৯৬৬:
------------------
উত্থাপকঃ শেখ মুজিবর রহমান
জাতীয় ’মুক্তির সনদ’ খ্যাত ৬ দফা রচিত হয় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে।
দফা সমূহঃ
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেশন সরকার গঠন, সংবিধান প্রণয়ন ও স্বায়ত্বশাসন,
২. প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের, বাকী ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের,
৩. দুই প্রদেশের জন্য আলাদা মুদ্রা এবং আলাদা স্টেট ব্যাংক স্থাপন,
৪. কর ও শুল্ক নির্ধারণ ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের,
৫. বৈদেশিক মুদ্রা তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে,
৬. আঞ্চলিক প্রতি্রক্ষা বাহিনী গঠন।
৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬: কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ৬ দফা উত্থাপন
১৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬: বিরোধী দলীয় সম্মেলনে ৬ দফা উত্থাপন।
২৩ মার্চ, ১৯৬৬: লাহোরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ৬ দফা উত্থাপন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৮:
-----------------------------------
৩ জানুয়ারী, ১৯৬৮: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের।
১৮ জানুয়ারী, ১৯৬৮: শেখ মুজিব গ্রেফতার।
মামলার অভিযোগঃ আগরতলায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনে ভারতের সহযোগিতার পরিকল্পণা করা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহীতার কারণ দেখিয়ে মামলা দায়ের করা হয়।
আগরতলা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেনঃ শেখ মুজিবর রহমান, আলী রেজা, ভারতের ইন্টার ইন্টেলিজেন্স বিভাগের ব্রিগেডিয়ার মেনন।
মামলার আসামীঃ ৩৫ জন।
ষড়যন্ত্র ফাঁস করেনঃ আমির হোসেন
মামলার বিশেষ আদালতের বিচারপতিঃ এস. এ. রহমান
শেখ মুজিবের পরে আইনজীবিঃ শহীদ ময়েজ উদ্দিন।

গণ অভ্যুত্থান, ১৯৬৯:
-----------------------
৫ জানুয়ারী, ১৯৬৯: ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন।
২১ দফার সাথে ৬ দফা মিলিয়ে ১১ দফা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করে শেখ মুজিব সহ ৩৫ জন আসামীর মুক্তির দাবীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর নেতৃত্বে গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়।
৮ জানুয়ারী, ১৯৬৯: গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন।
১৮ জানুয়ারী, ১৯৬৯: চূড়ান্ত বিক্ষোভ শুরু।
২০ জানুয়ারী, ১৯৬৯:
১. এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারী,
২. বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণ,
৩. গুলিতে আসাদ শহীদ হন।
২৪ জানুয়ারী, ১৯৬৯: নবকুমার ইনস্টিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর শহীদ হন।
১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক-কে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯: গণঅভ্যুত্থানের মুখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯: শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন তোফায়েল আহমেদ।
২০ মার্চ, ১৯৬৯: গভর্ণর মোনায়েম খানের অপসারণ
২৫ মার্চ, ১৯৬৯: আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। 
৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৯: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেন ’বাংলাদেশ’।

১৯৭০ সালের নির্বাচনঃ
----------------------- 
৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০: জাতীয় পরিষদের নির্বাচন।
১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০: প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন।
নির্বাচনের বিবৃতিঃ
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭ টি আসন।
প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ৩১৩ টি আসনের (১৩ টি মহিলা আসন) মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ টি আসন।

১৯৭১ সালঃ
--------------
জানুয়ারি
• ০৪: আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএবৃন্দ রেসকোর্স ময়দানে জনতার সামনে শপথ গ্রহণ করেন। এসময় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে ৬-দফা ও ১১-দফা প্রশ্নে কোন আপোস হবেনা তবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সাহায্য চাওয়া হবে।
• ১৫: ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদ দিবস পালনের জন্য পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ঐদিন পূর্ণ দিবস হরতাল পালনের আহবান করে।
• ৩১: আওয়ামী লীগের সাথে ৩ দিনের আলোচনা শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় পাকিস্তান টাইম্‌স-কে দেয় এক বিবৃতিতে বলেন যে দু'দলের আলোচনা সাপেক্ষে একটি গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করা হবে।

