বাংলাদেশে আমরা এমন সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেছি, যার সঙ্গে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের তুলনা হয় না। সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রত্যেক মন্ত্রী স্বাধীনভাবে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। খুব বড় মাপের কোনো সিদ্ধান্ত না হলে সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ফাইল পাঠানো হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে দুই বড় দলের দুই সরকারই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া কোনো ছোট-বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সরকারের সব সমস্যার সমাধান যেন শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার হাতে। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মেঠো রাজনীতির অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞতা আছে বলে কেউ দাবি করেননি। দুজনই উত্তরাধিকারসূত্রে নেতা এবং পরে ভোটে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্ব ও প্রতীকের জোরে নির্বাচিত হয়েই এই দুই নেত্রীকে তাঁদের দল ‘সব সমস্যার সমাধান’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। এর ব্যতিক্রম কিছু কেউ করলে তাঁকে নেত্রীর প্রতি যথেষ্ট আনুগত্যের অভাব বলে বিবেচনা করা হয়।
যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের এক বিরাট অংশ স্বপ্ন দেখেন, একদিন এমপি ও মন্ত্রী হবেন। বলা বাহুল্য, সবার ভাগ্যে এই স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে দোষ কী! তাই বেশির ভাগ নেতা, পাতিনেতা বছরের পর বছর দলের প্রধানকে (দুই দলই) তুষ্ট করতে ব্যস্ত থাকেন।
মন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁরা নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে খুব বেশি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ফাইল পাঠিয়ে দিতে হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে কিছু বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ আমলা রাখেন। অনুমান করি, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে ফাইলে সিদ্ধান্তটি লিখে দেন। প্রধানমন্ত্রী কেন এত ব্যস্ততার মধ্যেও সব ফাইল দেখতে চান? কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায়। ১) তিনি তাঁর মন্ত্রীদের দক্ষতার ওপর আস্থা রাখেন না। শুধু স্তাবক হিসেবে তাঁদের মন্ত্রী করা হয়েছে। ২) তিনি মন্ত্রীদের ওপর আস্থা রাখেন, তবু নিজে একবার বিষয়টি ঝালাই করে দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে চান, যাতে কোনো ভুলত্রুটি না থাকে। ৩) কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে, কারা কাজ পাচ্ছে, এগুলো দেখাও একটা উদ্দেশ্য হতে পারে।
তবে মন্ত্রণালয়ের অনেক সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে আর আলোর মুখ দেখেনি, এমন নজিরও রয়েছে।
ফাইল দেখা এবং সব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা জানতে পেরে মন্ত্রীরা এখন আর নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি নেন না। কোনো সমস্যার সমাধান নিয়েও ভাবেন না।
সরকার কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে কার্যত কয়েকজন মন্ত্রীর কাজে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ধরনের বাধা আরোপ করেছে। মন্ত্রীদের কাছে এই বার্তা স্পষ্ট যে ‘তুমি যা-ই করো না কেন, আসল পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন উপদেষ্টারাই।’ গত চার বছরে মন্ত্রী-উপদেষ্টা নানা বিরোধের কথা আমরা শুনেছি।
এভাবে আমরা এমন একটি কৃত্রিম সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছি, যা দুজন নেত্রীকে এক অদু্ভত ধরনের কৃত্রিম ‘সুপার লিডার’ হিসেবে তৈরি করেছে। অথচ দুই দলের সরকারেই এমন অনেক মন্ত্রী রয়েছেন বা ছিলেন, যাঁরা খুবই পোড় খাওয়া রাজনীতিক বা অন্য কোনো পেশায় অভিজ্ঞ।
বাংলাদেশে নব্বইয়ের পরও যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সফল হতে পারেনি, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ। ‘নেত্রী’ নির্ভরতা।
আমাদের এই দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাবে কবে ও কীভাবে? নাকি আমরা এই ‘পদ্ধতি’ বহাল রাখতে চাই? নাকি এই দুই নেত্রীর পর যাঁরা নেতৃত্বে (ও প্রধানমন্ত্রিত্বে) আসবেন, তাঁদের সময় থেকে প্রকৃত সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা করব। দুই নেত্রীর পর যদি তাঁদের উত্তরাধিকারীরা দলে বা সরকারের নেতৃত্বে আসেন, তাহলে কি বর্তমান রীতি পাল্টানো সম্ভব হবে?
আমাদের আশঙ্কা, বড় দুই দলে যদি ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারসূত্রে নেতৃত্ব (এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব) কায়েম হয়, তাহলে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হবে না। কারণ, নতুন নেতৃত্ব আগের ভঙ্গিতেই দল ও সরকার পরিচালনা করতে চাইবেন। বড় দল দুটি তাদের মূল নেতার ক্যারিশমাকে ভাঙিয়ে রাজনীতি করে। ইতিমধ্যে দুই নেত্রীরও ইমেজ গড়ে উঠেছে। অনেক দিন দলের প্রধান থাকলে এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব করলে দলে তো বটেই, দেশের মানুষের কাছেও একটা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ‘স্বৈরাচার’ বলে এরশাদকে যত সমালোচনা করা হোক না কেন, রাজনীতির মাঠে তাঁরও কিছুটা ইমেজ রয়েছে।
বর্তমানে দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর পদটা যেভাবে ব্যবহার করছেন বা করেছেন, তাকে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ বলা যায় না। এই পদ্ধতি অনেকটা ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির’ মতো। আমরা মুখে বলছি ‘সংসদীয় পদ্ধতি’ অথচ কাজে করছি ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি’। বড় দুই দলের প্রথম কাতারের নেতারাও দলপ্রধানের একনায়কতন্ত্র প্রায় বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছেন। যেহেতু দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এমপি নমিনেশন, মন্ত্রিত্ব বা দলের হাইকমান্ডে স্থান পেতে হয়।
বহুদিন যাবৎ রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কিছু নির্দেশ (বিধি) ছাড়া রাজনৈতিক দলে কোনো সংস্কার হয়নি। প্রধান দুই দলের প্রধান ও দলে তাঁর ঘনিষ্ঠ চক্র কেউই সংস্কারে আগ্রহী নয়। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্ব যত দিন দলের মধ্যে থাকবে, তত দিন দলের ভেতরে কোনো তাৎপর্যময় সংস্কার করা সম্ভব হবে না। প্রথম কাতারের অন্তত ১০ জন নেতা ও জেলা পর্যায়ের কয়েকজন নেতা একসঙ্গে চাপ সৃষ্টি করলে হয়তো কোনো দিন সংস্কার সম্ভব হতে পারে। সেই সম্ভাবনা যদিও খুব ক্ষীণ।
আমাদের সংবিধানেও ‘প্রধানমন্ত্রীকে’ (আপাতত দুই বড় দল যে পদ ভোগ করছে) অপরিসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ড. কামাল হোসেনরা ’৭২-৭৩ সালে যখন সংবিধান রচনা করেছিলেন, তখন ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে তাঁরা দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা মাথায় রেখে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ‘প্রধানমন্ত্রী’ এখন যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করছেন আইনানুগভাবেই। ১৫১ জন সংসদ সদস্যের সমর্থন পেলেই একজন এমপি রাষ্ট্রের ও সরকারের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে যেতে পারেন। মন্ত্রিসভা, মহিলা এমপি, আমলাতন্ত্র, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে প্রভাব, বিচার বিভাগ, দলের নানা কমিটি, সরকারি নানা সংস্থার প্রধানকে নিয়োগ, বড় বড় ব্যবসার ঠিকাদারিতে প্রভাব, আত্মীয় তোষণ, রাষ্ট্রদূত নিয়োগ, নানা লোভনীয় ব্যবসার লাইসেন্স প্রদান, দল ও সরকারে স্তাবক পোষা, উপদেষ্টা নিয়োগ, একে ধরো, ওকে মারো, একে অবসর দাও, ওকে প্রমোশন দাও ইত্যাদি এক শ রকম সরকারি কাজে ‘প্রধানমন্ত্রী’ যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টও তাঁর দেশে এত ক্ষমতাশালী নন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট খুব কম ক্ষেত্রেই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আমাদের সংবিধানের এই দুর্বলতা দূর করবে কে? ক্ষমতাসীন দল? বিরোধী দল? জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় সদস্যরা? মন্ত্রিসভা? সরকারি দলের এমপি ও বর্তমান বড় দুই দলের প্রথম কাতারের নেতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো, এই উদ্যোগ নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব কি না?
অথচ এই দুর্বলতাগুলো আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পথে বড় বাধা। আমরা যে আজ একটি পিছিয়ে পড়া দেশ, তার জন্য আমাদের দুর্বল নেতৃত্বই দায়ী। কিন্তু দেশে জ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী লোকের অভাব নেই। এমনকি প্রবাসীদের মধ্যেও অনেক বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কিন্তু সরকারপ্রধান নিজ দল ছাড়া অন্য কারও বিশেষজ্ঞসহায়তা নিতে আগ্রহী হন না। আজ যদি দেশে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বে বা শুধু দলীয় কর্তৃত্বে উন্নয়ন কর্মসূচি বা কৌশল গৃহীত না হতো, সম্ভাব্য সব মেধাবী ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা হতো, তাহলে দেশের অবস্থা আরও ভালো হতো।
আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান নিয়ে জোরদার আলোচনা করা দরকার। দুঃখের বিষয়, সে রকম আলোচনা কমই হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যেক মন্ত্রীর যে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। ‘মন্ত্রণালয়ের কাজে মন্ত্রীই শেষ কথা’—এই রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ এমপিদের মন্ত্রী করতে হবে। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী, আর নেপথ্যে দলের হাই কমান্ড ‘মন্ত্রিসভা’ গঠন করার রীতি চালু করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে হবে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রপতি নিছক একজন হুকুমবরদার হতে পারেন না। দলের গঠনতন্ত্রে নানা পরিবর্তন আনতে হবে। ‘দলপ্রধান’ ও ‘সরকারপ্রধান’ কখনো এক ব্যক্তি হতে পারবেন না। কোনো নেতা দুবারের বেশি (পর পর বা বিরতি দিয়ে হলেও) প্রধানমন্ত্রী বা দলপ্রধান হতে পারবেন না। উপদেষ্টাদের অবস্থান মন্ত্রীর ওপরে হবে না। প্রধানমন্ত্রী বড় মাপের সিদ্ধান্তে মতামত দেবেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজে সমন্বয় ও বড় মাপের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মনিটরিং করবেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার মতো তুচ্ছ রুটিন কাজে শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, শিক্ষামন্ত্রীরও জড়িত হওয়া উচিত নয়। এটা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাজও আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেছি। ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’ বলে কোনো আলাদা ভবন থাকা উচিত নয়। সচিবালয়েই অন্য মন্ত্রীর মতো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থাকবে।
আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য’ নিয়ে আলোচনা করলে দুই দল কিছুটা শিখতে পারত। এগুলো আমাদের মূল ও বড় মাপের ত্রুটি। ছোট ত্রুটি দূর করার আগে বড় ত্রুটিগুলো সংশোধন করা দরকার।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।