Monday, October 08, 2012

বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি ও আমাদের স্বাধীনতা


বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি ও আমাদের স্বাধীনতা

লেখক: কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান  |  সোমবার, ৮ অক্টোবর ২০১২, ২৩ আশ্বিন ১৪১৯

প্রায় এক বছর ধরেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। কিন্তু গত সেপ্টম্বরে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকগণও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এতদিন পর্যন্ত কতিপয় ব্যতিক্রমধর্মী অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশ্লেষক বিশ্বব্যাংকের কর্মকান্ড নিয়ে একাডেমিক সমালোচনা করলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের প্রস্তাব করায় বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বব্যাংক বিরোধী অবস্থান আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক’ নাটকে এতদিন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক একাই খেলছিল। এখন সেই খেলায় বাংলাদেশও রাষ্ট্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং নাটক জমে উঠে। তবে নাটকের শেষ উপাখ্যান কোথায় সেটা বলা কঠিন। নাটকটি বিয়োগান্তক নাকি মিলনাত্মকভাবে শেষ হবে সেটা বলাও মুশকিল।

বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এতদিন পর্যন্ত মার্ক্সবাদী আদর্শের রাষ্ট্রগুলোই বিতর্কে জড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাংকের ইমেজের তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি পুঁজিবাদী দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রভাবশালী পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী ঝড় তুলবে-এই প্রত্যাশা এই সকল প্রতিষ্ঠানে থাকে না। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাষ্ট্রগুলো বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করলে তার ইমেজ সংকট যতটা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি হয় যদি বাংলাদেশের মতো কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সেই বিতর্ককে উস্কে দেয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, পুঁজিবাদ নির্ভর করে ইমেজের উপর। আর পুঁজিবাদী কোনো প্রতিষ্ঠানের ইমেজ সংকট অর্থ হলো সেই ব্যবস্থারই ইমেজ সংকট। এই অবস্থায় পুঁজিবাদী আদর্শের মধ্যে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই অবস্থান প্রতিষ্ঠানটিকেই শুধু নাখোশ করবে না বরং পুঁজিবাদের কর্তাব্যক্তিদেরকেও অসন্তুষ্ট করবে। এই পরিস্থিতিতে “বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক” নাটক বিয়োগান্তক হবে নাকি মিলনাত্মক হবে তার কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করা যায়।

বিশ্বব্যাংকেরই এক সময়ের কর্তাব্যক্তি জোসেপ স্টিগলিটজ দি ইকনমিক জার্নাল-এ “দি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এট দ্যা মিলিনিয়াম” শিরোনামে লিখিত নিবন্ধে ব্রেটন ওডস ইনস্টিটিউটগুলোর বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিলেন। গত শতাব্দীর শেষ দিকে বিভিন্ন পন্ডিত মহল থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে ‘পঞ্চাশ বছরই যথেষ্ট’ বলে যে সমালোচনা করা হতো সেই বিষয়টিও স্টিগলিটজ উত্থাপন করেছেন। স্টিগলিটজের আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, গভর্নেন্স ইত্যাদি বিষয় বিশ্লেষিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এই কলামটি লেখার জন্য জার্নাল অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ-এর “ইউএস পলিটিক্স এন্ড ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আইডিএ লেন্ডিং” শিরোনামের একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। লেখকের বক্তব্য ছিল যে, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা অবজেক্টিভলি কাজ করে আর কতটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এডহক কূটনীতির প্রয়োজনে কাজ করে-এ বিষয়ে একটি নীরব বিতর্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সফ্ট লোন উইন্ডো হলো আইডিএ। এই আইডিএ বাংলাদেশের পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করছে। এই আইডিএ-এর ঋণ প্রদানের সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সিপিআইএ এবং এআরপিপি নামক দু’টি স্কেলের সূচকের ভিত্তিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারফর্মেন্স অনুসারে ঋণ বরাদ্দ হয়। কিন্তু মুশকিলের ব্যাপার হলো এই স্কেলগুলোতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পারফর্মেন্স কখনোই প্রকাশ করা হয় না। দেখা গেছে যে, ৯/১১ পরে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান অংশগ্রহণ করায় আইডিএ-এর ঋণ ২২৬ মিলিয়ন ডলার (২০০১ সাল)  থেকে ৮৬০ মিলিয়ন ডলারে (২০০২ সাল) উন্নীত হয়।

“বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক” নাটকের প্রথম পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে তা বাতিল হয় এবং তৃতীয় পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক পুনরায় ফিরে আসে। এই নাটকের চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক যে চার শর্তে পদ্মায় ফিরেছে সেই চার শর্তের সবচেয়ে জটিল শর্তটি বাস্তবায়ন করতে চলছে।  এরই পরিপ্রেক্ষিতে সে দুর্নীতি তদন্ত পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক দল গঠন করেছে। এই দলে আর্জিন্টিনা, যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংয়ের নাগরিকগণ রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনজনই খ্যাতিমান। পুঁজিবাদের ধারক ও বাহকদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার অভিজ্ঞতা এই তিন জনেরই রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ফেরার তৃতীয় শর্ত অনুসারে এই দলের বাংলাদেশের দুনীতি দমন কমিশনের তদন্তে পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। এই প্যানেল সুষ্ঠু তদন্ত ও অগ্রগতি সম্পর্কে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিবে। আমাদের দুনীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলো এই দল শুধুমাত্র তদন্ত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ফেরার শর্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি এত ছেলেখেলা নয়। বিশ্বব্যাংকের এই তদন্ত দল দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমের অনেক গভীরে পৌঁছতে সক্ষম। এই তদন্ত দলের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করতে হবে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির পরিপূরক হিসেবে কীভাবে কাজ করে তার আলোকেই। এই তদন্ত দলের প্রধান ওকাম্পোর অতীত কার্যক্রম মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডাই মূলত প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনিই ২০১১ সালে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছিলেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে এমন পর্যবেক্ষণকারী দল বিরল। দুর্নীতি দমন কমিশন চূড়ান্ত পর্যায়ে যদি দাবি করে যে, পদ্মা সেতু কার্যক্রমে কোনো দুর্নীতি হয়নি এবং অন্যদিকে পর্যবেক্ষণকারী দল যদি দাবি করে যে, সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি তখনি শুরু হবে নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়। এই পর্যায়ে তদন্ত পর্যবেক্ষণকারী দল যদি তাদের রিপোর্ট নিয়ে কানাডার আদালতে হাজির হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায় যদি আদালত এমন কিছু করে যা বাংলাদেশের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখনি শুরু হবে নাটকের চূড়ান্ত পর্যায়। এই পর্যায়টি যে আর মিলনাত্মক হবে না তা অনুমান করা যায়। তবে পরিতাপের বিষয় হবে যখন এই ‘নাটক খেলায়’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনী ও সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

++লেখক:শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রেটনওড্স ইন্সটিটিউট গবেষক

kazipoliticalscience@gmail.com

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.