ফেব্রুয়ারি
• ০৫: লাহোরে ভারতীয় বিমান অপহরণ এবং ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব বিবৃতি দেন যে অচিরেই এর সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
• ০৯: জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে বিলম্ব হওয়ায় শেখ মুজিব বলেন যে, এটি নিজেদের সরকার থেকে তার জনগণকে বঞ্চিত করার আরেকটি ষড়যন্ত্র।
• ১৪: রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
• ১৫: ভুট্টো বলেন যে, তার দল পাকিস্তান পিপ্‌লস পার্টি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেনা। তবে তিনি একটি শর্তারোপ করেন। শেখ মুজিব এই সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রবিরোধী আখ্যা দেন।
• ১৬: পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি নুরুল আমিন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সকলকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।
• ২১: বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলা ছাত্রলীগ ভাষা দিবস উপলক্ষে স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করে বিশেষ বিবৃতি দেয়। বাংলা ছাত্রলীগ বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন তার ১৪-দফা দাবী পেশ করে।
• ২৫: তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবেচনা করে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি একটি বিশেষ প্রস্তাব করে।
• ২৮: শেখ মুজিব ভুট্টোকে অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান এবং বলেন যে ৬-দফা কারো উপর চাপিয়ে দেয়া হবেনা।

মার্চ
• ০১: রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সমগ্র বাংলাদেশে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রচারিত হয়।
• ০২: পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
• ০৬: লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিয়োগ করা হয়।
• ০৭: 
o ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা ৭ই মার্চের ভাষণ নামে খ্যাত।
o কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান করে।
• ০৮: 
o শেখ মুজিবুর রহমান ১০-দফা দাবী পেশ করেন।
o গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম সংক্রান্ত একটি বেনামী লিফলেট প্রচারিত হয়।
o পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৪-দফা দাবী পেশ করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
• ০৯: 
o মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক জনসভায় বলেন, "পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়ুন"। তিনি তার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে আন্দোলন করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন।
o টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
• ১৪: ভুট্টো দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
• ১৭: মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় দফা বৈঠক শেষে শেখ মুজিব বলেন যে, আন্দোলন চলবে।
• ১৯: জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নকে নীরস্ত্র করার পশ্চিম পাকিস্তানী প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয় বাঙালি সৈন্যরা।
• ২০: উপদেষ্টাসহ মুজিব-ইয়াহিয়া চতুর্থ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
• ২১: ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভুট্টো ঢাকায় আসেন।
• ২২: ইয়াহিয় ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।
• ২৩: পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই দিনটি বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
• ২৫: পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে সমগ্র ঘুমন্ত ও নীরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায় যা অপারেশন সার্চলাইট হিসেবে পরিচিত।
• ২৬: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
• ২৭: কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
• ৩০: পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের গণহত্যা রোধে এগিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘ এ বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি মেজর জিয়াউর রহমান আহ্বান জানান।
• ৩১: কুষ্টিয়া প্রতিরোধ শুরু।

এপ্রিল
• এপ্রিল ২: জিঞ্জিরা গণহত্যা.
• এপ্রিল ৬: ব্লাড টেলিগ্রাম
• এপ্রিল ১১: নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের রেডিও ভাষণ।
• এপ্রিল ১০: মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।
• এপ্রিল ১২: এম এ জি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন .
• এপ্রিল ১৭: অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করে বৈদ্যনাথতলায় (যা এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত) ।
• এপ্রিল ১৮: দরুইনের যুদ্ধে সিপাহী মোস্তফা কামাল ও রাঙ্গামাটি-মহালছড়ির যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ শহীদ হন।
• এপ্রিল ২৪: অনাবাসী বাংলাদেশীরা যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রি-তে বাংলাদেশ একশন কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন।
• এপ্রিল ২৮: বিশ্ববাসীর কাছে তাজউদ্দিনের অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা

মে
• মে ৫: গোপালপুর গণহত্যা
• মে ১৫: মুক্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা শুরু।
• মে ২০: খুলনায় চুকনগর গণহত্যা সংঘটিত হয়, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে।
• মে ২৪: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতায় কাজ শুরু করে।

জুলাই
• জুলাই ১১-১৭: সেক্টর কমান্ডার সম্মেলন, ১৯৭১.

