পরস্পর বিরোধী আদর্শের রাজনীতিসহঅবস্থানের কৌশল ও নীতি দরকার
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পরিষ্কারভাবে দু'টো পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, অপরটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আদর্শ ও চরিত্রগতভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিচ্ছে উদারবাদী গণতন্ত্র বিশ্বাসীসহ বামের একটি ছোট অংশকে, বিএনপি দিচ্ছে মধ্যডান থেকে সর্বোডান পর্যন্ত প্রায় সকলকে। এমনটি কয়েক বছর আগেও ছিল না। দেশের রাজনীতি যেহেতু নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও ঘটনার মধ্য দিয়ে সব সময় নির্মিত হচ্ছে, রূপান্তর হচ্ছে, তাই এর অবস্থান সব সময় পরিবর্তনশীল থাকছে। যেহেতু দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরাজিত করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল তাই ১৯৭১-৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা তথা ডানপন্থা বা রক্ষণশীল রাজনীতির আদর্শের দলের অবস্থান প্রায় শূন্যের ঘরে নেমে আসে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থার রাজনীতির ধারক বাহক হলেও ১৯৭১-৭৫ সালে বিশ্ব ও দেশীয় বাস্তবতায় বামমুখিনতার দিকে তাকে তাকাতে হয়েছিল, বামপন্থার বিপ্লবী উত্থানের ঘুরপাকে বাংলাদেশ তখন অনেকটাই অস্থির ছিল। এ ধরনের অবস্থায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছিল। এর মাধ্যমে ডানপন্থার রাজনীতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে। ১৯৯০ পর্যন্ত এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে যে রাজনীতি দেশে বিকশিত হয়েছিল তাতে উদার বা মধ্যপন্থার রাজনীতি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৯১-এর নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে, মধ্যডানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি তখনো শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে অতি ডানপন্থি তথা ধর্মের নামধারী দলসমূহ ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে এককভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিশ্বাস থেকে এক ধরনের স্বতন্ত্র ও দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হয়েছিল, বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া অবস্থান তৈরিতে ততোটা আগ্রহী ছিল না—অনেকটা বামতাত্ত্বিকদের অনুকরণে বাংলাদেশে তাদের কাঙ্ক্ষিত ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার বাস্তবতায় দক্ষিণপন্থার এতোদিনকার বিশ্বাস ও তত্ত্বে নতুনভাবে সমীকরণ ঘটতে দেখা যায়। এ থেকে ১৯৯৯ সালে ৪ দলীয় জোটের গঠন এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ সকল ডান ঘরানার শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে দৃঢ় একটি অবস্থান গ্রহণে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে একলা চলা নীতি পরিহার করে আওয়ামী লীগও ২০০৫ সাল থেকে মধ্যবামসহ বেশ কিছু উদার শক্তিকে নিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। তখন এর সঙ্গে মধ্যডানের শক্তি জাতীয় পার্টিও হাফ হার্টেড হয়ে যুক্ত হয়। জাতীয় পার্টি ১৯৯৯ সালে ৪ দলীয় জোট প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েও প্রায় সম আদর্শের হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে একত্রে ঘর করতে পারেনি। কিন্তু তাতে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট মহাজোটে 'আছি নেই' অবস্থানে যুক্ত হয় এবং এখনও অবস্থান করছে। তবে জাপা ঘরানার একাধিক ছোট ছোট অংশ থেকে যায় ৪ দলীয় জোটে। দক্ষিণ পন্থার ৪ দলীয় এই জোট ২০০১-০৬ সালের শাসনকালে দেশকে কোনো সুশাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেয়ার তেমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। বিএনপি মধ্য ডানপন্থির অবস্থানে রাজনীতিকে বিকশিত না করে বরং উগ্র-জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের কাছে প্রায় আত্মসমর্পণ করেছিল। এর ফলে বিএনপি'র নেতৃত্বাধীন জোটের ঝোঁক অপেক্ষাকৃত ডানের রক্ষণশীলতার দিকেই প্রকাশিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতায় একটি কম্পন ও ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়, এ থেকে রাজনীতিতে আতঙ্কও সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি অতিবাম বা অতিডান-এর কোনোটিকেই গ্রহণে প্রস্তুত নয়—সেই সংকেতই ২০০১-০৬ সালে প্রদান করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রথম বাম উদারবাদী ধারাটির অস্থিরতায় বাংলাদেশ ডানের দিকে হেলে পড়ে, আবার ২০০১-০৬-এর অতিডানের উগ্রতায় মধ্যমপন্থি আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ এ সময়ে মধ্য উদার অবস্থানে অস্থির নয়, কিছুটা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। সেখানে কিছু মধ্য বাম জোটভুক্ত হলেও চিরায়ত বাম ধারার শক্তিসমূহ খুব ছোট হয়ে গিয়েও নিজস্ব অবস্থানে অটল থেকে যায়। এর ফলে আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি ঘটেনি বরং লাভই বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থি উদার গণতান্ত্রিক ধারা শক্তি হিসেবে একক কেন্দ্রিকতায় আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি সকল দক্ষিণপন্থি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে নিয়ে ২০১২ সালে ১৮ দলীয় জোটে আবির্ভূত হয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণটি আসলে কতোটা মধ্যপন্থায় অবস্থান করছে বা করবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিএনপি'র মধ্যে অতীত অতিডান ও অতিবামের প্রভাব বেশ প্রবল। মধ্যপন্থার গোষ্ঠীর অবস্থান তাতে সংহত হতে পারেনি। বিএনপি'র নেতৃত্ব এখনো পর্যন্ত স্থির কোনো অবস্থান নিতে পারেনি এর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও গতি-প্রকৃতিকে ভিত্তি প্রদানের। বিশেষত ২০০১-০৬ সালের ঐক্যজোট বিএনপিকে অতিমাত্রায় দক্ষিণদিকে ধাবিত করেছিল মৌলবাদী জঙ্গিবাদী শক্তিকে— তখন অনেকটাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় নির্ভরশীল করে তোলে। ২০০৭-পরবর্তী সময়ে বিএনপি'র সম্মুখে নিজস্ব ধারা নির্ধারণের সুযোগ এনে দিলেও বিএনপি তাতে খুব একটা মনোনিবেশ করেনি। বিএনপি'র অভ্যন্তরের শক্তির সমাবেশই তা করতে দিচ্ছে বলে মনে হয় না। ফলে বিএনপি পরিবর্তিত দেশীয় এবং বিশ্ব বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির মধ্যডানের অংশকে নেতৃত্ব দেয়ার কৌশল বা অবস্থান না গ্রহণ করায় এর অবস্থান ক্রমেই ডানে সরে যাচ্ছে, জনসমর্থনও বিরোধী অবস্থানে থেকেও আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। বিএনপি'র ধারণা বিএনপি অতীতের বিরোধিতার রাজনীতির পথ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। এটি এখনো আশাবাদের পর্যায়ে রয়েছে। এর বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের উপর। আওয়ামী লীগ ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বিরাটসংখ্যক ভোটার ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বিএনপি জোটকে ভোট দিতে পারে। এর সঙ্গে ১৮ দলীয় জোটের ভোট যুক্ত হয়ে ১৮ দল ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে কোনো কোনো মহল হিসাব কষে ফলাফল দাঁড় করাচ্ছে। তবে গত এক থেকে দুই দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সমাজ বাস্তবতা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জনমানসের রূপান্তরটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে উদার গণতন্ত্রের দিকে তরুণ প্রজন্মের আস্থা ও ঝোঁক ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। এসব প্রবণতা ও ইতিবাচক শক্তি দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ওপর আস্থাশীল না হয়ে বরং দিন দিন হতাশ হচ্ছে। হতাশার কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। এক. উগ্রবাদী শক্তির উত্থান ও কর্মকাণ্ডে দেশের আর্ত-সামজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা, দুই. দুর্নীতি, জোর-জবরদস্তির প্রবণতা বৃদ্ধি, তিন. মেধা বিকাশের পরিবর্তে অমেধাবীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, সর্বত্র তাদের লালন ও প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা, চার. রাজনীতিতে সংঘাত ও বিরোধাত্মক অবস্থানকে পুঁজি করে চলা, পাঁচ. গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদানে কোনো কোনো মহলের চরম অনীহা এবং ছয়. শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকে অবলম্বন করে মাঠ গরম করা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরস্পরবিরোধী আদর্শ ও অবস্থানের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে তাতে বিরোধ-সংঘাতের আদর্শিক বীজ খুব গভীরে লুকায়িত রয়েছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত দু'টো জোটের প্রধান দু'টো দলই মতাদর্শগতভাবে কাছাকাছি-স্পষ্ট করেই বলছি গণতন্ত্রের উদারবাদী আদর্শের খুব কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে পরিণত না হচ্ছে (একটি হলে চলবে না) ততক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির একটির অবস্থান মধ্যপন্থার কাছাকাছি হলেও অন্যটি দক্ষিণ মেরুতেই সরে থাকা বা যাওয়ার কারণে দূরত্ব, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বিদ্যমান থেকেই যাবে। এই বাস্তবতা খুব সহজে নিরসন হবে-তা বলা মুশকিল। তবে তাদের মধ্যে সহঅবস্থানের পন্থা বা কৌশল বা অবস্থা নীতিগুলো কী হবে তা বোধ হয় নির্ধারণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এতদিনেও এই দুই দল বা জোটের মধ্যে সহঅবস্থানের কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি তৈরি হয়নি। ফলে একদল ক্ষমতায় গেলে অন্য দলের অবস্থান অবস্থা একেবারেই ভিন্ন থাকে। এ ক্ষেত্রে আমরা সবকিছুকে আবার এক করে দেখার চেষ্টাও করছি। ক্ষমতায় দুই দল বা জোটের অবস্থান ও কার্যক্রম কিন্তু চরিত্রগতভাবে একরকম ছিল না। তফাত্গুলো বোঝার মধ্যে দেখা যায় যথেষ্ট বৈরি আচরণ বিদ্যমান ছিল বা আছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আচরণ বলতে যা বোঝায় তার অনুপস্থিতি কোনো কোনো দিক থেকে প্রবল, কোনো দিক থেকে কম ছিল মাত্র। ফলে এক ধরনের বৈরি সম্পর্ক নিয়েই দুই দলের বা জোটের রাজনীতি ক্রিয়াশীল রয়েছে। যুক্তির শাসন মানার ক্ষেত্রে এক পক্ষের অনীহাই অন্য পক্ষকে অসংযত করে ফেলতে পারে। তেমনটিই ঘটছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সব দীর্ঘদিনের ক্ষত রয়েছে সেগুলোকে সংবেদনশীলতা দিয়ে দেখার সংস্কৃতির কথা গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও গলাবাজির রাজনীতিকে পরিহার করে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার চর্চাকে দল বা জোটে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। এসবই মধ্যপন্থার রাজনীতির উপজীব্য বিষয়। দেশের আর্ত-সামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের পশ্চাত্পদতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ এবং জনসাধারণকে আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বেড়ে উঠার রাষ্ট্র গঠনে উভয়পক্ষকেই মেরুর নীতি নয়, যুক্তি ও চর্চার নীতি অনুসরণ করতে হবে। তবেই আধুনিক বিশ্ব বাস্তবতায় রাজনীতি সংস্কৃতি সংঘাতের পরিবর্তে সহঅবস্থানে পরিচালিত হওয়ার পরিবেশ লাভ করবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থার রাজনীতির ধারক বাহক হলেও ১৯৭১-৭৫ সালে বিশ্ব ও দেশীয় বাস্তবতায় বামমুখিনতার দিকে তাকে তাকাতে হয়েছিল, বামপন্থার বিপ্লবী উত্থানের ঘুরপাকে বাংলাদেশ তখন অনেকটাই অস্থির ছিল। এ ধরনের অবস্থায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছিল। এর মাধ্যমে ডানপন্থার রাজনীতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে। ১৯৯০ পর্যন্ত এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে যে রাজনীতি দেশে বিকশিত হয়েছিল তাতে উদার বা মধ্যপন্থার রাজনীতি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৯১-এর নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে, মধ্যডানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি তখনো শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে অতি ডানপন্থি তথা ধর্মের নামধারী দলসমূহ ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে এককভাবে এগিয়ে যাওয়ার বিশ্বাস থেকে এক ধরনের স্বতন্ত্র ও দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হয়েছিল, বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া অবস্থান তৈরিতে ততোটা আগ্রহী ছিল না—অনেকটা বামতাত্ত্বিকদের অনুকরণে বাংলাদেশে তাদের কাঙ্ক্ষিত ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসার বাস্তবতায় দক্ষিণপন্থার এতোদিনকার বিশ্বাস ও তত্ত্বে নতুনভাবে সমীকরণ ঘটতে দেখা যায়। এ থেকে ১৯৯৯ সালে ৪ দলীয় জোটের গঠন এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ সকল ডান ঘরানার শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে দৃঢ় একটি অবস্থান গ্রহণে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে একলা চলা নীতি পরিহার করে আওয়ামী লীগও ২০০৫ সাল থেকে মধ্যবামসহ বেশ কিছু উদার শক্তিকে নিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। তখন এর সঙ্গে মধ্যডানের শক্তি জাতীয় পার্টিও হাফ হার্টেড হয়ে যুক্ত হয়। জাতীয় পার্টি ১৯৯৯ সালে ৪ দলীয় জোট প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েও প্রায় সম আদর্শের হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে একত্রে ঘর করতে পারেনি। কিন্তু তাতে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট মহাজোটে 'আছি নেই' অবস্থানে যুক্ত হয় এবং এখনও অবস্থান করছে। তবে জাপা ঘরানার একাধিক ছোট ছোট অংশ থেকে যায় ৪ দলীয় জোটে। দক্ষিণ পন্থার ৪ দলীয় এই জোট ২০০১-০৬ সালের শাসনকালে দেশকে কোনো সুশাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেয়ার তেমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। বিএনপি মধ্য ডানপন্থির অবস্থানে রাজনীতিকে বিকশিত না করে বরং উগ্র-জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের কাছে প্রায় আত্মসমর্পণ করেছিল। এর ফলে বিএনপি'র নেতৃত্বাধীন জোটের ঝোঁক অপেক্ষাকৃত ডানের রক্ষণশীলতার দিকেই প্রকাশিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতায় একটি কম্পন ও ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়, এ থেকে রাজনীতিতে আতঙ্কও সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি অতিবাম বা অতিডান-এর কোনোটিকেই গ্রহণে প্রস্তুত নয়—সেই সংকেতই ২০০১-০৬ সালে প্রদান করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রথম বাম উদারবাদী ধারাটির অস্থিরতায় বাংলাদেশ ডানের দিকে হেলে পড়ে, আবার ২০০১-০৬-এর অতিডানের উগ্রতায় মধ্যমপন্থি আওয়ামী লীগে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ এ সময়ে মধ্য উদার অবস্থানে অস্থির নয়, কিছুটা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। সেখানে কিছু মধ্য বাম জোটভুক্ত হলেও চিরায়ত বাম ধারার শক্তিসমূহ খুব ছোট হয়ে গিয়েও নিজস্ব অবস্থানে অটল থেকে যায়। এর ফলে আওয়ামী লীগের তেমন ক্ষতি-বৃদ্ধি ঘটেনি বরং লাভই বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ মধ্যপন্থি উদার গণতান্ত্রিক ধারা শক্তি হিসেবে একক কেন্দ্রিকতায় আবির্ভূত হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি সকল দক্ষিণপন্থি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠিকে নিয়ে ২০১২ সালে ১৮ দলীয় জোটে আবির্ভূত হয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণটি আসলে কতোটা মধ্যপন্থায় অবস্থান করছে বা করবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিএনপি'র মধ্যে অতীত অতিডান ও অতিবামের প্রভাব বেশ প্রবল। মধ্যপন্থার গোষ্ঠীর অবস্থান তাতে সংহত হতে পারেনি। বিএনপি'র নেতৃত্ব এখনো পর্যন্ত স্থির কোনো অবস্থান নিতে পারেনি এর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও গতি-প্রকৃতিকে ভিত্তি প্রদানের। বিশেষত ২০০১-০৬ সালের ঐক্যজোট বিএনপিকে অতিমাত্রায় দক্ষিণদিকে ধাবিত করেছিল মৌলবাদী জঙ্গিবাদী শক্তিকে— তখন অনেকটাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় নির্ভরশীল করে তোলে। ২০০৭-পরবর্তী সময়ে বিএনপি'র সম্মুখে নিজস্ব ধারা নির্ধারণের সুযোগ এনে দিলেও বিএনপি তাতে খুব একটা মনোনিবেশ করেনি। বিএনপি'র অভ্যন্তরের শক্তির সমাবেশই তা করতে দিচ্ছে বলে মনে হয় না। ফলে বিএনপি পরিবর্তিত দেশীয় এবং বিশ্ব বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির মধ্যডানের অংশকে নেতৃত্ব দেয়ার কৌশল বা অবস্থান না গ্রহণ করায় এর অবস্থান ক্রমেই ডানে সরে যাচ্ছে, জনসমর্থনও বিরোধী অবস্থানে থেকেও আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। বিএনপি'র ধারণা বিএনপি অতীতের বিরোধিতার রাজনীতির পথ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। এটি এখনো আশাবাদের পর্যায়ে রয়েছে। এর বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের উপর। আওয়ামী লীগ ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বিরাটসংখ্যক ভোটার ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বিএনপি জোটকে ভোট দিতে পারে। এর সঙ্গে ১৮ দলীয় জোটের ভোট যুক্ত হয়ে ১৮ দল ক্ষমতায় যেতে পারবে বলে কোনো কোনো মহল হিসাব কষে ফলাফল দাঁড় করাচ্ছে। তবে গত এক থেকে দুই দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সমাজ বাস্তবতা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জনমানসের রূপান্তরটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে উদার গণতন্ত্রের দিকে তরুণ প্রজন্মের আস্থা ও ঝোঁক ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। এসব প্রবণতা ও ইতিবাচক শক্তি দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ওপর আস্থাশীল না হয়ে বরং দিন দিন হতাশ হচ্ছে। হতাশার কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। এক. উগ্রবাদী শক্তির উত্থান ও কর্মকাণ্ডে দেশের আর্ত-সামজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা, দুই. দুর্নীতি, জোর-জবরদস্তির প্রবণতা বৃদ্ধি, তিন. মেধা বিকাশের পরিবর্তে অমেধাবীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, সর্বত্র তাদের লালন ও প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা, চার. রাজনীতিতে সংঘাত ও বিরোধাত্মক অবস্থানকে পুঁজি করে চলা, পাঁচ. গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদানে কোনো কোনো মহলের চরম অনীহা এবং ছয়. শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিকে অবলম্বন করে মাঠ গরম করা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরস্পরবিরোধী আদর্শ ও অবস্থানের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে তাতে বিরোধ-সংঘাতের আদর্শিক বীজ খুব গভীরে লুকায়িত রয়েছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত দু'টো জোটের প্রধান দু'টো দলই মতাদর্শগতভাবে কাছাকাছি-স্পষ্ট করেই বলছি গণতন্ত্রের উদারবাদী আদর্শের খুব কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে পরিণত না হচ্ছে (একটি হলে চলবে না) ততক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির একটির অবস্থান মধ্যপন্থার কাছাকাছি হলেও অন্যটি দক্ষিণ মেরুতেই সরে থাকা বা যাওয়ার কারণে দূরত্ব, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বিদ্যমান থেকেই যাবে। এই বাস্তবতা খুব সহজে নিরসন হবে-তা বলা মুশকিল। তবে তাদের মধ্যে সহঅবস্থানের পন্থা বা কৌশল বা অবস্থা নীতিগুলো কী হবে তা বোধ হয় নির্ধারণ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এতদিনেও এই দুই দল বা জোটের মধ্যে সহঅবস্থানের কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি তৈরি হয়নি। ফলে একদল ক্ষমতায় গেলে অন্য দলের অবস্থান অবস্থা একেবারেই ভিন্ন থাকে। এ ক্ষেত্রে আমরা সবকিছুকে আবার এক করে দেখার চেষ্টাও করছি। ক্ষমতায় দুই দল বা জোটের অবস্থান ও কার্যক্রম কিন্তু চরিত্রগতভাবে একরকম ছিল না। তফাত্গুলো বোঝার মধ্যে দেখা যায় যথেষ্ট বৈরি আচরণ বিদ্যমান ছিল বা আছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আচরণ বলতে যা বোঝায় তার অনুপস্থিতি কোনো কোনো দিক থেকে প্রবল, কোনো দিক থেকে কম ছিল মাত্র। ফলে এক ধরনের বৈরি সম্পর্ক নিয়েই দুই দলের বা জোটের রাজনীতি ক্রিয়াশীল রয়েছে। যুক্তির শাসন মানার ক্ষেত্রে এক পক্ষের অনীহাই অন্য পক্ষকে অসংযত করে ফেলতে পারে। তেমনটিই ঘটছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সব দীর্ঘদিনের ক্ষত রয়েছে সেগুলোকে সংবেদনশীলতা দিয়ে দেখার সংস্কৃতির কথা গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও গলাবাজির রাজনীতিকে পরিহার করে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার চর্চাকে দল বা জোটে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। এসবই মধ্যপন্থার রাজনীতির উপজীব্য বিষয়। দেশের আর্ত-সামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের পশ্চাত্পদতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যে অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ এবং জনসাধারণকে আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বেড়ে উঠার রাষ্ট্র গঠনে উভয়পক্ষকেই মেরুর নীতি নয়, যুক্তি ও চর্চার নীতি অনুসরণ করতে হবে। তবেই আধুনিক বিশ্ব বাস্তবতায় রাজনীতি সংস্কৃতি সংঘাতের পরিবর্তে সহঅবস্থানে পরিচালিত হওয়ার পরিবেশ লাভ করবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments:
Post a Comment
Thanks for visiting.