Monday, October 22, 2012

বিকল্পের সংকটই দেশের বড় সংকট


বিকল্পের সংকটই দেশের বড় সংকট

লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম  |  সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১২, ৭ কার্তিক ১৪১৯
দেশবাসী আজ বহুমুখী সমস্যা-সংকটের সম্মুখীন। এক কথায়, দেশে বিরাজ করছে সংকটের পাহাড়। এসব পর্বত পরিমাণ সংকটের ওপর আরো অতিরিক্ত যে সংকটটি দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা হল- এই অব্যাহত সংকট থেকে মুক্তির দিশা দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে না। অর্থাত্ সবচেয়ে বড় সংকটটি হলো সংকট নিরসনের সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ার সংকট। অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর নিশানা খুবই ক্ষীণ।
জীবন যন্ত্রণায় কাতর দেশের শ্রমজীবী মানুষসহ জনগণের মনে তাই বাসা বেঁধেছে গভীর হতাশা। এই হতাশা ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তা এখনো স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিত। প্রগতি ও গণতন্ত্রের শক্তি এখনও তাকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সংগঠিত করে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির আকার দিতে সক্ষম হয়নি। তাই এই হতাশা ও স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভকে বহুলাংশে কাজে লাগাতে পারছে দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ফলে দেশ সমস্যা-সংকটের আবর্তে অব্যাহতভাবে বন্দী হয়ে থাকছে। আরো বিপজ্জনক দুর্যোগের দিকে চলে যাবার আশঙ্কাও আজ সৃষ্টি হয়ে আছে।
দশকের পর দশক ধরে যাদের নেতৃত্বে ও যেভাবে দেশ চলছে, তাতে দেশবাসী আজ দিশাহারা। এক কথায়, মানুষ প্রায় সবকিছুর ওপর, যাকে বলে একেবারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে তারা মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির দিশা ও শক্তির পর্যাপ্ত দৃশ্যমান উপস্থিতি এখনো সেভাবে তাদের চোখে পড়ছে না। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দৃশ্যপটে, অন্যান্য সব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি, এটিই হলো প্রধান চ্যালেঞ্জ।
আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে দ্রব্যমূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। জিনিসপত্রের দাম কমার বদলে তা হু হু করে কয়েকগুণ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য আজ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন। এসব ক্ষেত্রে সরকার চাহিদা-সরবরাহ, আন্তর্জাতিক বাজার দর ও বাজার অর্থনীতির দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু সরকার তার প্রতিশ্রুতি মতো রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেনি। শক্তিশালী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। বরঞ্চ নিজেই সে ছয় বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। পেট্রোল, ডিজেল, পানি, গ্যাস ইত্যাদির দাম বাড়িয়েছে। অথচ গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের আয় বাড়েনি বললেই চলে। অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষকে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। লুটপাট চালিয়ে সম্পদের পাহাড় বানানো হচ্ছে। সরকারের উঁচু মহলের যোগসাজশে এসব করা হচ্ছে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, যুবক ও ডেসটিনির বাটপাড়ি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ভূমিদস্যুতা, চোরাকারবারির রমরমা ব্যবসা, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি কয়েকটি বড় বড় কেলেঙ্কারির খবর থেকেই লুটপাটের ব্যাপ্তি ও মাত্রা অনুমান করা যায়। অর্থমন্ত্রীর নিজের কথা অনুসারেই দৃশ্যমান অর্থনীতির মোট পরিমাণের তিন-চতুর্থাংশই হলো তার বাইরে থাকা চোরাই কালো অর্থনীতি। অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন কালো টাকার মালিক লুটেরা ধনীকদের হাতে। একদিকে দারিদ্র্যের সাগর ও অন্যদিকে অল্প কিছু মানুষের হাতে কল্পনাতীত বিত্ত-ভৈবব। দেশে এখন পৃথক দুই অর্থনীতি, দুই সমাজ, দুই দেশ তৈরি হয়ে গেছে। এসবের প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে তারল্য সংকট, বিনিয়োগ সমস্যা, সুদের হারের অস্থিরতাসহ নানা রকমের অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে বড় বড় লুটপাটের ঘটনার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যন্ত ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি, তদবিরবাজি, বেপরোয়া দখলদারিত্ব, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, জবরদস্তি ইত্যাদির বিস্তার ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বেড়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। এসবকে ভিত্তি করে ছড়িয়ে পড়েছে হত্যা, খুন, কিডন্যাপিং, নারী-নির্যাতন, সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী লালন, গডফাদারদের দৌরাত্ম্য, প্রভাব বিস্তার নিয়ে হানাহানিসহ অপরাধমূলক নানা কাজকর্ম। একই সাথে অব্যাহত আছে ক্রসফায়ার-হত্যা-গুমের লোমহর্ষক সব ঘটনা। মানুষের জীবনে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে আজ আর কিছু নেই। বেডরুম থেকে খোলা মাঠ, কোথাও মানুষ আজ নিরাপদ নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানাহানি, নৈরাজ্যের ঘটনা বাড়ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা— সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করার মাধ্যমে সমাজের বাণিজ্যিকীকরণকে সর্বগ্রাসী করে তোলা হচ্ছে। পুঁজিবাদী লুটপাটের প্রয়োজনে পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণী-উদ্ভিদ জগত্— সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। নগদ লাভের লোভে বিনষ্ট করা হচ্ছে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের অস্তিত্ব।
গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত দুর্বল ও খর্ব করা হচ্ছে, শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করে রাখা হয়েছে। তাদের সংগ্রামকে দমন করার জন্য গঠন করা হয়েছে শিল্প-পুলিশ। ঢাকা শহর ও অন্যান্য শহরে জনসভা করার জায়গা কেড়ে নেয়া হয়েছে। মিটিং-মিছিলে চালানো হচ্ছে বর্বর আক্রমণ। ওয়ান-ইলেভেনের এজেন্ডা শেষ হয়নি বলে বারবার বলা হচ্ছে। গণতন্ত্র আজ খর্বিত ও আক্রান্ত। সংবিধানকে এখনো মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনা হয়নি। দুঃখের বিষয়, অনেক ক্ষেত্রেই এদেশে এখনও মোশতাক, জিয়া, এরশাদের ব্যবস্থা ও ধারা বহাল রাখা হয়েছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আজ দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শ্রেণীচরিত্র বদলে গেছে। এক সময় সেখানে প্রাধান্য ছিল মধ্যবিত্তের। আওয়ামী নেতৃত্ব এখন লুটেরা ধনিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে।