অগাস্ট
• অগাস্ট ১: নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে The Concert for Bangladesh, George Harrison এবং তাঁর বন্ধুদের অংশগ্রহণে।
• অগাস্ট ১৬: অপারেশন জ্যাকপট, বাংলাদেশি নৌ-কমান্ডো অভিযানে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস।
• অগাস্ট ২০: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (সামরিক বিমানচালক)' একটি যুদ্ধবিমান দখল করে পাকিস্তান ত্যাগের ব্যর্থ চেষ্টা করেন।.
• অগাস্ট ৩০: ঢাকা গেরিলাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান।.

সেপ্টেম্বর
• সেপ্টেম্বর ৫: গোয়াহাটির যুদ্ধে নূর মোহাম্মদ শেখ শহীদ হন।
• সেপ্টেম্বর ২৮: বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর পত্তন।

অক্টোবর
• অক্টোবর ১৩: ঢাকার গেরালা যোদ্ধারা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনেম খানকে হত্যা করেন.
• অক্টোবর ২৮: ধলাই সীমান্তফাঁড়ির যুদ্ধ, শ্রীমঙ্গল।
• অক্টোবর ৩১ নভেম্বর ৩: ধলাইয়ের যুদ্ধ: পাকিস্তানের সীমান্ত হতে শেলিং বন্ধ করতে ত্রিপুরা হতে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের আক্রমণ।

নভেম্বর
• নভেম্বর ৯:ছয়টি ছোট যুদ্ধ জাহাজের সমন্বয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম যুদ্ধবহর যাত্রা শুরু করে .
• নভেম্বর ১৬: আজমিরিগঞ্জ যুদ্ধ, মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ১৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ। খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা জগজ্জ্যোতি দাস এ যুদ্ধে শহীদ হন।
• নভেম্বর ২০ থেকে নভেম্বর ২১: গরীবপুরের যুদ্ধ: [বয়রা]]য় ভারতীয় হামলা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে
• নভেম্বর ২১: মিত্রবাহিনী, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনী গঠিত হয়।
• নভেম্বর ২২ - ডিসেম্বর ১৩, খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ
• ডিসেম্বর ১৬: হিলি যুদ্ধ: বগুড়ায় মিত্রবাহিনীর হামলা।

ডিসেম্বর
• ডিসেম্বর ৩: ভারতের ওপর পাকিস্তানের বিমান হামলা যার ফলে ভারত পাকিস্তানের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করে।
• ডিসেম্বর ৪ to ডিসেম্বর ৬: বসন্তরের যুদ্ধ: ভারত জয়সলমিরে পাকিস্তানের হামলা প্রতিরোধ করে।
• Dec ৫ to Dec ৬: Battle of Longewala: Indians attack and take over Pakistani territory opposite Jammu
• ডিসেম্বর ৪ Operation Trident (Indo-Pakistani War): Indian naval attack on Karachi
• ডিসেম্বর ৬: India becomes the first country to recognize Bangladesh. Swadhin Bangla Betar Kendra becomes Bangladesh Betar.
• ডিসেম্বর ৭: যশোর, সিলেট ও মৌলভী বাজার মুক্ত হয়।
• ডিসেম্বর ৮ night: অপারেশন পাইথন: করাচীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর আক্রমণ।
• ডিসেম্বর ৯: কুষ্টিয়ার যুদ্ধ: Indian attack from West Bengal into East Pakistan.
Chandpur and Daudkandi liberated.
• ডিসেম্বর ১০: Liberation of Laksham. Two Bangladeshi ships sunk mistakenly by Indian air attack.
• ডিসেম্বর ১১: Liberation of Hilli, Mymenshingh, Kushtia and Noakhali. USS Enterprise is deployed by the USA in the Bay of Bengal to intimidate Indian Navy.
• ডিসেম্বর ১৩: Soviet Navy deploys a group of ship to counter USS Enterprise.
• ডিসেম্বর ১৪: Selective genocide of nationalist intellectuals. Liberation of Bogra.
• ডিসেম্বর ১৬: Pakistan Army surrenders to Mitro Bahini represented by Jagjit Singh Aurora of the Indian Army faction of the military coalition.
Freedom of Bangladeshi people.
• ডিসেম্বর ২২: প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।