সোমবার, ১৫ অক্টোবর ২০১২, ৩০ আশ্বিন ১৪১৯
দেশের পাঁচজন বিচারপতি, যাহারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন, তাহারা সম্মিলিতভাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৯৯২ সালের ৩০ জুলাই
গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক একটি রায় দিয়েছিলেন। ওই রায়ে দেশের বিদ্যমান স্থানীয়
সরকারের সকল স্তরে ‘অনির্বাচিত’ ব্যক্তিদের পরিবর্তে
নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে অবিলম্বে পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিলো। ওই
রায়ে সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করিয়া তাঁহারা লিখিয়াছিলেন, ‘আইন অনুযায়ী নির্বাচিত
ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক
এক-একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করিতে হইবে’। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ রায়ে বলিয়াছিলেন, ‘বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এইসব প্রতিষ্ঠান (স্থানীয় সরকার) দলীয়
রাজনীতি তথা স্বৈরাচারী শাসনের অশুভ পরিকল্পনার ফাঁদে পড়ে। ক্ষমতাসীন সরকারের
মনোনীত ব্যক্তি ও সরকারি আমলারা খুশিমত এই সব সংস্থাকে ব্যবহার করে’। রায়ে বলা হয়, ‘স্থানীয় সরকারকে
সংবিধানের কোথাও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। কিন্তু এর অর্থ হচ্ছে স্থানীয়ভাবে
নির্বাচিতরা স্থানীয় বিষয় দেখভাল করবে’। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন তার রায়ে বলেন, If government's officers or their henchmen (দলীয় প্রশাসক) are brought to run these local bodies,
there is no sense in retaining them as local government bodies. 44 DLR (AD)
(1992)। এই রায়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন ছাড়াও স্বাক্ষর করিয়াছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ
হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এটিএম আফজাল, বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও
বিচারপতি লতিফুর রহমান। এই ৫ জন বিচারপতি, যাহারা বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন, ইহাদের মধ্যে একজন
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং দুইজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন
করিয়াছেন।
কুড়ি বত্সর পর এই রায়কে
অবজ্ঞা করিয়া স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ঢাকা সিটি
করপোরেশনের (ডিসিসি) দুটি অংশে দু’জন প্রশাসক এবং ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়াছে বর্তমান সরকার। সরকার
একদিকে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিরোধিতা করিতেছে
অন্যদিকে উপরিউক্ত ৬৩টি প্রতিষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় ব্যক্তিদের প্রশাসক
পদে নিয়োগ দিয়াছে। ইহা সরকারের দ্বিমুখী নীতির প্রকাশ। ৮ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকে “স্বার্থ না থাকলে
সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানে না কোনো সরকার” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হইয়াছিলো “সর্বোচ্চ আদালতের রায়
মানার ক্ষেত্রে সরকার রাজনৈতিক স্বার্থকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। যে রায় সরকারের
বিরুদ্ধে যায় বা সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের বিপরীত হয়, সেই রায় না মানার অসংখ্য
নজির রয়েছে। আবার কোন কোন মামলা হাইকোর্টের রায়ের পর আপিল বিভাগে বিচারাধীন
থাকাবস্থায় তা কার্যকর করতে দেখা গেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত রায়
প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধনের ঘটনা ঘটিয়াছে। অন্যদিকে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার
মামলার রায় অনুযায়ী অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার কোন
উদ্যোগ দেখা যাইতেছে না। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ও সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করে নাই
সরকার।” এই ধরনের অসংখ্য ঘটনার
নজির রহিয়াছে। সরকারের ওই দ্বৈতনীতির ফলে জনগণ তাহাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখিতেছে।
একথা বলিলে অন্যায় হইবে না যে, সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং
সংবিধান তাহাদের কাছে বড় নয়, রাজনৈতিক স্বার্থই
তাহাদের কাছে এখন মুখ্য বিষয়ে পরিণত হইয়াছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানসম্মত না
হইলেও তাহাদের আন্দোলনের মুখে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনিতে বাধ্য হইয়াছিলো তত্কালীন
বিএনপি সরকার। এখন আদালত বলিতেছে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার
গঠন সংবিধানসম্মত নহে। এই রায় তাহাদের মন:পুত হইয়াছে। কেননা তাহাদের সরকারের
অধীনেই তাহারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করিতে পারিবে। এই কারণে তাহারা এখন জোর
গলায় বলিতেছেন অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তাহারা দিবেন
না। যাহারা এমন বলিতেছেন, তাহারাই আবার ৬৩টি
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের বসাইয়া দিয়েছেন। এবং এমন আইন করা
হইয়াছে যে, আজীবনকাল এমন অবস্থা বহাল
রাখিতে চাহিলে তাহা পারা যাইবে।
এই ধরনের দ্বৈতনীতি
পরিহার করিতে হইবে। নতুবা গণতন্ত্রের পথে সংঘাত, সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়িতেই থাকিবে। এই সন্দেহ-অবিশ্বাসের মুখে গণতন্ত্রের
ভবিষ্যত্ কি হইবে তাহা একমাত্র ভবিষ্যত্ই বলিতে পারিবে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.