ঘটেছে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, হেফাজতের তাণ্ডব
-আবুল খায়ের ও জামিউল আহসান সিপু
দেখতে দেখতে আরো একটি ইংরেজি বছর পার হলো। সদ্য বিদায় হওয়া বছরটি ছিল রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে আলোচিত বছর। শুধু রাজনৈতিক কারণে এ বছর মৃত্যু হয়েছে ৪৯৬ জনের। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে প্রায় ৮ হাজার ব্যক্তিকে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে হয়েছে। এদের মধ্যে শুধু সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে ১১শ ৩৪ ব্যক্তি নিহত হন। সারাদেশে ৪ হাজার ব্যক্তি খুনের শিকার হন। আর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন আড়াই হাজার ব্যক্তি। বিদায়ী এ বছর থেকে সবারই প্রত্যাশা নতুন এ বছরে যেন এসব রাজনৈতিক সহিংসতা ও খুন না ঘটে। বিদায়ী বছরের শুরু থেকে রাজপথে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে বিরোধী জোটের আন্দোলনকারীরা যেমন নিহত হয়েছেন, তেমনি চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ককটেল-হাত বোমা হামলার ঘটনার তো কোন হিসেব নেই। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে ৪৯৬ জনকে। ৮৩১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আহত হয়েছেন ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর এর মধ্যে ৯৫ জন আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে ২২ জন মারা গেছেন। পুলিশ সদর দফতরের এক হিসাব থেকে জানা যায়, বিদায়ী বছরে বিভিন্নভাবে খুন হয়েছেন ৪ হাজার জন।
বছরের শুরুতেই ২৯ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। ওই দিনই হরতাল দেয় জামায়াত, প্রাণ যায় তিনজনের। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হলে দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এই সহিংতায় ১৮ জেলায় ৭৭ জন প্রাণ হারান বলে তথ্য সংগ্রহ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়লে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ঘটে। এতে ১১শ'৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় ৪শ জন। এদের মধ্যে প্রায় দেড়শ' জন চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। ২০ দিন ধরে চলে উদ্ধার কাজ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি শেষ না হওয়ার আগেই ৫ মে মতিঝিলে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশ করে তাদের ওই দিনই ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও রাতে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। এর আগে দিনব্যাপী পুলিশের সঙ্গে হেফাজত নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
মতিঝিল-পল্টন এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হেফাজত নেতাকর্মীরা। রাতে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় র্যাব ও পুলিশ। এই সহিংসতায় সব মিলিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও হেফাজত বা অন্যদের হিসেবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। এই নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ার জন্য অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করা হয়।
সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় বছর জুড়ে সংসদ সদস্যদের মধ্যে গোলাম মওলা রনি আলোচিত ছিলেন। ২৪ জুলাই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের দুই সংবাদকর্মীর ওপর হামলার ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ রনিকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
১৪ আগস্ট রাজধানীর শান্তিনগরে একটি ফ্ল্যাট থেকে সিআইডির ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের জবাই করা লাশ উদ্ধার করা হয়। এক মাত্র কন্যা ঐশীর হাতে বাবা-মা খুন হওয়ার ঘটনায় সারাদেশে সামাজিকভাবে আলোচনার ঝড় বইতে থাকে। মেয়ের হাতে বাবা-মা খুনের ঘটনা দেশে এটিই প্রথম। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সামাজিক বন্ধনের যেন অবক্ষয় না ঘটে সে ব্যাপারে সমাজ বিজ্ঞানীরা সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
বছরের শেষের দিকে এসে ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর আর.কে মিশন রোডের একটি ফ্ল্যাটে ৬ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। কথিত ইমাম মাহাদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুত্ফুর রহমান ফারুক, তার ছেলে সারোয়ার ইসলাম মনি ও ৪ অনুসারীকে জবাই করা হয়। এই খুনের পিছনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সন্দেহের তীর ছুঁড়েছে ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর দিকে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে টানা আন্দোলন শুরু করে বিরোধী জোট। শেষ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা হলে ২৫ নভেম্বর থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। ঐ দিনের পর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১২৫ জন মানুষ নিহত হন। এই অবস্থার মধ্যে বছরের শেষ সময়ে এসে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে রামপুরা ওয়াপদা রোডে নিজ বাসায় ইত্তেফাক সাবেক প্রবীণ ফটো-সাংবাদিক খুন হয়েছেন।
পুলিশ সদর দফতরের এক হিসেবে দেখা গেছে, গেল বছর হরতাল অবরোধের সহিংসতায় সারাদেশে পুলিশের ১৫ সদস্য নিহত হয়েছেন। আর এ সময় আহত হয়েছেন পুলিশের প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। এরমধ্যে যশোরে নিহত হন কনস্টেবল কাজী জহুরুল হক, গাইবান্ধার বাবুল মিয়া, হযরত আলী, তোজাম্মেল হোসেন, নীলফামারীতে খাজা নাজিম উদ্দিন আকন্দ, চট্টগ্রামে আবু তারেক, ঝিনাইদহে জিএম ওমর ফারুক, রংপুরে মোজাহার আলী, রাজশাহীতে কনস্টেবল সিদ্ধার্থ রায় ও খুলনায় মফিজুর রহমান। আর হেফাজতের হামলায় রাজধানীতে মারা যান এসআই শাহজাহান, গোপালগঞ্জে নায়েক ফিরোজ খান ও কনস্টেবল মোহাম্মদ জাকারিয়া। নারায়ণগঞ্জে নিহত হন বিজিবির দুই সদস্য।
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.