Thursday, January 02, 2014

সন্ত্রাসবাদ, সংঘাত ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার - মোহাম্মদ জমির

সম্প্রতি 'সিএনএন'-এ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সন্ত্রাসবাদ, সংঘাত এবং শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা শুনছিলাম। এই আলোচনার বিষয় ছিল মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা আর পূর্ব আফ্রিকার রাজনৈতিক সহিংসতা। আলোচকেরা যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা বিশ্লেষণ ফার্ম 'ম্যাপ্লিক্রফট' (maplecroft)-এর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা বৃদ্ধির প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাঁদের প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল নিরাপত্তা ঝুঁকি, বিশেষ করে সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা থেকে বিতাড়ন এবং বিদেশি মালিকানাধীন সম্পদ দখলমুক্ত করা। তাঁদের গবেষণা থেকে আরও বেরিয়ে এসেছে বিশ্বের ১৯৭টি দেশে কিভাবে রাজনৈতিক ইস্যু ব্যবসার পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলছে। আমার এই আলোচনার ওপর বিশেষ মনোযোগ দেয়ার কারণ হল সমপ্রতি আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থার অবনতি। 


আলোচনা থেকে দেখা গেল ২০১০ সাল থেকে সবচেয়ে অবনতি ঘটেছে সিরিয়ার। প্রতিবেদনটিতে দেশটির অবস্থান এখন ২য়। সোমালিয়া এর র্যাংকিংয়ে প্রথম। এছাড়া প্রথম ৫-এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, সুদান এবং কঙ্গো। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির পতন এবং সিনাই পেনিনসুলাই সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথমবারের মতো 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে মিশর। 'ম্যাপ্লিক্রফট' আরও সতর্ক করছে সিরিয়া, মিশর আর লিবিয়া এখন এতো খারাপ পরিস্থিতিতে আছে যে, সামনের বছরগুলোতে মারাত্মক রাজনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। অপরপক্ষে এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে ফিলিপাইন, ভারত এবং উগান্ডার রাজনৈতিক সহিংসতা বিগত চার বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হরাস পেয়েছে। একই সময়ে শাসন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মালয়েশিয়া এবং ইসরাইলে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক কমে এসেছে। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ, বেলারুশ, চীন, কাজাখিস্থান এবং ভিয়েতনামে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতো খারাপের দিকে যাবে যার ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।

'ম্যাপ্লিক্রফট' বলছে, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার অভাব, রাজনৈতিক ঠুনকো অবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিবাদকারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং কর্মপরিবেশের অভাব এই বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক Charlotte Ingham মনে করেন উপরোক্ত কারণে রাজনৈতিক স্থিতিহীনতার ফলাফল হতে পারে মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি। প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, স্বল্প মেয়াদে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসব অঞ্চলে বেশ বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। এমনকি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তাঁদের কোম্পানির সুনামও। এতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক স্থিতিহীনতার রাজনীতি এসকল দেশের যুব সমপ্রদায়ের প্রযুক্তিবিদ্যা এবং রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে। যেমন- ২০১০ সালের আরব বসন্তের পর লিবিয়া, তিউনিসিয়া, ইরান, সিরিয়া এবং মিশরে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক প্রাপ্তির মধ্যে বিশাল ব্যবধানের সৃষ্টি হয়। 

'ম্যাপ্লিক্রফট' ভবিষ্যদ্বাণী করছে, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক প্রাপ্তির মধ্যকার ভারসাম্যহীনতার কারণে বাহরাইন, আজারবাইজান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে রাজনৈতিক ঝুঁকি তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। সংস্থাটি বলছে, চীনের শাসন ব্যবস্থাতে যে সংস্কার আনা হয়েছে তাতে এখানে গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ কম। ভিয়েতনামে যেভাবে সামাজিক মাধ্যমগুলোর শাস্তি এবং বিরোধীদলের বাক স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করবে। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল থাকবে পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো। সোমালিয়ার উদাহরণ দিয়ে সিএনএন-এ বলা হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকবে সন্ত্রাসবাদ, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা এবং গণঅভ্যুত্থান। প্রতিবেদনে সুদান এবং দক্ষিণ সুদানকে 'চরম ঝুঁকিপূর্ণ' এবং কেনিয়া ও ইথিওপিয়াকে 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' এবং ইরিথিয়া, তানজানিয়া, মোজাম্বিককে 'ঝুঁকিপূর্ণ' ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে। আরব বসন্তের তিন বছর পরের অবস্থা উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, আরব বসন্তের তিন বছর পরও মধ্যপ্রাচ্য আর পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো রাজনৈতিক সহিংসতার উত্থান দেখেছে। দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সহিংসতা এসব অঞ্চলের পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশ্লেষণটি কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষণটি থেকে দেখা যায় কিভাবে এই সময়কার সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, কিভাবে সাইবার জগতের সদ্ব্যবহার করে এবং তাঁদের লক্ষ্য পূরণে কিভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। 

