Tuesday, August 14, 2012


বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস




মানুষের জন্মগত অধিকার স্বাধীনতা । কিন্তু এদেশের স্বাধীকার ইতিহাস পর্যালোচনা বিশ্লেষণে এটাই সুনির্দিষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে, বাঙালীর ভাগ্যপরিক্রমা রাজনৈতিকভাবে চিরদিন ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ঘুরেছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে লর্ড ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে সেনাপতি মীর জাফর আলি খাঁ ও তার অনুচরদের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। আর এর সাথেই বাংলার ভাগ্যাকাশে বাঙালীর স্বাধীনতার সূর্য চিরতরে অস্তমিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালের ইতিহাস বিদেশী ইংরেজ শাসকদের অবিচার, অনাচার, নির্যাতন, কুশাসন, শোষণ ও বঞ্চনার নির্মম ইতিহাস। কিন্তু বাঙালীরা কখনোই এই ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ সহজে মাথা পেতে নেয়নি।

বাঙালীরা এই শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। লর্ড ডালহৌসি চলে যাবার পর লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ সালে এদেশের গভর্নর জেনারেল হয়ে এলেন। আর তখনই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এ উপমহাদেশের সর্বত্র পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রতিবাদী রূপ পায়। ১৮৫৭ সালে জনতার এই অসন্তোষ সিপাহী বিদ্রোহের আকারে আত্মপ্রকাশ করে। বিদেশী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী জনতার এটাই এদেশের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম। সংক্ষেপে বললে এরপর বাংলার সুযোগ্য সন্তান তিতুমীর, টিপু সুলতান ও শরীয়তুল্লাহ প্রমূখের প্রতিরোধ সংগ্রাম, চট্টগ্রামের অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন প্রমুখের সশস্ত্র প্রতিবাদ। পাশাপাশি চলে মুসলিম লিগ ও ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতি ভিত্তিক পরিকল্পনায় ভারতবর্ষকে দুভাগ হয়ে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান নামে দুটো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম এর দুটো অংশ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব হয় প্রায় দেড় হাজার মাইলের মতো। স্বাধীন হয়েও পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে পশ্চিমাংশের কলোনী হয়ে উঠল, এখানকার বাঙালীরা আগের মতোই রয়ে গেল। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না।
স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই আঘাত এল বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের জনক ও গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। বাঙালীরা বুঝে নিল পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটেনি। শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। এল অমর ২১ ফেব্রুয়ারি। ছাত্রজনতার মিছিল আর শ্লোগানে মুখর হয়ে উঠল রাজপথ। দেশব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হলো।

১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন হলো। এল ৯২-ক ধারা, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হলো। সেইসঙ্গে শুরু হলো স্বায়ত্বশাসনের দাবি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমানের কুখ্যাত শিক্ষাকমিশন রিপোর্টকে ঘিরে শিক্ষানীতি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবর রহমান শুরু করলেন তার ঐতিহাসিক ছ’দফা আন্দোলন। প্রবল এই বিক্ষোভের মুখে সংগ্রামী জনতার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো আইয়ুব সরকার। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতা থেকে নেমে যান ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। আর সঙ্গে সঙ্গে তার জায়গা নেন আরেক জান্তা ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতায় এসেই সামরিক শাসন জারি করেন তিনি। জাতির প্রতি দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন ও জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দান করেন।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাত্রে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর এক প্রলয়কারী ঘূর্ণিঝড় ও সর্বনাশা সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। সেই সঙ্গে গৃহহীন হয় আরো ত্রিশ লাখ। এ ভয়াবহ দুর্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার রইল সম্পূর্ণ নিরব দর্শকের ভূমিকায়।