বাজার অর্থনীতি জন্ম দিয়েছে বাজার রাজনীতির। বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের খড়্গের নিচে পড়ে রাজনীতি হয়ে পড়েছে রুগ্ন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লুটেরাদের মদদে ‘হালুয়া-রুটির অপরাজনীতির’ দাপট ‘আদর্শের রাজনীতিকে’ কোণঠাসা করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এ দু’টি বুর্জোয়া দলকে কেন্দ্র করে যে দু’টি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলা হয়েছে তারা ‘হালুয়া-রুটির অপরাজনীতির’ এই অসুস্থ ধারাকে লালন করছে। এই দুই দলের মদদে রুগ্ন রাজনীতি আজ একচ্ছত্র প্রধান ধারায় পরিণত হয়েছে। দ্বিদলীয় মেরুকরণ ভিত্তিক যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশকে বেঁধে ফেলা হয়েছে তা বহুলাংশেই দেশি-বিদেশি শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফসল। পর্দার পেছন থেকে দেশি-বিদেশি শক্তি রিমোট কন্ট্রোলে দেশ চালায়। তারা এমন একটি ‘সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে যাতে সবসময় সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আমাদের দেশের ওপর সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ আরো বেড়েছে। নানা অজুহাতে দেশের মাটিতে স্পেশাল ফোর্স, মেরিন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এমনভাবে সর্বক্ষণ আসা-যাওয়া করছে যাতে করে এখানে তারা তাদের এক ধরনের স্থায়ী উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিয়েছে। হানা, সোফা ইত্যাদি নানা গোপন চুক্তিতে তারা বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলেছে। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আনাগোনা করছে। মার্কিন নৌ-বাহিনীর স্থায়ী উপস্থিতির সুযোগের জন্য তারা চাপ বাড়াচ্ছে। তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেয়াসহ অর্থনৈতিকভাবে এদেশকে শোষণের শিকলে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলার জন্য তারা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করাসহ নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ আছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও একই বিষয়ে, অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতির অভিযোগ আছে। কিন্তু দুর্নীতির কথা তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রথমে বন্ধ করে দিয়ে পরে আবার তা চালু করা হবে বলে ঘোষণা দিয়ে এখন নতুন-নতুন প্রবল প্রতিকূল ও অমর্যাদাকর শর্ত আরোপ করতে শুরু করেছে। পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্ঘাতি তত্পরতা শেষ হয় নেই। ভারতের সাথে তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে হত্যা, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময়, তিন বিঘা হস্তান্তর, বাণিজ্য বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ তার ষড়যন্ত্রকে জোরদার করতে সক্ষম হচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদ এখন এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে তার তত্পরতার প্রধান ক্ষেত্র বানিয়েছে। বিদেশে মোতায়েন তার নৌ সেনার ৬০ শতাংশ এই অঞ্চলে রাখার কথা সে ঘোষণা করেছে। ‘গণচীনকে ঠেকাও’-এর স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সে চীনকে ঘেরাওয়ের মধ্যে রাখার কৌশল নিয়েছে। ভারতকে সেই স্ট্র্যাটেজিতে শামিল করতে পারা সত্ত্বেও ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কিছু স্বার্থের ফারাকও আছে। এই অবস্থায়, প্রয়োজনমতো বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতের ‘হাত মোচড়ানো’র দ্বারা তাকে ষোল আনা পদানত করছে সাম্রাজ্যবাদ। শুধু পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেই নয়, সাম্রাজ্যবাদ আজ বিশ্ব মানবতার প্রধান দুশমন হিসেবে বিরাজ করছে। ‘সীমিত সার্বভৌমত্ব’, ‘আগাম আক্রমণ’, ‘একতরফাবাদ’, ‘রেজিম চেইঞ্জ’ ইত্যাদি নব্য-উপনিবেশবাদী নানা তত্ত্ব হাজির করে সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তার যাবতীয় আগ্রাসী অপতত্পরতা চালাচ্ছে।
৩০ লাখ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ— এই চার মূলনীতির ধারায় দেশকে পরিচালিত করার যে স্বপ্ন সেদিন তারা দেখেছিল, তা বহুলাংশেই আজ ছিনতাই হয়ে গেছে। শোষণ, দারিদ্র্য, বৈষম্য, অন্যায়-অনাচারে দেশ আজ ডুবতে বসেছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও আজ সাম্রাজ্যবাদের কাছে কার্যতঃ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। দেশের এই পরিণতির জন্য দায়ী হল দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন এবং দীর্ঘতর সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দু’টি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বে পরিচালিত নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের শাসন। যে সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর লুটেরা ধনবাদী পথে তারা দেশ শাসন করেছে ও করছে, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো এসব সমস্যা-সংকটের ক্রমবর্ধমান বোঝা। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে অনেক ক্ষেত্রে পরিত্যাগ করেছে। বিএনপি’র রাজনীতি শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ধারার মূলনীতিসমূহ—তথা ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নীতির বাইরে ছিল ও আছে।
দেশের মানুষ নিত্যদিন নিদারুণ দুর্যোগ ভোগ করছে। এখন তাদের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে তারা আজ পরিত্রাণ চায়। এজন্য প্রয়োজন লুটেরা ধনীকমুখী পুঁজিবাদী ধারা পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায়, তথা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে গরিব, মেহনতি ও নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করা। সেই স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নীতি আমূল ঢেলে সাজানো উচিত। অন্যদিকে প্রয়োজন বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির পর্যায়ক্রমিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে বামপন্থি-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা। একথাও মনে রাখা অত্যাবশ্যক যে, দেশের বর্তমান সংকটজাল ছিন্ন করতে হলে একই সাথে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রে আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন সংগঠিত করতে হবে। এজন্য একাধারে গড়ে তুলতে হবে শ্রেণী আন্দোলন ও গণআন্দোলনের নতুন জোয়ার। আওয়ামী লীগের হাতে দেশের শাসনভার অব্যাহত থাকলে দেশ ও জনগণ আরো গভীর সংকটে ডুবে যাবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি-জামায়াতের শাসনকে ফিরে আসতে দিলে অবস্থা হয়ে উঠবে আরো ভয়াবহ। তা হবে ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত চুলায় ঝাঁপ দেয়ার’ মতো ব্যাপার। দেশবাসী এখন আছে ‘আপদের’ মধ্যে। সামনে আছে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের ‘বিপদের’ আশঙ্কা। অন্যদিকে পর্দার অন্তরালে ওয়ান ইলেভেনের ‘মুসিবত’ ওত পেতে আছে। তাছাড়া এসব দুর্যোগের আশংকাকে ছাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে জামায়াত-শিবির-সাম্প্রদায়িক জঙ্গীবাদের ‘মহাবিপদ’। এসবের মাঝ দিয়েই এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে হবে জাতিকে। কাজটি সহজসাধ্য নয় একারণে যে, এখনই হাতের কাছে সত্, দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বামপন্থিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব দেখতে পওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এটির প্রয়োজন খুবই জরুরি। বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প গড়ে তোলার কাজটি কঠিন হলেও তা অসম্ভব নয়। তার কারণ হলো এই যে, এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তির জোরদার দৃশ্যমান উপস্থিতি সেভাবে চোখের সামনে দেখতে না পাওয়া গেলেও, তার উপাদানগুলো দেশে বিদ্যমান আছে। তবে সেগুলো এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বিকল্পের সব সম্ভাব্য উপাদান ও শক্তিগুলোকে একত্রিত করতে পারলে তা সহজেই দৃশ্যমান হবে। অন্যদিকে জনগণ শক্তিশালী বিকল্পের জন্য অধীর হয়ে আছে। তাই, যা এক্ষেত্রে প্রয়োজন তাহল বিকল্পের সম্ভাব্য শক্তির মধ্যে একাগ্রতা ও একতা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তারা যদি অবিলম্বে এ কাজে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে না আসে তাহলে তারাও ইতিহাসের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা
লেখক: ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ  |  সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১২, ৭ কার্তিক ১৪১৯
পৃথিবী এগুচ্ছে দ্রুত প্রগতির স্বাভাবিক নিয়মে। আর ইতিহাস মূর্খতার সুযোগে ধর্ম আর রাজনৈতিক বণিকদের শ্রেণীস্বার্থ সুপ্রতিষ্ঠার জন্য জঙ্গীবাদের অন্ধকার চেপে ধরতে চাইছে। আমাদের প্রগতির চাকা বিকল করে অধোগতির চাকা জুড়ে দিয়ে দেশটাকে ঠেলে দিচ্ছে পেছনে। এদেশে জঙ্গীবাদের বাস্তবতা, স্বরূপ অনুধাবন ও সংকট শনাক্ত করার ব্যাপারে বড় দু’দল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ঘর্মাক্ত হচ্ছে। বিএনপি নামের দলটি সময়ের সুবিধায় বলা যায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংকট ও নানা ব্যর্থতার সুযোগে অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতান্ধ হয়ে এই শক্তির সম্পদ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে নিজেদের ঋদ্ধ করলো না। বরঞ্চ মৌলবাদী দলগুলোর সাথে সখ্যতা তৈরি করে নিজেদের জাত চেনাতে থাকলো। দলটিকে ভালোবেসে যে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন রেখেছিল তাদের অনুমোদনের প্রয়োজন মনে করলো না। রাজনৈতিক মেধাহীনতা ও স্বার্থবাদের কাছে দেশপ্রেম যখন পরাজিত হয় তখন রাজনীতি পরিচালকদের কাছে সুস্থ চিন্তা আশা করা যায় না।
আওয়ামী লীগের ছকেও কি কোনো পরিবর্তন হলো? মুক্তিযুদ্ধ-স্নাত এদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের তো আওয়ামী লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বন্ধুত্বে নিজেদের জড়িয়ে অমন কোনো দলে চলে যাওয়ার কথা নয়। তবুও অনেকে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু অতীত ভুল স্বীকার করে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে আওয়ামী লীগের আধুনিক রাজনীতিকরা কি জনগণের রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। এসব কারণে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে রাজনৈতিক ঝগড়াটি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী অপশক্তি। মৌলবাদী শক্তিগুলোর বড় সুবিধা উজ্জ্বল অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস প্রজন্মের চোখ থেকে আড়াল করে রাখা। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে যুক্তি আর মানবতার সৌন্দর্য দেখার অন্তর্চোখ অন্ধ করে দেয়া। এভাবে কোমলমতি ছেলেমেয়েগুলোকে জঙ্গী বানানো হচ্ছে অসামপ্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজ্বাধারীদের ক্রমাগত ব্যর্থতার ফলে।
রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রকৃত সত্য আড়াল করতে চায় সকলেই। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চায় জঙ্গীবাদ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বিএনপি আমলে। আর তারা এই অপশক্তির প্রায় মূলোত্পাটন করেছে। বিএনপির দাবি- বড় বড় জঙ্গীদের ধরে তারাই শাস্তি দিয়েছে। দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা দাবি করেন- দেশে এখন আর জঙ্গী তত্পরতা নেই। কিন্তু জামায়াতী তত্পরতায়, কট্টর ধর্মীয় দলগুলোর সক্রিয়তায়, হিজবুল তাহেরির মাঝে-মাঝে সরব আত্মপ্রকাশে বিশ্বাস করার সুযোগ রাখে না যে এদেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্বাসিত হয়েছে। প্রায়ই শোনা যায় শুধু কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নয়, মগজ ধোলাই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদেরও। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের জঙ্গীবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ার কথা প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতি সমপ্রতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী ছাত্র নাফিসের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা নিয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নাফিস এদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। বাবা সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। এখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অভিযোগ- যুক্তরাষ্ট্রে আসার ছ’মাসের মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে আসে নাফিস। অবশেষে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে তারা নাফিসকে গ্রেফতার করেছে। এতে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নাফিসের পরিবার ছেলেকে নির্দোষ দাবি করেছে এবং বলেছে নাফিসকে কোনো পক্ষ ফাঁসিয়েছে। নাফিসের আমেরিকান সহপাঠি ও পরিচিতদের কেউ কেউ নাফিস সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কথা বলেছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে আইনগতভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করার। আমরাও আশা করবো নাফিস নির্দোষ প্রমাণে মুক্তি পাক। এতে নাফিস, তার পরিবার ও রাষ্ট্র দায়মুক্ত হবে। তবে আমার আশংকা অন্যখানে।
জঙ্গী তত্পরতা, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের পক্ষ থেকে ঝটিকা মিছিল, চোরা-গোপ্তা হামলায় আজকাল প্রায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়।  এটি ভাববার বিষয়। তারুণ্যকে সবসময় মুক্ত চিন্তার দেশপ্রেমিক ভাবতে ভালো লাগে। কিছু সংখ্যক ধর্ম-রাজনৈতিক বণিক কেমন করে এদের মগজ ধোলাই করে ফেলে তা এক বিস্ময়। আমার বার বার মনে হয়েছে ইসলামের স্বরূপ ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এদের সামনে আমরা তেমনভাবে তুলে ধরতে পারিনি বলে অপশক্তি এদের গ্রাস করেছে।