২০১৩ সালের ২ নভেম্বর এ বিষয়ে বিবিসিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কলাম লেখেন ফ্রাংক গার্ডনার। লেখাটির শিরোনাম ছিল 'কিভাবে সন্ত্রাসবাদীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে?' এই লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সন্ত্রাসীরা দুই রকম বার্তা প্রেরণ করে- গোপনীয় আর পাবলিক। কিন্তু এই দুটো ক্ষেত্রেই আসল প্রেরকের শনাক্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। চতুর সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের এই 'ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট' রেখে যাওয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। এর সূত্র ধরে তাদের সন্ধান পাওয়া এবং শনাক্তকরণও সহজ। তারা এও জানে যে, ইন্টারনেটে অপরাধী বা সন্ত্রাস পরিকল্পনাকারীদের জন্য বার্তা লুকানো এবং মুক্ত যোগাযোগ কঠিন। ধরা পড়ার ভয় থেকেই যায়। এই সতর্কতা থেকেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে নিজেদের মৌলিক পন্থা তৈরি করে নিয়েছে। পরিস্থিতিই তাদেরকে এধরনের কৌশল অবলম্বনে বাধ্য করেছে। এরফলে তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনাও কমেছে। এ সম্পর্কে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় নরওয়ের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত এন্ডারস ব্রিভিরিকের নাম। ২০১১ সালের আগে দীর্ঘ ৪ বছর তিনি সামজিক যোগাযোগ করেননি কারো সাথে! তিনি আরও যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সিম বা চিপ দোকান থেকে বেনামে কিনে একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতেন। মজার ব্যাপার হল রাশিয়া এবং চীনের বিভিন্ন সংস্থার নির্বাহীরাও এখন তাঁদের মোবাইল হ্যাক হওয়ার ভয়ে একই কাজ করেন। 

আর কম্পিউটারের এ যুগেও ইন্টারনেটকে বোকা বানাতে একজন চতুর সন্ত্রাসী অন্যকে বার্তা পাঠাতে সেন্ড বাটন টিপছেন না। তিনি তার বার্তাটা লিখে ড্রাফ্?ট বক্সে সেভ করে রাখছেন। যার উদ্দেশ্যে তিনি লিখছেন তার কাছেও থাকছে এই প্রেরকের ইমেইল বা ড্রাফট বক্স লগইন করার পাসওয়ার্ড। ফলে এই বার্তাটা আর ইন্টারনেটে যাচ্ছে না! প্রাপক পড়ার পর যদি উত্তর দেয়ার ইচ্ছা থাকে তো সেখানেই দিয়ে লগ আউট করে নিচ্ছে। বর্তমানে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারীদের কোড এবং রুপক ব্যবহার করার প্রবণতা বেড়েছে। যেমনটি ৯/১১'র দু'জন পরিকল্পনাকারী মোঃ আট্টা (md atta) এবং রামজি বিনালশিভ (ramzibinalshibh) ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কোড ছিল 'architecture', পেন্টাগনের 'arts' এবং হোয়াইট হাউজের কোড 'politics'। এছাড়া সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চ্যাট রুম এবং অনলাইন গেম! এছাড়া অনলাইন ফোরাম-এ যোগ দিতে পাসওয়ার্ড দিতে হয়। অনলাইন ফোরামের মাধ্যমে মাঝে মাঝে নজরদারি চলে সেখানকার সদস্যদের উপর। এছাড়া ইউএসবি স্টিকস, জেপিইজি এবং জিআইএফ ফর্মেটেও গোপন তথ্য আদান-প্রদান চলে। এমনকি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহারেও তারা চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। কুরিয়ারের মাধ্যমেও এখন সন্ত্রাসবাদ চলছে। কিন্তু এই কুরিয়ার হিসাবে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাকে অনুসরণ করেও সন্ত্রাসীর আস্তানায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, যার প্রমাণ ২০১১ সালে ইউএস নেভি সিলের হাতে লাদেন হত্যা। এই সকল প্রযুক্তিই এখন বাংলাদেশে এসেছে। এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এ সকল প্রযুক্তি অবশ্যই নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। আমরা এরই মাঝে একাধিক ঘটনা এদেশে দেখেও ফেলেছি। ডিজিটাল প্রযুক্তি আর সাইবার স্পেস নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এবং ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। একই সময়ে ধর্মীয় মতাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে এ সকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে। শুধু একটিই আশা, আমরা নিরাপদ, সময়োপযোগী এবং কার্যকর সাইবার নিরাপত্তা ম্যাকানিজম গড়ে তুলবো। যাতে করে সন্ত্রাসবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ভবিষ্যতে না দাঁড়াতে পারে। যদি তারা সফল হয় তবে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভেঙ্গে পড়বে এবং আমাদের দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কখনোই কোন সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান দিতে পারে না। তবে সরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে যারা সন্ত্রাসবাদে লিপ্ত তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

লেখক :সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

ভাষান্তর :লিপটন কুমার দেব দাস

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.