১৯৭০ সালে চরম চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায়, যা সমগ্র পাকিস্তানের সর্বমোট ৩০০ আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তৎকালীন সামরিক সরকার এই ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। সোজা হিসেবে এই প্রথম পাকিস্তান শাসন করবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তানের সামরিক সরকার তখনই সিদ্ধান্তô নিয়ে নিল, কোনভাবেই বাঙালীদের নিকট পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেয়া যাবে না। ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকলেও ইয়াহিয়া খান সেটি বাইরে বোঝাতে চাইল না। তাই তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারী ঘোষনা করলেন ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। কিন্তু ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। এরফলে সারাদেশে বিক্ষোভের যে বিস্ফোরন ঘটল তার কোন তুলনা নেই। শেখ মুজিবর রহমান ঢাকা ও সারাদেশে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ঢাক দিলেন। ৫ দিনের হরতালের পর ৭ মার্চ ’৭১ সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বাসভবনে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাক্ষাত করেন। এ বৈঠকে রাষ্ট্রদূত তার সরকারের সিদ্ধান্তের কথা শেখ মুজিবকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তা হলো- ’পূর্ব বাংলার স্বঘোষিত স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র কখনোই সমর্থন করবে না। এদিকে ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকেল প্রায় সাড়ে চারটায় বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক বক্তৃতায় চার দফা দাবির কথা উত্থাপন করেন- ১· সামরিক আইন প্রত্যাহার। ২· সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন। ৩· নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ। ৪· প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৭ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানালেন। এই মর্মে ১০ দফা কর্মসূচী প্রকাশিত হয়।

এইরকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ৯ মার্চ ’৭১ ঢাকার পল্টনের জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লক্ষ্যে প্রদেশব্যাপী সংগ্রামের আহ্বান জানালেন।

১৫ মার্চ ’৭১ জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ’পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা গুরু। তাই কেন্দ্রের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লিগের কাছে আর পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির কাছেই হস্তান্তর করতে হবে।’

১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কঠোর সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকায় আসেন। কোনো সহযোগী ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমান ১৬ মার্চ ’৭১ প্রথম দফা বৈঠকে মিলিত হন। পরে এ আলোচনা মুলতবী হয়ে যায়। পরে এ আলোচনা মুলতবী হয়ে যায়। ১৭ মার্চ দ্বিতীয় দফা বৈঠকে দুপরে পরামর্শদাতারাও যোগ দিলেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে রাতে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়। রাত ১০টায় গভর্নর টিক্কা খান জিওসি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে ফোনে বাঙালী নিধনযজ্ঞের নীল নকশা ’অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

এদিকে ইয়াহিয়া-মুজিব তৃতীয় বৈঠকে মিলিত হন। ইয়াহিয়া এই বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনার ভান করলেও আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ায় জনগন চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়। শুরু হলো প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৯ মার্চের ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক প্রায় ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়, পরে সন্ধ্যায় তাদের পরামর্শদাতারা আলাদা বৈঠকে বসেন। ২০ মার্চ বসে মুজিব-ইয়াহিয়া চতুর্থ বৈঠক, যার শেষ দিকে দুপুরে পরামর্শদাতারাও নানা ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় বসেন।

অন্যদিকে এ অঞ্চলের গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলে ফ্ল্যাগস্টাফ হাউজে। জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এই বৈঠকে জেনারেল টিক্কা খানকে গণহত্যার নীল নকশা ’অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের সবুজ সংকেত দেন।

২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকে সমঝোতার সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন, সমস্যা সমাধানে ত্রি-পক্ষীয় সমঝোতা হতে হবে। এই মর্মে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া, শেখ মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা চলে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই ছিল আলোচনার নামে প্রহসন। এই দীর্ঘ আলোচনা পশ্চিমী সামরিক বাহিনীকে জাহাজ ও বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় প্রচুর অস্ত্র ও সৈন্য আনার সুযোগ করে দেয়।

শেখ মুজিবর রহমান ২৭ মার্চ সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করেন। এই পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। দেশবাসী এমনকি বিশ্ববাসীও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়ী সংখ্যাগুরু দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে সমঝোতার ব্যাপারে কিছুটা আশাবাদী ছিল।

কিন্তু বর্বর হানাদার পাক বাহিনী নৃশংস পাশবিকতায় বাঙালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ২৫ মার্চের কালো রাতে। সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ৯৬টি ট্রাকবোঝাই সৈন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে ঢুকল। তাদের সঙ্গে ছিল অটোমেটিক রাইফেল, মর্টার ফিল্ডগান, মেশিনগান, লাইট মেশিনগান, বাজুকা ইত্যাদি সব মারণাস্ত্র। সঙ্গে ট্যাঙ্কবহর।

তখনও বারোটা বাজেনি, হানাদার নরপশুরা ট্যাঙ্ক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো। এমনকি মেয়েদের রোকেয়া হলও নিস্তার পেল না। রাস্তায় রাস্তায় জমে উঠল লাশের স্তুপ। কিন্তু এর মধ্যেও জনগণ থামল না। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল পাল্টা প্রতিরোধে। কিন্তু বর্বর হানাদাররা এক ২৫ মার্চের রাতেই লক্ষাধিক
বাঙালীকে হত্যা করে।