বর্তমান সময়ে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের কাছেই ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। মুসলমানদের উগ্র জঙ্গীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করছে। কোথাও বোমা হামলায় জীবন ও সম্পদহানি হলে সকলের সন্দেহের চোখ পড়ে ইসলামী জঙ্গীদের ওপর। এভাবে ইসলামের অপার সৌন্দর্য, মানবতাবাদী দর্শন ও শান্তির ধর্ম হিসেবে এর পরিচিতি চরম লাঞ্ছিত হচ্ছে ধর্ম-বণিক, জ্ঞানপাপী আর ধর্ম-মূর্খ মানুষগুলোর হাতে। এই বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের দিকেই যদি চোখ ফেরাই কী ছবি ভেসে উঠবে? তেরো শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত এদেশ ছিল বৌদ্ধ আর হিন্দু রাজাদের অধীন। এগারো শতক থেকে সীমিতভাবে দেশের নানা অংশে মুসলমান সুফী সাধকরা আসতে থাকেন। ইসলামের সাম্যের বাণী ও মানবপ্রেমের কথা প্রচার করতে থাকেন তাঁরা। অমন মানবতাবাদী ধর্মের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় এদেশবাসীর। এর আগে আট শতকে শুধু চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্র তীরাঞ্চলে আরব বণিকদের সংস্পর্শে মানুষ ইসলাম সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা ব্রাহ্মণ সেনরা পাল রাজাদের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে এসে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় হয়ে যায়। পালদের দুর্বলতার সুযোগে এরা বাংলার সিংহাসন দখল করে নেয় এগারো শতকের মাঝামাঝি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মানসিক অস্বস্তিতে পড়ে সেন শাসকরা। বাংলার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। হয়ত সে খবর রেখেছে তারা। তাই এদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল এদেশের মানুষ যাতে জেগে না ওঠে। এ কারণে কঠোরভাবে বর্ণ বিভাজন প্রয়োগ করে। একই ধর্ম ও সমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও বাংলার সাধারণ মানুষকে শূদ্র বর্ণভুক্ত করে দেয়। আর সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি আরোপ করে শূদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদের নির্বাক করে দিতে চায়। ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত করে কোণঠাসা করে ফেলতে চায়। ধর্মীয় অনুশাসনকে বিকৃতভাবে প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় শূদ্র-হিন্দু হবে ব্রাহ্মণের সেবাদাস। সংস্কৃত শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ শূদ্রের জন্য। তারা শুধু ব্রাহ্মণের দেয়া বিধান মেনে চলবে। কারণ শাসক ব্রাহ্মণ জানে প্রকৃত ধর্ম তাদের আরোপিত অমানবিক বিধান সমর্থন করে না। তাই ধর্মচর্চা করতে দেয়া হবে না শূদ্রকে। মানুষকে অন্ধকারে রাখতে পারলেই ধর্মপ্রবণ মানুষকে মনগড়া ব্যাখ্যায় আচ্ছন্ন করা যাবে। কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ আসবে না। বরং ধর্মান্ধ মানুষকে দিয়ে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়া সহজ হবে।
এ যুগের ধর্ম-বণিকরা এসব সত্য বুঝতে না চাইলেও যেসব সুফী সাধক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হাজার বছর আগে ইসলামের মানবিক আবেদন ছড়িয়ে দিয়ে বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিকাশের পথ তৈরি করেছিলেন, তাঁদের নবীর আদর্শ বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। যাঁরা প্রথম মাদ্রাসা তৈরি করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিলেন তাঁরা তাঁদের উদারতা ও অসামপ্রদায়িক মনোভঙ্গি দিয়ে প্রকৃত অর্থেই আলোকিত করতে পেরেছিলেন চারপাশ। চৌদ্দ শতকে সোনারগাঁওয়ে মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন দিল্ল­ী থেকে আসা প্রখ্যাত সাধক শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। এই বিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদ তাঁর মাদ্রাসায় কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি গণিত, আইন, চিকিত্সাবিদ্যা ইত্যাদি জাগতিক বিষয় অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই মাদ্রাসায় একসময় শিক্ষকতা করেন সে যুগের বিশিষ্ট পণ্ডিত সমরখন্দ থেকে আসা বহু ভাষাবিদ কাজী রুকনউদ্দিন আল সমরখন্দী। তিনি একবার জানতে পারেন আসামে একজন ব্রাহ্মণের কাছে ‘অমৃতকুণ্ড’ নামে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হিন্দু যোগশাস্ত্রের মূল্যবান গ্রন্থ আছে। জ্ঞান অন্বেষী রুকনউদ্দিন ‘অমৃতকুণ্ড’ পড়ার জন্য সংস্কৃত শিখলেন। এই জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক গ্রন্থটি পড়ে এতই আলোড়িত হয়েছিলেন যে আরবি ও ফারসি ভাষায় অমৃতকুণ্ডের অনুবাদ করেন। শুধু তাই নয়, অমৃতকুণ্ড সোনারগাঁও মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে নবীর অনুসারী এ সকল পণ্ডিত শুধু ইসলামী জ্ঞানের ভেতর জ্ঞানচর্চাকে আটকে রাখেননি।
মধ্যযুগে বাংলায় আসা সুফী সাধকরা তাঁদের কপর্দকটুকু বিলিয়ে দিতেন মানবকল্যাণে। তাঁরা যেখানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করতেন তাতে অনেক কিছুর আয়োজন থাকত। থাকত নিরন্ন মানুষের জন্য লঙ্গরখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা আর চিকিত্সালয়। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল অবারিত। সেন রাজাদের হাতে অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বিপন্ন শূদ্র হিন্দুদের কাছে ছিল এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। ধর্মের এই মানবিক আচরণ তাদের জীবনের আশ্বাসবাণী শোনায়। তাই সুফী সাধকরা সহজেই ধর্মান্তরকরণে সফল হয়েছিলেন। অথচ আজ ধর্মান্ধদের উন্মত্ততার পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের কাছে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পৌঁছে। তাই আজ আমেরিকার গোয়েন্দারা নেতিবাচক পথেই সমস্যার মোকাবেলা করতে চাইছে। যেখানে ভুল পথে হেঁটে জঙ্গীবাদের দিকে ঝোঁকা একজন শিক্ষার্থীকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সুপথে আনবে সেখানে ফাঁদ তৈরি করে নষ্ট পথে হাঁটার দিকে প্রলুব্ধ করছে। এভাবে আধা-জঙ্গী মানসিকতার একজন তরুণকে পুরো জঙ্গী বানাতে কিছুমাত্র দ্বিধা করছে না। নাফিস সম্পর্কে গণমাধ্যমে আসা রিপোর্টগুলো থেকে অমন ধারণাই তৈরি হতে পারে।  আমরা মনে করি ইসলামের প্রকৃত মানবিক শিক্ষা, জেহাদ সম্পর্কে ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা আর বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফীদের অহিংস প্রেমবাণীর সাফল্যের ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা খুবই জরুরি। প্রজন্ম যত ইতিহাস বিচ্ছিন্ন থাকবে অন্ধকারের অপশক্তি ততটাই গ্রাস করবে।
[ লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ]

Sunday, October 21, 2012

আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে


আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা কোন পর্যায়ে

লেখক: মো. আবদুল লতিফ মন্ডল  |  রবিবার, ২১ অক্টোবর ২০১২, ৬ কার্তিক ১৪১৯
গত ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক জোসি গ্রাজিয়ানো দ্য সিল্ভা বলেছেন, সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং এজন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন। তিনি আরও বলেছেন, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কোনো একক দেশের পক্ষে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এর আগে এফএও-এর ৯ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১২ সময়কালে বিশ্বে ৮৬ কোটি  ৮০ লাখ মানুষ অর্থাত্ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ খাদ্যাভাবে ভুগেছে। অর্থাত্ বিশ্বের প্রতি ৮ জনে ১ জন মানুষ খাদ্যাভাবে আছে।
খাদ্য নিরাপত্তার সংজ্ঞানুযায়ী তখনই খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান যখন সবার কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ এবং পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে। ১৯৯৬ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে যোগদানরত স্ব স্ব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য প্রাপ্তিকে প্রত্যেক মানুষের অধিকার হিসেবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমাদের জাতীয় খাদ্যনীতিতে (২০০৬) খাদ্যনিরাপত্তায় চিহ্নিত তিনটি নিয়ামক হলো----খাদ্যের লভ্যতা (availability of food), খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষমতা (access to food) এবং খাদ্যের জৈবিক ব্যবহার (utilization of food). সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা প্রশ্নে সব কয়টি নিয়ামক গুরুত্বপূর্ণ এবং এদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পারস্পরিক নির্ভরতা বিদ্যমান থাকায় খাদ্যনিরাপত্তা-সম্পর্কিত সব বিষয়ের মধ্যে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।
এখন দেখা যাক, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা কোন পর্যায়ে। সার্বিক খাদ্যকে মোটামুটি ১১টি শ্রেণীতে ভাগ করা হলেও জীবন ধারণও সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যশস্য (চাল, গম), শাকসবজি, ডাল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দরকারি খাদ্যশস্য চাল। কারণ আমাদের খাদ্যশস্যের চাহিদার কমবেশি ৯৩ শতাংশ পূরণ করে চাল। ক্যালরির ৭৫ শতাংশ আসে চাল থেকে। এটি সত্য, স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও চালের উত্পাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০১১-১২ অর্থবছর দেশে চালের উত্পাদন ৩ কোটি ৩৮ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। এ থেকে সিড, ফিড ও অপচয় বাদ দিয়ে মানুষের খাবার প্রয়োজন মিটিয়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে।
 তবে খাদ্যশস্য হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে থাকা গমের (খাদ্যশস্যের চাহিদার কমবেশি ৭ শতাংশ পূরণ করে) উত্পাদন প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ। বছরে ৩০ লাখ টনের বেশি গম আমদানি করতে হচ্ছে। বিজ্ঞজনরা বলছেন, চালের তুলনায় গমজাতীয় খাদ্যের দাম কিছুটা কম হওয়ায় এবং মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসায় গমের চাহিদা ক্রমশ বেড়ে যাবে।
এখন দেখা যাক আমাদের আমিষ জাতীয় খাদ্যপণ্যের উত্পাদন অবস্থা। খাদ্যপণ্য মাছ-মাংস, ডিম, দুধ মানুষের আমিষের চাহিদা মেটায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটে গবেষণার ফলাফলের বরাত দিয়ে ১৯ মে একটি বাংলা দৈনিকের (বণিক বার্তা) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে দেশে মাংসের ঘাটতি হবে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন ও দুধের ঘাটতি হবে ১০ লাখ ৮ হাজার টন। এছাড়া মাছের ঘাটতি  ৫ লাখ ৪ হাজার টন এবং ডিমের ঘাটতি হবে ১০৯ কোটি ৯০ লাখ। এসব পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ঘাটতি আগামী তিন বছরে ক্রমান্বয়ে বাড়বে। ২০১৩ সালে মাংসের ঘাটতি হবে ১৭ লাখ ৮০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ২৩ লাখ ও ২৯ লাখ ৬০ হাজার টনে। ২০১৩ সালে ডিমের ঘাটতি হবে ১৪৬ কোটি ৩০ লাখ, যা পরের দুই বছরে গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৮৭ কোটি ২০ লাখ  এবং ২৩২ কোটি ৮০ লাখে। আগামী বছর দুধের ঘাটতি থাকবে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা হবে যথাক্রমে ২২ লাখ এবং ২৯ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০১৩ সালে মাছের ঘাটতি হবে ৬ লাখ ৩০ হাজার টন। পরের দুই বছরে তা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৭ লাখ ৬০ হাজার এবং ৮ লাখ ৫০ হাজার টন। বর্তমানে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা  পুরণ করা হচ্ছে। এছাড়া আমিষের আর একটি চমত্কার উত্স ডালের মোট চাহিদার কমবেশি ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশে প্রাণীজ খাদ্যের---যথা দুধ, মাংস এবং ডিমের চাহিদার তুলনায় উত্পাদনে ঘাটতি রয়েছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।
খাদ্যের লভ্যতা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার খাদ্য কেনার সামর্থ। বাংলাদেশের ষষ্ঠ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে দরিদ্র জনসংখ্যার হার ১৯৯১-৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে নেমে ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আবার একই সঙ্গে বলা হয়েছে, “ Poverty still remains at a very high level and the number of people living below poverty line remains almost the same as it was in 1991-92” অর্থাত্ দারিদ্রের হার এখনও অনেক বেশি এবং দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৯৯১-৯২ সালের পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৯১-৯২ সালে দেশে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটির ওপরে এবং এখন তা’ দাঁড়িয়েছে পৌনে পাঁচ কোটিতে। অর্থাত্ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তেমন কমছে না। না কমার কারণ মুলত দু’টি----এক. শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে এরা দারিদ্র্য চক্র হতে বের হয়ে আসতে পারছে না। ১৯৯১ সালের আদমশুমারির সাড়ে ১০ কোটির কিছুটা বেশি জনসংখ্যার সঙ্গে গত দু’দশকে প্রায় পাঁচ কোটি জনসংখ্যা যোগ হয়েছে। এদের বেশিরভাগ এসেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী থেকে। দুই. বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের আয়-বৈষম্য আর একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পভার্টি মনিটরিং সার্ভে রিপোর্ট-২০০৪ থেকে দেখা যায়, ১৯৯৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে খানা (household) প্রতি মাসিক আয় ছিল চার হাজার ৮১২ টাকা, তা ২০০৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় পাঁচ হাজার ৩০২ টাকা। শতকরা বৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গরীব খানার আয় ১৯৯৯-এর তুলনায় ২০০৪ সালে কমে যায়; অন্যদিকে ১৯৯৯ সালে ধনী খানার মাসিক আয় ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে যায়। বিবিএস-এর হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস)-২০০৫ থেকেও আমরা ধনী-গরীব খানার আয় বৃদ্ধি বৈষম্যের অনুরূপ চিত্র পাই। এইচআইইএস ২০১০ থেকে দেখা যায়, আয় কেন্দ্রীভূত হওয়া সামান্যই কমেছে। বলা হয়েছে, ‘The concentration of wealth has slightly decreased’। ‘কর্মক্ষম, স্বাস্থ্যকর ও উত্পাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য সবসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ এবং পুষ্টি মানসম্পন্ন খাদ্য’ সংগ্রহ করা এ বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা থেকে যাচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা বলয়ের বাইরে।
খাদ্যনিরাপত্তার তৃতীয় উপাদান পুষ্টি মানসম্পন্ন ও নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের নিচে অবস্থান করছে  বাংলাদেশ। নারী ও শিশুসহ দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টিসমস্যা প্রকটভাবে বিদ্যমান। এর কারণ আর্থিক ও খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহার। আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে আমিষ জাতীয় খাদ্য কেনা প্রায় সম্ভব হয় না। সুষম খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।  খাদ্যের ত্রুটিপূর্ণ জৈবিক ব্যবহারগুলো হলো---এক. পুরুষের তুলনায় নারী ও শিশুরা প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। ফলে তারা ভোগে অপুষ্টিতে। দুই. ত্রুটিপূর্ণ রন্ধন পদ্ধতির জন্য, বিশেষ করে শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যের উপাদান ত্রুটিপূর্ণভাবে কাটা, অতিরিক্ত ধোয়া এবং অত্যধিক তাপের কারণে এগুলোর পুষ্টিগুণ অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়।
খাদ্যনিরাপত্তার তিনটি নিয়ামক বিবেচনায় নিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তৈরি  ‘দ্য গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০১২’ বা বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা তালিকা-২০১২তে বিশ্বের ১০৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮১তম। তালিকা অনুযায়ী খাদ্যনিরাপত্তায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।
সবশেষে যা বলা প্রয়োজন তা হলো, এ মুহূর্তে প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও প্রয়োজনের তুলনায় আমিষ জাতীয় খাদ্যপণ্যের অভাব, এক বিরাট জনগোষ্ঠীর খাদ্য প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় ক্ষমতার অভাব, খাদ্যে পুষ্টিমানের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের জয়ী হতে হবে।
লেখক : সাবেক সচিব
E-mail:latifm43¦gmail.com

Saturday, October 20, 2012

পানি ও বাতাস থেকে পেট্রল - প্রথম আলো


পানি ও বাতাস থেকে পেট্রল

সারা বিশ্বের যখন পরিবেশ রক্ষায় ‘সবুজ জ্বালানি’র খোঁজে ব্যস্ত, জ্বালানিসংকট যখন কাবু করে ফেলছে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি; এ সময় যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক এমন এক জ্বালানি উদ্ভাবনের কথা দাবি করলেন, যা দারুণ এক সুখবর বটে। পানি ও বাতাস থেকে পেট্রল তৈরির দাবি করেছেন তাঁরা। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের প্রকৌশলীদের উদ্ভাবিত এই পেট্রল অদূর ভবিষ্যতে সবুজ জ্বালানির ব্যবহারে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে।
রয়টার্সের এক খবরে জানা যায়, উত্তর ইংল্যান্ডের টিসাইডে অবস্থিত এয়ার ফুয়েল সিনথেসিসের (এএফএস) প্রকৌশলীরা গত আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত বাতাস ও পানি থেকে প্রায় পাঁচ লিটারের মতো কৃত্রিম পেট্রল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দাবি, পানির হাইড্রোজেন ও বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে পাওয়া মিথানল প্রক্রিয়াজাত করে মূলত এই কৃত্রিম পেট্রল পাওয়া গেছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে এএফএসের প্রকৌশলীদের এই উদ্ভাবন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মাধ্যমে কার্বনমুক্ত পেট্রল তৈরি করার একটি পথ খুলে গেল। কার্বনমুক্ত পেট্রল সাধারণ পেট্রলের মতো কাজ করবে।
এক সাক্ষাত্কারে এএফএসের প্রধান নির্বাহী পিটার হ্যারিসন রয়টার্সকে বলেন, উদ্ভাবিত এই পেট্রল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিষ্কার। তিনি বলেন, এতে সালফার জাতীয় কোনো পদার্থের অস্তিত্ব নেই, সুতরাং এটি পরিবেশের দূষণ করবে না।
পানি ও বাতাস থেকে পেট্রল তৈরি করার এই প্রকল্পটি প্রায় দুই বছর ধরে চালিয়ে আসছে এএফএস। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
হ্যারিসনের দাবি, ‘এই মুহূর্তে সাধারণ পেট্রলের যে দাম, এর চেয়ে আমাদের উদ্ভাবিত পেট্রোলের দাম অনেক বেশি। আশা করছি, কোনো এক সময় সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত এই পেট্রল আমরা মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে পারব।’ ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ বলে তিনি মনে করেন।
হ্যারিসনের ভাষ্য, ‘আমরা নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানি নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। এটি যে খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বকে উপহার দেওয়া যাবে, তা বলছি না। কিন্তু যখন জ্বালানি তেলের সত্যিকারের সংকট দেখা দেবে, তখন আমরা হয়তো এমন কিছু উদ্ভাবন করতে সক্ষম হব, যার দ্বারা সারা পৃথিবী উপকৃত হবে। জ্বালানির সংকটের কারণে কোনো কিছু থেমে থাকবে না।’
এএফএস এই মুহূর্তে সিনথেটিক পেট্রল তৈরির একটি শোধনাগার তৈরির চিন্তা-ভাবনা করছে। দুই বছরের মধ্যে এই বাণিজ্যিক শোধনাগারটি আলোর মুখ দেখবে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। শোধনাগারটি তৈরি হয়ে গেলে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ লিটার সিনথেটিক পেট্রল তৈরি করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে এএফএস। রয়টার্স।

বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি আসছে না কেন


বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি আসছে না কেন
. সা'দত হুসাইন

 ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূচনা হয় এর আগে দেশের সাধারণ নির্বাচনগুলো শাসক দলের কঠোর নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিটি নির্বাচনে শাসক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে আবার মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছে ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তার পর থেকে দুই যুগ ধরে দেশের শাসনভার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- এই দুই দলের মধ্যেই অদল-বদল হয়েছে; প্রতি নির্বাচনেই ক্ষমতার পালাবদল বিশেষভাবে লক্ষণীয় তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী কয়েকটি ছোটখাটো দলের নেতৃস্থানীয় প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তাঁদের আসনসংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য; বেশির ভাগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একা বা তাদের জোটভুক্ত দলকে নিয়ে পালাক্রমে সরকার গঠন করলেও আমজনতা তথা ভোটাররা ক্ষমতাসীন অবস্থায় তাদের কার্যকলাপে চরম অসন্তুষ্ট হয়েছিল মানসিকভাবে সংক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল এমনটি বললেও অত্যুক্তি হবে না ক্ষমতাসীন দল যখন অত্যাচার-অনাচারে লিপ্ত হয়, বিরোধী দল তখন প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় জনতা তখন সেই দলে শামিল হয়, পরবর্তী নির্বাচনে নির্যাতিত প্রতিবাদী দল হিসেবে তাদের সমর্থন করে, ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দল এমন সব কাজ করে যে জনতা আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আগের ক্ষমতাসীন দল, যারা বর্তমানে বিরোধী দল, এবার প্রতিবাদী গোষ্ঠীরূপে আবির্ভূত হয় জনতা নিপীড়িত প্রতিবাদী দল হিসেবে তাদের সমর্থন করে, তারা আবার নির্বাচিত হয় জনতা প্রথমে দারুণ খুশি হয়, ধীরে ধীরে তাদের কার্যকলাপে, তথা অপকর্মে হতাশ হয়, বিক্ষুব্ধ হয় তারা দেখতে পায় প্রকৃতপক্ষে তারা বারবার পরাজিত হয়েছে অবশেষে নিজেদের স্বার্থে এবং জাতীয় স্বার্থে তারা বিকল্প সংগঠন, দল বা নেতৃত্বের সন্ধান করছে এই বিকল্পকেই কেউ কেউ তৃতীয় শক্তি হিসেবে অভিহিত করছে
তবে যোগরূঢ় অর্থে তৃতীয় শক্তি বলতে সামরিক শক্তি বা সামরিক সংগঠনকে বোঝায় আজ থেকে সাত-আট বছর আগে বিকল্প চিন্তাধারার বেসামরিক সংগঠনকেও তৃতীয় শক্তি হিসেবে মাঝেমধ্যে উল্লেখ করা হতো এসব সংগঠন পরবর্তী সময় কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় তৃতীয় শক্তি হিসেবে তাদের অবস্থান এবং অভিধার বিলোপ ঘটে ২০০৭ সালে সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তৃতীয় শক্তি নামকরণ যুক্ত হয়ে যায় বর্তমানে তৃতীয় শক্তি বলতে সাধারণ মানুষ সামরিক বাহিনীকেই বুঝে থাকে
বর্তমানে দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের বিকল্প হিসেবে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির কথাই মানুষ চিন্তা করে তবে চিন্তাধারার কিছু স্বাতন্ত্র্য বা অভিনবত্ব রয়েছে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি মানে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল নয় তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি অথবা জামায়াতে ইসলামীকে সহজেই চিহ্নিত করা যায় কিন্তু তারা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি নয় গতানুগতিক ধারার কোনো দলকে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না জাতীয় পার্টি একসময় ক্ষমতায় আসীন ছিল সময়ান্তরে তারা দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে তাদের কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা কিংবা কর্মধারা পরিলক্ষিত হয়নি জামায়াত একটি ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী রাজনৈতিক দল তারাও বিভিন্ন সময়ে দুই বৃহত্তম দলের সহযোগী দল ছিল, তবে বিএনপির সঙ্গে তাদের সংযোগ বেশি তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল, তাদের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত সাধারণ নাগরিকের কাছে দুই দলের কোনোটিই সমাদৃত নয় সাধারণ মানুষ ধ্যানে-জ্ঞানে যাদের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখতে চায়, এই দুই দলের কোনোটিই তার অন্তর্ভুক্ত নয় চিন্তাচেতনার দিক থেকে বাম দলগুলোর প্রতি এক শ্রেণীর শিক্ষিত নাগরিকদের সহানুভূতি থাকলেও এরা এত বেশি বিভক্ত এবং জনসমর্থনের দিক থেকে এতই দুর্বল যে এদের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনায় আনা যায় না এক কথায়, বাম দলগুলোর কোনো গণ-আবেদন নেই
গণ-আবেদন রয়েছে এমন দলকেই জনগণ তৃতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে গ্রহণ করতে চায় গণ-আবেদনের জন্য আকর্ষণীয় স্লোগান, গণমনজয়ী কর্মসূচি এবং বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন বিশদ কর্মসূচি না থাকলেও অন্ততপক্ষে সুলিখিত এবং সুসংহত প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে প্রতিশ্রুতির আঙ্গিক হবে নিম্নরূপ- () মানবাধিকার এবং সুনির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা হবে, () সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা হবে, () স্বাধীনতা এবং এর চিন্তাচেতনার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে, () দেশে প্রকৃত অর্থে ন্যায়াচার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে, () দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দলবাজির অবসান করা হবে, () প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিত্যাজ্য হবে, () সর্বস্তরে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হবে, () প্রশাসনে নিয়মনিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সুরক্ষণ করা হবে, () জনগণ এবং দেশের স্বার্থকে দল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হবে, (১০) কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, (১১) পরিবেশ বিধ্বংসী সব রকম কার্যকলাপ- বিশেষ করে খাল-বিল, নদী, মাঠ, জলাভূমি, বনের দখলবাজি কার্যকরভাবে প্রতিহত করা হবে, (১২) কোনো অজুহাতে বিদেশিদের কাছে দেশীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়া হবে না তালিকা দীর্ঘ করা যায়, তবে বাস্তবতার নিরিখে তা যুক্তিসংগত মনে হলো না অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যাখ্যা এবং সম্প্রসারণের প্রয়োজন হবে
উপরোক্ত নীতিগুলোকে সমর্থন করে এমন লোকের অভাব নেই বৈঠকী আলাপে কিংবা সেমিনার-ওয়ার্কশপে নীতিগুলোর পক্ষে বক্তব্য রাখেন এমন লোকের সংখ্যাও খুব কম নয় তবে নীতিগুলোর সমর্থনে জনসমক্ষে বক্তব্য রাখবেন এবং জনমত সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন- এমন লোকের সংখ্যা তেমন বেশি নয় কোনো সংগঠনের মাধ্যমে উল্লিখিত নীতিগুলোর বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করতে রাজি আছেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম হাতেগোনা কয়েকজন হতে পারে বিদ্যমান সংগঠনের মাধ্যমে অথবা নতুন সংগঠন গড়ে নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন লোক খুঁজে পাওয়া বাংলাদেশে বর্তমানে দুষ্কর হয়ে পড়েছে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে হলে সংগ্রাম করতে হবে, জেল-জুলুম, নিপীড়ন সহ্য করতে হবে সংগঠনকে সক্রিয় রাখার সামর্থ্য থাকতে হবে সর্বোপরি জনগণের আস্থা অর্জন করে তাদের নীতিগুলোর পক্ষে কাজ করার লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে
জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, তাদের প্রাথমিক বিশ্বাস আনুগত্য অর্জনের জন্য নেতৃত্বাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিকে সাধারণভাবে সুপরিচিত হতে হবে ব্যাপকভাবে খ্যাতিমান হলে আরো ভালো হয় বিকল্প হিসেবে কঠোর একাগ্রতা, ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি নেতৃত্বের দক্ষতা চিত্তাকর্ষক কর্মপদ্ধতি, কর্মকৌশলের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি নেতৃত্বে সমাসীন হতে পারেন ক্ষেত্রে কৌশলী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তার নিজস্ব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরূপ নেতৃত্বের আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না আপাতত ধরনের উদীয়মান নেতৃত্বের বিকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে না
জনগণের দৃষ্টি এখন সুপরিচিত, সুনামধারী খ্যাতিমান ব্যক্তিদের দিকে তাঁদের বিশ্বাস, এই শ্রেণীর ব্যক্তির মধ্য থেকেই একজন কেউ এগিয়ে আসবেন জাতিকে নতুন পথে চলার সাহস এবং শক্তি জোগাবেন তাঁর নেতৃত্বে তাঁরা একটি সুখী-সমৃদ্ধ, ন্যায়নিষ্ঠ, দুর্নীতিমুক্ত এবং গণবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠা করবে রকম বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কথা তাঁদের মনে আসে কিন্তু এসব ব্যক্তি এগিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন বলে মনে হয় না তাঁরা আদৌ এগিয়ে আসবেন কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না এদের মধ্যে দু-একজনের যোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে জনগণ যথেষ্ট আশাবাদী এতদসত্ত্বেও তাঁরা কেন এগিয়ে আসছেন না অথবা যাঁরা নতুন কিছু করবেন বলে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন, তাঁরা কেন সফল হতে পারেননি সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রাসঙ্গিক হবে
দু-একজন শিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান এবং সুখ্যাত ব্যক্তি নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করে দুর্নীতি এবং অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন কিন্তু জোরালো কোনো আন্দোলন করার শক্তি সঞ্চয় করতে পারেননি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আন্দোলন-সংগ্রাম জোরদার করতে হলে নিজের রাজনৈতিক দলকে সুসংগঠিত এবং জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় জন্য যে আন্তরিকতা, শ্রম এবং ত্যাগী মনোভাবের প্রয়োজন হয়, উল্লিখিত শিক্ষিত এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গের সে রকম আন্তরিকতা বা মনোভাব আছে বলে মনে হয় না এসব শিক্ষিত এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি উচ্চ মধ্যবিত্ত তাঁরা আরাম-আয়েশ, রুজি-রোজগার এবং বিদেশ ভ্রমণে আসক্ত এসব ছেড়ে নিরন্তর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে তাঁরা রাজি নন রাজনীতি তাঁদের জন্য অনেকটা ছুটিকালীন 'হবি' এই জীবনধারা নিয়ে ইস্যুভিত্তিক বড় রকমের রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় আবার দেখা গেছে, কোনো সু-উচ্চ মর্যাদার অতিপরিচিত ব্যক্তি আদর্শভিত্তিক নতুন ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের আশ্বাস দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন পরে প্রতীয়মান হয়েছে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি আসলে তাঁর কমিটমেন্ট নেই, তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে রাজি নন, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাঁর সামর্থ্য নেই, বরং দলে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক তাঁর অনুসারীরা একে একে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে এখন তিনি একা তাঁর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না
ছাড়া বিশাল মাপের মুক্তিযোদ্ধা, সুপ্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতা, স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, অতীতে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা অনেকেই রাজনৈতিক দল করে এগোতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু তাঁদের প্রাক-রাজনৈতিক এবং রাজনীতি করাকালীন জীবন-বৃত্তান্ত এমন যে তাঁদের প্রতি জনসাধারণ আকৃষ্ট হয়নি জনতা আকর্ষণ করার মতো সম্মোহনী শক্তি তাঁদের নেই অথবা জনতা তাঁদের ব্যাপারে আগে থেকেই মোহমুক্ত আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে বিষণ্ন জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামাবাদ থেকে করাচির ট্রেনে যাত্রা শুরু করেছিলেন ট্রেন লাহোরে থামার পর হাজার হাজার জনতা 'জিয়ে ভুট্টো, জিয়ে ভুট্টো' স্লোগান দিয়ে ট্রেনটি ঘিরে ধরে ভুট্টোর জীবনে নতুন যাত্রা এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে যাঁরা নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলে যাত্রা শুরু করেছেন, তাঁরা জনতাকে সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারেননি পথযাত্রায় কিংবা জনসভায় লোক আকর্ষণের দিক থেকে এখন পর্যন্ত হাসিনা-খালেদার কোনো জুড়ি আছে বলে মনে হয় না হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হিসেবে অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতা মাঠে আসেননি
দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রায় সব শিক্ষিত সুজন দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ড্রইংরুমের আলোচনায় তাঁরা খুবই সোচ্চার মনে হয় যেন তাঁদের ক্ষোভের সীমা-পরিসীমা নেই তাঁরা মনে-প্রাণে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন চান লক্ষ্যে নতুন কোনো রাজনৈতিক নেতা কেন এগিয়ে আসছেন না সে জন্য তাঁদের ক্ষোভের সীমা নেই তাঁরা নিজেরা কেউ এগিয়ে আসতে রাজি নন প্রশ্নোত্তরে বিশদ আলোচনা করে আমি জানতে পেরেছি তাঁদের এগিয়ে না আসার কারণ তাঁরা আরাম-আয়েশের জীবনে আসক্ত হামলা-মামলা, জেল-জুলুমকে তাঁদের দারুণ ভয় দেশের একজন রাষ্ট্রপতিকে নতুন দল করার কারণে রেললাইন ধরে অমানবিকভাবে তাড়া করা হয়েছে, নিজেদের দলের সাবেক সংসদ সদস্যের কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে মামলার তো শেষ নেই যে লোকই শাসক দলের বিরুদ্ধে কথা বলে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় নানা অজুহাতে মামলা করা হয় সেসব জেলার কোর্ট-কাছারিতে উপস্থিত হওয়া যেমন হয়রানিমূলক, তেমনি দলীয় ক্যাডারের আক্রমণের শিকার হওয়া রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিব্রতকর মামলায় জেল-হাজতবাস অস্বাভাবিক কিছু নয় শিক্ষিত সুজনরা এসব জেল-জুলুম-অত্যাচারের মধ্যে যেতে চান না এমনকি রোদের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে মিছিল করা বা দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করাকেও তাঁরা অনেকে সহনীয় কাজ বলে মনে করেন না শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে সভা-সম্মেলনে যেতে তাঁরা রাজি আছেন জেলখানার কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিতে তাঁদের হয়তো তত আপত্তি থাকত না বর্তমান অবস্থায় ড্রইংরুমের প্রতিবাদী আড্ডা কিংবা গোলটেবিল আলোচনার মধ্যেই তাঁদের কর্মতৎপরতা সীমিত রাখার পক্ষপাতী
তাঁদের চিন্তাধারা অযৌক্তিক বা অসংগতিপূর্ণ এমনটি বলা ঠিক হবে না তাঁরা মনে করেন, শাসক দলকে ভোট দিয়ে তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তাঁরা এর প্রতিশোধ নেবেন কালক্রমে যদি ভিন্ন প্রকৃতির কোনো শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে উল্লিখিত স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে, তবে তাঁদের অনেকেই সে দলে যোগ দেবেন এক কথায়, শাসক দলের অন্যায়-অত্যাচারকে তাঁরা ঘৃণা করেন; কিন্তু শাসক দলের হাতে তাঁরা নিগৃহীত হতে চান না হত্যা, গুমের রাজনীতি শুরু হওয়ার পর তাঁরা আরো আতঙ্কিত জীবন-মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছায়, অথবা ভাগ্যের হাতে- বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে অন্তত এক বছর কারাবাসের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগদানের সংকল্প তাঁদের চিন্তার বাইরে
মধ্যবিত্তের খপ্পরে পড়েছে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় (Liberal Democratic Dispensation) অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শ্রেণী-সংগ্রামে বিশ্বাসী কোনো সর্বহারা দলের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা নেই শিক্ষিত সুজন কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে শুধু একটি উদার গণতান্ত্রিক দল সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে তিনটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এই নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করবে এগুলো হচ্ছে সাহস, সংকল্প এবং উদাত্ত আহ্বান (courage, commitment and clarion call) এই তিন বৈশিষ্ট্যের সমাহারে সুগঠিত নেতৃত্ব বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে না কখন পাওয়া যাবে অথবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না যদি কখনো পাওয়া যায়, তবেই ঘটবে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব