‘আরব বসন্ত’ কি ‘আরব শৈত্যে’ মোড় নিচ্ছে?
লেখক: রায়হান মাহতাব | সোমবার, ১৫ অক্টোবর ২০১২, ৩০ আশ্বিন ১৪১৯
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক ভাষণে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, ‘আরব বসন্ত আরব শৈত্যে বদলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’ আরব বসন্তের পরিণতি ভুল পথে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন তিনি। সিরিয়ায় চলমান সহিংসতা, যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ইসলাম-বিরোধী চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সহিংস বিক্ষোভ, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান, বাক-স্বাধীনতা ও গণদাবি দমনের প্রবণতা দেখে তিনি এই মূল্যায়ন করেছেন। গত এক-দেড় বছরে গণ-আন্দোলনের কারণে যেসব আরব দেশের সরকার পতন হয়েছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি সমীক্ষা ও গবেষণাতে সেগুলোর গণতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আরব বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন—আরব বসন্তের হাওয়া এখনো বইছে।
তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট মোনসেফ মারজৌকি আরব বসন্তের ব্যাপারে এখনো আশাবাদী। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সম্প্রতি তিনি এ ব্যাপারে এক উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। আরব বসন্তের মাধ্যমেই তিউনিসিয়ার শাসনক্ষমতায় আসতে পেরেছেন তিনি। মারজৌকি আরব বসন্তের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর বর্তমান অনুভূতি সম্পর্কেও ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার লেখার সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হলো—
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ধারণা—২০১০ সালের শেষ দিকে আরব দেশগুলোতে যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল, ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ কেন্দ্র করে সহিংস বিক্ষোভ তার সফলতাকে ম্লান করে দিয়েছে। গণজাগরণের জোয়ারে এবার ভাটা পড়েছে এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়েছে। তিউনিসিয়া ও মিসরে স্বৈরশাসকদের পতনের পরও জনগণের অসন্তোষ ও বিক্ষোভ আরব বসন্তের ব্যর্থতাকে তাদের চোখে স্পষ্ট করে তুলেছে। লিবিয়ার বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট ভবনে হামলা এবং বিক্ষোভকারীদের মুখে পশ্চিমা-বিরোধী স্লোগান দেখে সন্দেহবাদীরা ধারণা করছেন—ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে এক ধরনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ কাজ করছে।
মারজৌকি বলেন, ‘পশ্চিমা-বিরোধী বা পশ্চিমপন্থী—আরব বসন্ত এর কোনটিই নয়। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এর কোনো সংযোগ নেই। ধর্মীয় বিশ্বাস বা শরিয়া আইনের সঙ্গেও এর যোগসূত্র নেই। আরব বসন্তের পুরোটাই সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের দাবিকে কেন্দ্র করে। তিউনিসিয়া ও মিসরসহ বেশ কয়েকটি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার ফাঁকে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসলাম বা গণতন্ত্রের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদরাও অন্যদের মতোই। তারা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীদের চেয়ে বেশি বিশুদ্ধ, বেশি সংগঠিত বা বেশি উদার মানসিকতার নয়। আবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হতে গিয়ে ইসলামপন্থীদের মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছে। সহিংসতা ও শরিয়া আইনের সমর্থক কট্টরপন্থীদের প্রতি জনসমর্থন নেই। তারা আরব বা মুসলিমদেরও প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের তত্পরতাও রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় না, শুধুই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে।
বাস্তবে এখনো বড় ধরনের হুমকি তৈরি না করার পরও সংবাদ মাধ্যমগুলো চরমপন্থীদের গুরুত্ব ও শক্তিকে অতিমূল্যায়িত করেছে। ইসলাম ও মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে নির্মিত ইনোসেন্স অব মুসলিম-কে ঘিরে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে এমন উদাহরণ দেখা গেছে। নিউজউইক সাময়িকীর প্রচ্ছদ-পৃষ্ঠা এর একটি নমুনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সহিংসতা-বিরোধী বিক্ষোভও হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো সে দিকে খুব একটা নজর দেয়নি। শ্বেতাঙ্গবাদী বা নরওয়ের গণহত্যাকারীকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের জনগণের প্রতীক গণ্য করা যায় না, তেমনি কনস্যুলেট ভবন বা মার্কিন দূতাবাসে হামলাকারীদেরও আরব জনগণের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরে নেয়া যায় না। বরং মুসলিমদের ক্ষোভকে উসকে দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইনোসেন্স অব মুসলিম নিয়ে বিক্ষোভ চলাকালেই ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গ-চিত্র ছাপানো হয়েছে।
দীর্ঘ দিনের একনায়কতন্ত্রের পতনের পর আরব দেশগুলোতে নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি, সামাজিক উন্নয়নই মূল চিন্তার বিষয়। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এই কাজগুলো আরব বিশ্বের জন্য আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অবহেলা বা অবজ্ঞার পাত্র হতে চাচ্ছে না আরব দেশগুলো। বরং গণতান্ত্রিক শাসন শক্তিশালি করতে, চরমপন্থীদের কাছে অবৈধ অস্ত্রের জোগান ঠেকাতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা চাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.