বিকল্পের সংকটই দেশের বড় সংকট
লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম | সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১২, ৭ কার্তিক ১৪১৯
দেশবাসী আজ বহুমুখী সমস্যা-সংকটের সম্মুখীন। এক কথায়, দেশে বিরাজ করছে সংকটের পাহাড়। এসব পর্বত পরিমাণ সংকটের ওপর আরো অতিরিক্ত যে সংকটটি দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা হল- এই অব্যাহত সংকট থেকে মুক্তির দিশা দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে না। অর্থাত্ সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো সংকট নিরসনের সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ার সংকট। অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর নিশানা খুবই ক্ষীণ।
জীবন যন্ত্রণায় কাতর দেশের শ্রমজীবী মানুষসহ জনগণের মনে তাই বাসা বেঁধেছে গভীর হতাশা। এই হতাশা ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তা এখনো স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিত। প্রগতি ও গণতন্ত্রের শক্তি এখনও তাকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সংগঠিত করে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির আকার দিতে সক্ষম হয়নি। তাই এই হতাশা ও স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে বহুলাংশে কাজে লাগাতে পারছে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ফলে দেশ সমস্যা-সংকটের আবর্তে অব্যাহতভাবে বন্দী হয়ে থাকছে। আরো বিপজ্জনক দুর্যোগের দিকে চলে যাবার আশঙ্কাও আজ সৃষ্টি হয়ে আছে।
দশকের পর দশক ধরে যাদের নেতৃত্বে ও যেভাবে দেশ চলছে, তাতে দেশবাসী আজ দিশাহারা। এক কথায়, মানুষ প্রায় সবকিছুর ওপর, যাকে বলে একেবারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে তারা মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির দিশা ও শক্তির পর্যাপ্ত দৃশ্যমান উপস্থিতি এখনো সেভাবে তাদের চোখে পড়ছে না। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দৃশ্যপটে, অন্যান্য সব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি, এটিই হলো প্রধান চ্যালেঞ্জ।
আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে দ্রব্যমূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। জিনিসপত্রের দাম কমার বদলে তা হু হু করে কয়েকগুণ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য আজ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। এসব ক্ষেত্রে সরকার চাহিদা-সরবরাহ, আন্তর্জাতিক বাজার দর ও বাজার অর্থনীতির দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু সরকার তার প্রতিশ্রুতি মতো রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেনি। শক্তিশালী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। বরঞ্চ নিজেই সে ছয় বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। পেট্রোল, ডিজেল, পানি, গ্যাস ইত্যাদির দাম বাড়িয়েছে। অথচ গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় বাড়েনি বললেই চলে। অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষকে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। লুটপাট চালিয়ে সম্পদের পাহাড় বানানো হচ্ছে। সরকারের উঁচু মহলের যোগসাজশে এসব করা হচ্ছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, যুবক ও ডেসটিনির বাটপাড়ি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ভূমিদস্যুতা, চোরাকারবারির রমরমা ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি কয়েকটি বড় বড় কেলেঙ্কারির খবর থেকেই লুটপাটের ব্যাপ্তি ও মাত্রা অনুমান করা যায়। অর্থমন্ত্রীর নিজের কথা অনুসারেই দৃশ্যমান অর্থনীতির মোট পরিমাণের তিন-চতুর্থাংশই হলো তার বাইরে থাকা চোরাই কালো অর্থনীতি। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন কালো টাকার মালিক লুটেরা ধনীকদের হাতে। একদিকে দারিদ্র্যের সাগর ও অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষের হাতে কল্পনাতীত বিত্ত-ভৈবব। দেশে এখন পৃথক দুই অর্থনীতি, দুই সমাজ, দুই দেশ তৈরি হয়ে গেছে। এসবের প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে তারল্য সংকট, বিনিয়োগ সমস্যা, সুদের হারের অস্থিরতাসহ নানা রকমের অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে বড় বড় লুটপাটের ঘটনার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি, তদবিরবাজি, বেপরোয়া দখলদারিত্ব, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, জবরদস্তি ইত্যাদির বিস্তার ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বেড়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। এসবকে ভিত্তি করে ছড়িয়ে পড়েছে হত্যা, খুন, কিডন্যাপিং, নারী-নির্যাতন, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী লালন, গডফাদারদের দৌরাত্ম্য, প্রভাব বিস্তার নিয়ে হানাহানিসহ অপরাধমূলক নানা কাজকর্ম। একই সাথে অব্যাহত আছে ক্রসফায়ার-হত্যা-গুমের লোমহর্ষক সব ঘটনা। মানুষের জীবনে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে আজ আর কিছু নেই। বেডরুম থেকে খোলা মাঠ, কোথাও মানুষ আজ নিরাপদ নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানাহানি, নৈরাজ্যের ঘটনা বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা— সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করার মাধ্যমে সমাজের বাণিজ্যিকীকরণকে সর্বগ্রাসী করে তোলা হচ্ছে। পুঁজিবাদী লুটপাটের প্রয়োজনে পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণী-উদ্ভিদ জগত্— সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। নগদ লাভের লোভে বিনষ্ট করা হচ্ছে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের অস্তিত্ব।
গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত দুর্বল ও খর্ব করা হচ্ছে, শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করে রাখা হয়েছে। তাদের সংগ্রামকে দমন করার জন্য গঠন করা হয়েছে শিল্প-পুলিশ। ঢাকা শহর ও অন্যান্য শহরে জনসভা করার জায়গা কেড়ে নেয়া হয়েছে। মিটিং-মিছিলে চালানো হচ্ছে বর্বর আক্রমণ। ওয়ান-ইলেভেনের এজেন্ডা শেষ হয়নি বলে বারবার বলা হচ্ছে। গণতন্ত্র আজ খর্বিত ও আক্রান্ত। সংবিধানকে এখনো মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনা হয়নি। দুঃখের বিষয়, অনেক ক্ষেত্রেই এদেশে এখনও মোশতাক, জিয়া, এরশাদের ব্যবস্থা ও ধারা বহাল রাখা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আজ দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শ্রেণীচরিত্র বদলে গেছে। এক সময় সেখানে প্রাধান্য ছিল মধ্যবিত্তের। আওয়ামী নেতৃত্ব এখন লুটেরা ধনিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে।
বাজার অর্থনীতি জন্ম দিয়েছে বাজার রাজনীতির। বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের খড়্গের নিচে পড়ে রাজনীতি হয়ে পড়েছে রুগ্ন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লুটেরাদের মদদে ‘হালুয়া-রুটির অপরাজনীতির’ দাপট ‘আদর্শের রাজনীতিকে’ কোণঠাসা করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এ দু’টি বুর্জোয়া দলকে কেন্দ্র করে যে দু’টি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলা হয়েছে তারা ‘হালুয়া-রুটির অপরাজনীতির’ এই অসুস্থ ধারাকে লালন করছে। এই দুই দলের মদদে রুগ্ন রাজনীতি আজ একচ্ছত্র প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। দ্বিদলীয় মেরুকরণ ভিত্তিক যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে বেঁধে ফেলা হয়েছে তা বহুলাংশেই দেশি-বিদেশি শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফসল। পর্দার পেছন থেকে দেশি-বিদেশি শক্তি রিমোট কন্ট্রোলে দেশ চালায়। তারা এমন একটি ‘সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে যাতে সবসময় সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আমাদের দেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ আরো বেড়েছে। নানা অজুহাতে দেশের মাটিতে স্পেশাল ফোর্স, মেরিন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এমনভাবে সর্বক্ষণ আসা-যাওয়া করছে যাতে করে এখানে তারা তাদের এক ধরনের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিয়েছে। হানা, সোফা ইত্যাদি নানা গোপন চুক্তিতে তারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আনাগোনা করছে। মার্কিন নৌ-বাহিনীর স্থায়ী উপস্থিতির সুযোগের জন্য তারা চাপ বাড়াচ্ছে। তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেয়াসহ অর্থনৈতিকভাবে এদেশকে শোষণের শিকলে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলার জন্য তারা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করাসহ নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ আছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই বিষয়ে, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে। কিন্তু দুর্নীতির কথা তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রথমে বন্ধ করে দিয়ে পরে আবার তা চালু করা হবে বলে ঘোষণা দিয়ে এখন নতুন-নতুন প্রবল প্রতিকূল ও অমর্যাদাকর শর্ত আরোপ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্ঘাতি তত্পরতা শেষ হয় নেই। ভারতের সাথে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে হত্যা, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময়, তিন বিঘা হস্তান্তর, বাণিজ্য বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ তার ষড়যন্ত্রকে জোরদার করতে সক্ষম হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদ এখন এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে তার তত্পরতার প্রধান ক্ষেত্র বানিয়েছে। বিদেশে মোতায়েন তার নৌ সেনার ৬০ শতাংশ এই অঞ্চলে রাখার কথা সে ঘোষণা করেছে। ‘গণচীনকে ঠেকাও’-এর স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সে চীনকে ঘেরাওয়ের মধ্যে রাখার কৌশল নিয়েছে। ভারতকে সেই স্ট্র্যাটেজিতে শামিল করতে পারা সত্ত্বেও ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কিছু স্বার্থের ফারাকও আছে। এই অবস্থায়, প্রয়োজনমতো বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের ‘হাত মোচড়ানো’র দ্বারা তাকে ষোল আনা পদানত করছে সাম্রাজ্যবাদ। শুধু পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেই নয়, সাম্রাজ্যবাদ আজ বিশ্ব মানবতার প্রধান দুশমন হিসেবে বিরাজ করছে। ‘সীমিত সার্বভৌমত্ব’, ‘আগাম আক্রমণ’, ‘একতরফাবাদ’, ‘রেজিম চেইঞ্জ’ ইত্যাদি নব্য-উপনিবেশবাদী নানা তত্ত্ব হাজির করে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তার যাবতীয় আগ্রাসী অপতত্পরতা চালাচ্ছে।