এসময় ২৬মার্চ মধ্যরাতে মেজর জিয়াউর রহমান নিজেকে বাংলাদেশের প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট এবং লিবারেশন আমির্র কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে ঘোষনা করে বেতারে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘোষনা দেয়ার আগে তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং সেনাবাহিনীর অফিসার জেসিও ও জওয়ানদের একত্রিত করে তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। সাথে সাথে তা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদেরকে জানানো হয়।

এ ঘোষনাটি সেই সময় বাংলাদেশের সবার ভেতরে নতুন একটি অনুপ্রেরনা সৃষ্টি করেছিল। বাঙ্গালী যোদ্ধাদের হাত থেকে চট্টগ্রাম শহরকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এপ্রিল মাসের ১০ এপ্রিল হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুষ্টিয়া এবং পাবনা শহর প্রথমে দখল করে নিলেও বাঙ্গালী সৈন্যরা তাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে শহরগুলো পূর্ণদখল করে এপ্রিলের মাঝামাঝি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখে। বগুড়া দিনাজপুরেও একই ঘটনা ঘটে-বাঙ্গালী সৈন্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে শহরগুলোকে পুনর্দখল করে নেয়। যশোরে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করার সময় তারা বিদ্রোহ করে। প্রায় অর্ধেক সৈন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারালেও বাকিরা ক্যান্টমেন্ট থেকে মুক্ত হয়ে আসতে পারে। কুমিল্লা, খুলনা ও সিলেট পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের দখলে রাখলেও বাঙ্গালী সৈন্যরা তাদের আক্রমন করে ব্যতিক্রম করে রাখে।

পাক বাহিনী এই সময়ে পাকিস্তান থেকে দুইটি ডিভিশনে বাংলাদেশে নিয়ে অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে আসে। তার সাথে সাথে যুদ্ধজাহাজে করে অস্ত্র আর গোলা-বারুদ। বিশদ অস্ত্র ভান্ডার এবং বিমানবাহিনীর সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে ছাড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা মে মাসের মাঝামাঝি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বড় শহর নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে পারে।
পাকিস্তান সরকার ১১ এপ্রিল টিক্কা খানের পরিবর্তে জেনারেল এ· ·কে নিয়াজীকে সশস্ত্রবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় প্রস্ততি নিতে শুরু করেছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনে নিউজ উইকের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী শরনার্থীকে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যে মানুষটি এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। এই সনদটি দিয়েই বাংলাদেশ নৈতিক এবং আইনগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্বপ্রকাশ করেছিল। এই নতুন রাষ্টে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে (মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা) বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

যুদ্ধের প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনী ছিল পরিকল্পনাহীন এবং অপ্রস্তুত। আস্তে আস্তে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন-চীফের দায়িত্ব দয়ো হয় কর্ণেল (অবঃ) এম আতাউস গনি ওসমানীকে। পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই এগারোটি সেক্টর ছাড়াও জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ এবং শফিউল্লাহর নেতৃত্বে জেড ফোর্স,কে ফোর্স এবং এস ফোর্স নামে বিগ্রেড তৈরী করা হয়। এছাড়াও টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি আঞ্চলিক ভিত্তিক বাহিনী ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকৃত যোদ্ধাদের মতই রেখেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। তবে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানের কথা না বললে ইতিহাসটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাদের সাহায্য সহযোগীতার জন্যই মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে নিরপদ আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করতে পেরেছেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা পৃথিবীতে প্রচার হওয়ার পর পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই সমবেদনা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। তবে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোবপসাগরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে শেষ মূহূর্তে যখন বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর জয় একেবারে সুনিশ্চিত তখন সেই বিজয়ের মূহুর্তটিকে থামিয়ে দেবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে এ প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে আমাদের বিজয়ের পথ সুনিশ্চিত করেছিল।

জুলাই মাসের দিকে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে অক্টোবর মাসের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে দেখতে শাক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেছিল। তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত আউটপোটগুলো নিয়মিত ভাবে আক্রমন করে দখল করে নিতে শুরু করে। গেরিলাবাহিনীর আক্রমন ও তীব্র হতে থাকে। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মানোবল ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখতে দেখতে এত খারাপ হয়ে গেল যে, পাকিস্তান তার সমাধান খুঁজে না পেয়ে ডিসেম্বরের তিন তারিখ ভারত আক্রমন করে বসে। তখন পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ আক্রমন করে ভারতের বিমান বাহিনীকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেয়া। কিন্তু তারা সেটি করতে সক্ষম হয়নি। ভারত সাথে সাথে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের ভিতর তখন পাকিস্তানের পাঁচটি পদাতিক ডিভিশন। ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হবার পর সেটি চলেছে মাত্র তেরদিন। যুদ্ধ শুরু হবার পর পাকিস্তানের একটি একটি করে ঘাঁটির পতন হতে থাকলো।

মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী তাদেরকে পাশ কাটিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততর গতিতে ঢাকার কাছাকাছি এসে হাজির হয়ে যায়। তারা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পন করার জন্য আহ্বান জানান। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল চায়টায় রেডকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী আত্বসমর্পন দলিলে সক্ষর করেন।

পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পন করার পর ৭ কোটি বাঙালী বিজয়ের অবিশ্বাস্য আনন্দে মেতে ওঠলো। যে বিজয়ের জন্য বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা সুদীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষা করেছিল। এই বিজয়ের জন্যই মুক্তিযোদ্ধোদের নিকট আমরা সত্যিই ঋণী। তবে তাদের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ হয়েছে তাদেরকে বিভিন্ন বীরত্বসূচক পদক দিয়ে সম্মানিত করে।

বিজয়ের আনন্দ এবং ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেশের মানুষের ভেতর ভবিষ্যত নিয়ে যে স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল, বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য সেটি পূরন করা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে ওঠতে থাকে। যারা সরকার চালানের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের কারো সরকার চালানোর তেমন অভিজ্ঞতা নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধের শেষ মূহুর্তে রাস্তাঘাট, কল কারখানা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি দূরত্ব তৈরী হয়ে গেল। শুধু দেশের ভেতরেই নয় দেশের বাইরেও ষড়যন্ত্র শুরু হলো, দেশে যখান খাদ্যের ঘাটতি তখন চাল বোঝাই জাহাজ হঠাৎ করে বাংলাদেশে না এসে অন্যদিকে চলে গেল। ১৯৭৪ সালে দেশে দেখা দিল দূর্ভিক্ষ। রাজনৈতিক বিশৃংঙ্খলা দূর করার নামে বিরোধী দলীয় কর্মীদের রক্ষীবাহিনী নির্যাতন করতে শুরু করলো। সব মিলিয়ে দেশে যখন একটি অরাজক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগ সরকার তখন ‘বাকশাল’ তৈরী করে একদলীয় শাসন চালূ করার চেষ্টা করল। চারদিকে দেখা দিল অসন্তোষ, ক্ষোভ। দেশের এরকম দুঃসময়ের একটি সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। পতন ঘটে একদলীয় বাকশাল সরকারের। তবে সেই সময় ‘বাকশাল’ পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তিও রয়েছে।


ক্ষমতার মঞ্চের পরিবর্তন পেক্ষাপটে খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু শাসন ক্ষমতা নিয়ে গোপনে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। অবশেষে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। মূলতঃ এই বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতাশূন্যতা পূরন করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতার আসার পর থেকে দেশে ধীরে ধীরে স্থিতাবস্থা বিরাজ করতে শুরু করে। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সেনা অভূত্থানে নিহত হন। এরপর স্বৈরাচারী জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগন শাসিত হতে থাকে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ গনতন্ত্রের পথে ফিরে আসে। সেই থেকে বাংলাদেশ আবার একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাড়ানোর চেষ্টা করছে।

স্বাধীনতার পর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হতাশাপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। বাংলাদেশ আজ মাথায় অনেক সাফল্যের মুকুট পরে ওঠে দাঁড়িয়েছে। উর্বর পলিবাহিত মৃত্তিকার উপরিভাগে সবুজের সমারোহ, নীচে তার অফুরন্তô খনিজ সম্পদ, আর আকাশ সীমায় বিপুল রূপালী মেঘের পাল - যা সারা বছর অন্তরীক্ষে ভূ-গহ্বরে প্রকৃতির সকল উৎস এ দেশকে দান করার জন্য উন্মুখ।

রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে গিয়ে এবং দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিতে পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে আসবে একের পর এক সাফল্য আর সাফল্য, আমরা পাবো স্বপ্নের স্বাধীন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, পাবো ইতিবাচক এক বাংলাদেশ।