৩০ লাখ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ— এই চার মূলনীতির ধারায় দেশকে পরিচালিত করার যে স্বপ্ন সেদিন তারা দেখেছিল, তা বহুলাংশেই আজ ছিনতাই হয়ে গেছে। শোষণ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, অন্যায়-অনাচারে দেশ আজ ডুবতে বসেছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও আজ সাম্রাজ্যবাদের কাছে কার্যতঃ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। দেশের এই পরিণতির জন্য দায়ী হল দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন এবং দীর্ঘতর সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দু’টি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বে পরিচালিত নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের শাসন। যে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর লুটেরা ধনবাদী পথে তারা দেশ শাসন করেছে ও করছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো এসব সমস্যা-সংকটের ক্রমবর্ধমান বোঝা। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যাগ করেছে। বিএনপি’র রাজনীতি শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ধারার মূলনীতিসমূহ—তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নীতির বাইরে ছিল ও আছে।
দেশের মানুষ নিত্যদিন নিদারুণ দুর্যোগ ভোগ করছে। এখন তাদের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে তারা আজ পরিত্রাণ চায়। এজন্য প্রয়োজন লুটেরা ধনীকমুখী পুঁজিবাদী ধারা পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায়, তথা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে গরিব, মেহনতি ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করা। সেই স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি আমূল ঢেলে সাজানো উচিত। অন্যদিকে প্রয়োজন বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির পর্যায়ক্রমিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে বামপন্থি-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা। একথাও মনে রাখা অত্যাবশ্যক যে, দেশের বর্তমান সংকটজাল ছিন্ন করতে হলে একই সাথে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রে আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন সংগঠিত করতে হবে। এজন্য একাধারে গড়ে তুলতে হবে শ্রেণী আন্দোলন ও গণআন্দোলনের নতুন জোয়ার। আওয়ামী লীগের হাতে দেশের শাসনভার অব্যাহত থাকলে দেশ ও জনগণ আরো গভীর সংকটে ডুবে যাবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি-জামায়াতের শাসনকে ফিরে আসতে দিলে অবস্থা হয়ে উঠবে আরো ভয়াবহ। তা হবে ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত চুলায় ঝাঁপ দেয়ার’ মতো ব্যাপার। দেশবাসী এখন আছে ‘আপদের’ মধ্যে। সামনে আছে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের ‘বিপদের’ আশঙ্কা। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে ওয়ান ইলেভেনের ‘মুসিবত’ ওত পেতে আছে। তাছাড়া এসব দুর্যোগের আশংকাকে ছাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে জামায়াত-শিবির-সাম্প্রদায়িক জঙ্গীবাদের ‘মহাবিপদ’। এসবের মাঝ দিয়েই এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে হবে জাতিকে। কাজটি সহজসাধ্য নয় একারণে যে, এখনই হাতের কাছে সত্, দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বামপন্থিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব দেখতে পওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এটির প্রয়োজন খুবই জরুরি। বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প গড়ে তোলার কাজটি কঠিন হলেও তা অসম্ভব নয়। তার কারণ হলো এই যে, এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির জোরদার দৃশ্যমান উপস্থিতি সেভাবে চোখের সামনে দেখতে না পাওয়া গেলেও, তার উপাদানগুলো দেশে বিদ্যমান আছে। তবে সেগুলো এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বিকল্পের সব সম্ভাব্য উপাদান ও শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে পারলে তা সহজেই দৃশ্যমান হবে। অন্যদিকে জনগণ শক্তিশালী বিকল্পের জন্য অধীর হয়ে আছে। তাই, যা এক্ষেত্রে প্রয়োজন তাহল বিকল্পের সম্ভাব্য শক্তির মধ্যে একাগ্রতা ও একতা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তারা যদি অবিলম্বে এ কাজে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে না আসে তাহলে তারাও ইতিহাসের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি