Monday, October 22, 2012

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা

জঙ্গীবাদ ও প্রজন্মের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা
লেখক: ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ  |  সোমবার, ২২ অক্টোবর ২০১২, ৭ কার্তিক ১৪১৯
পৃথিবী এগুচ্ছে দ্রুত প্রগতির স্বাভাবিক নিয়মে। আর ইতিহাস মূর্খতার সুযোগে ধর্ম আর রাজনৈতিক বণিকদের শ্রেণীস্বার্থ সুপ্রতিষ্ঠার জন্য জঙ্গীবাদের অন্ধকার চেপে ধরতে চাইছে। আমাদের প্রগতির চাকা বিকল করে অধোগতির চাকা জুড়ে দিয়ে দেশটাকে ঠেলে দিচ্ছে পেছনে। এদেশে জঙ্গীবাদের বাস্তবতা, স্বরূপ অনুধাবন ও সংকট শনাক্ত করার ব্যাপারে বড় দু’দল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ঘর্মাক্ত হচ্ছে। বিএনপি নামের দলটি সময়ের সুবিধায় বলা যায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংকট ও নানা ব্যর্থতার সুযোগে অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতান্ধ হয়ে এই শক্তির সম্পদ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে দেশপ্রেমের মন্ত্রে নিজেদের ঋদ্ধ করলো না। বরঞ্চ মৌলবাদী দলগুলোর সাথে সখ্যতা তৈরি করে নিজেদের জাত চেনাতে থাকলো। দলটিকে ভালোবেসে যে অসংখ্য দেশপ্রেমিক মানুষ তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন রেখেছিল তাদের অনুমোদনের প্রয়োজন মনে করলো না। রাজনৈতিক মেধাহীনতা ও স্বার্থবাদের কাছে দেশপ্রেম যখন পরাজিত হয় তখন রাজনীতি পরিচালকদের কাছে সুস্থ চিন্তা আশা করা যায় না।
আওয়ামী লীগের ছকেও কি কোনো পরিবর্তন হলো? মুক্তিযুদ্ধ-স্নাত এদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের তো আওয়ামী লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বন্ধুত্বে নিজেদের জড়িয়ে অমন কোনো দলে চলে যাওয়ার কথা নয়। তবুও অনেকে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু অতীত ভুল স্বীকার করে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে আওয়ামী লীগের আধুনিক রাজনীতিকরা কি জনগণের রাজনীতিতে ফিরে এসেছে। এসব কারণে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে রাজনৈতিক ঝগড়াটি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী অপশক্তি। মৌলবাদী শক্তিগুলোর বড় সুবিধা উজ্জ্বল অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস প্রজন্মের চোখ থেকে আড়াল করে রাখা। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে যুক্তি আর মানবতার সৌন্দর্য দেখার অন্তর্চোখ অন্ধ করে দেয়া। এভাবে কোমলমতি ছেলেমেয়েগুলোকে জঙ্গী বানানো হচ্ছে অসামপ্রদায়িক রাজনীতির ধ্বজ্বাধারীদের ক্রমাগত ব্যর্থতার ফলে।
রাজনৈতিক সুবিধার জন্য প্রকৃত সত্য আড়াল করতে চায় সকলেই। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চায় জঙ্গীবাদ ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বিএনপি আমলে। আর তারা এই অপশক্তির প্রায় মূলোত্পাটন করেছে। বিএনপির দাবি- বড় বড় জঙ্গীদের ধরে তারাই শাস্তি দিয়েছে। দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীরা দাবি করেন- দেশে এখন আর জঙ্গী তত্পরতা নেই। কিন্তু জামায়াতী তত্পরতায়, কট্টর ধর্মীয় দলগুলোর সক্রিয়তায়, হিজবুল তাহেরির মাঝে-মাঝে সরব আত্মপ্রকাশে বিশ্বাস করার সুযোগ রাখে না যে এদেশ থেকে জঙ্গীবাদ নির্বাসিত হয়েছে। প্রায়ই শোনা যায় শুধু কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নয়, মগজ ধোলাই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদেরও। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের জঙ্গীবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ার কথা প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতি সমপ্রতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশী ছাত্র নাফিসের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা নিয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নাফিস এদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। বাবা সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে ছেলেকে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। এখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অভিযোগ- যুক্তরাষ্ট্রে আসার ছ’মাসের মধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে আসে নাফিস। অবশেষে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে তারা নাফিসকে গ্রেফতার করেছে। এতে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নাফিসের পরিবার ছেলেকে নির্দোষ দাবি করেছে এবং বলেছে নাফিসকে কোনো পক্ষ ফাঁসিয়েছে। নাফিসের আমেরিকান সহপাঠি ও পরিচিতদের কেউ কেউ নাফিস সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কথা বলেছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে আইনগতভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করার। আমরাও আশা করবো নাফিস নির্দোষ প্রমাণে মুক্তি পাক। এতে নাফিস, তার পরিবার ও রাষ্ট্র দায়মুক্ত হবে। তবে আমার আশংকা অন্যখানে।
জঙ্গী তত্পরতা, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের পক্ষ থেকে ঝটিকা মিছিল, চোরা-গোপ্তা হামলায় আজকাল প্রায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়।  এটি ভাববার বিষয়। তারুণ্যকে সবসময় মুক্ত চিন্তার দেশপ্রেমিক ভাবতে ভালো লাগে। কিছু সংখ্যক ধর্ম-রাজনৈতিক বণিক কেমন করে এদের মগজ ধোলাই করে ফেলে তা এক বিস্ময়। আমার বার বার মনে হয়েছে ইসলামের স্বরূপ ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এদের সামনে আমরা তেমনভাবে তুলে ধরতে পারিনি বলে অপশক্তি এদের গ্রাস করেছে।
বর্তমান সময়ে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের কাছেই ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। মুসলমানদের উগ্র জঙ্গীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করছে। কোথাও বোমা হামলায় জীবন ও সম্পদহানি হলে সকলের সন্দেহের চোখ পড়ে ইসলামী জঙ্গীদের ওপর। এভাবে ইসলামের অপার সৌন্দর্য, মানবতাবাদী দর্শন ও শান্তির ধর্ম হিসেবে এর পরিচিতি চরম লাঞ্ছিত হচ্ছে ধর্ম-বণিক, জ্ঞানপাপী আর ধর্ম-মূর্খ মানুষগুলোর হাতে। এই বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের দিকেই যদি চোখ ফেরাই কী ছবি ভেসে উঠবে? তেরো শতকের সূচনাকাল পর্যন্ত এদেশ ছিল বৌদ্ধ আর হিন্দু রাজাদের অধীন। এগারো শতক থেকে সীমিতভাবে দেশের নানা অংশে মুসলমান সুফী সাধকরা আসতে থাকেন। ইসলামের সাম্যের বাণী ও মানবপ্রেমের কথা প্রচার করতে থাকেন তাঁরা। অমন মানবতাবাদী ধর্মের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় এদেশবাসীর। এর আগে আট শতকে শুধু চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্র তীরাঞ্চলে আরব বণিকদের সংস্পর্শে মানুষ ইসলাম সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা ব্রাহ্মণ সেনরা পাল রাজাদের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে এসে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় হয়ে যায়। পালদের দুর্বলতার সুযোগে এরা বাংলার সিংহাসন দখল করে নেয় এগারো শতকের মাঝামাঝি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মানসিক অস্বস্তিতে পড়ে সেন শাসকরা। বাংলার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। হয়ত সে খবর রেখেছে তারা। তাই এদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল এদেশের মানুষ যাতে জেগে না ওঠে। এ কারণে কঠোরভাবে বর্ণ বিভাজন প্রয়োগ করে। একই ধর্ম ও সমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও বাংলার সাধারণ মানুষকে শূদ্র বর্ণভুক্ত করে দেয়। আর সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি আরোপ করে শূদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদের নির্বাক করে দিতে চায়। ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত করে কোণঠাসা করে ফেলতে চায়। ধর্মীয় অনুশাসনকে বিকৃতভাবে প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় শূদ্র-হিন্দু হবে ব্রাহ্মণের সেবাদাস। সংস্কৃত শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ শূদ্রের জন্য। তারা শুধু ব্রাহ্মণের দেয়া বিধান মেনে চলবে। কারণ শাসক ব্রাহ্মণ জানে প্রকৃত ধর্ম তাদের আরোপিত অমানবিক বিধান সমর্থন করে না। তাই ধর্মচর্চা করতে দেয়া হবে না শূদ্রকে। মানুষকে অন্ধকারে রাখতে পারলেই ধর্মপ্রবণ মানুষকে মনগড়া ব্যাখ্যায় আচ্ছন্ন করা যাবে। কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ আসবে না। বরং ধর্মান্ধ মানুষকে দিয়ে উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়া সহজ হবে।
এ যুগের ধর্ম-বণিকরা এসব সত্য বুঝতে না চাইলেও যেসব সুফী সাধক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হাজার বছর আগে ইসলামের মানবিক আবেদন ছড়িয়ে দিয়ে বাংলায় ইসলাম ধর্মের বিকাশের পথ তৈরি করেছিলেন, তাঁদের নবীর আদর্শ বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি। যাঁরা প্রথম মাদ্রাসা তৈরি করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিলেন তাঁরা তাঁদের উদারতা ও অসামপ্রদায়িক মনোভঙ্গি দিয়ে প্রকৃত অর্থেই আলোকিত করতে পেরেছিলেন চারপাশ। চৌদ্দ শতকে সোনারগাঁওয়ে মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন দিল্ল­ী থেকে আসা প্রখ্যাত সাধক শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। এই বিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদ তাঁর মাদ্রাসায় কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি গণিত, আইন, চিকিত্সাবিদ্যা ইত্যাদি জাগতিক বিষয় অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই মাদ্রাসায় একসময় শিক্ষকতা করেন সে যুগের বিশিষ্ট পণ্ডিত সমরখন্দ থেকে আসা বহু ভাষাবিদ কাজী রুকনউদ্দিন আল সমরখন্দী। তিনি একবার জানতে পারেন আসামে একজন ব্রাহ্মণের কাছে ‘অমৃতকুণ্ড’ নামে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হিন্দু যোগশাস্ত্রের মূল্যবান গ্রন্থ আছে। জ্ঞান অন্বেষী রুকনউদ্দিন ‘অমৃতকুণ্ড’ পড়ার জন্য সংস্কৃত শিখলেন। এই জ্ঞানগর্ভ দার্শনিক গ্রন্থটি পড়ে এতই আলোড়িত হয়েছিলেন যে আরবি ও ফারসি ভাষায় অমৃতকুণ্ডের অনুবাদ করেন। শুধু তাই নয়, অমৃতকুণ্ড সোনারগাঁও মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে নবীর অনুসারী এ সকল পণ্ডিত শুধু ইসলামী জ্ঞানের ভেতর জ্ঞানচর্চাকে আটকে রাখেননি।
মধ্যযুগে বাংলায় আসা সুফী সাধকরা তাঁদের কপর্দকটুকু বিলিয়ে দিতেন মানবকল্যাণে। তাঁরা যেখানে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করতেন তাতে অনেক কিছুর আয়োজন থাকত। থাকত নিরন্ন মানুষের জন্য লঙ্গরখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা আর চিকিত্সালয়। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল অবারিত। সেন রাজাদের হাতে অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বিপন্ন শূদ্র হিন্দুদের কাছে ছিল এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। ধর্মের এই মানবিক আচরণ তাদের জীবনের আশ্বাসবাণী শোনায়। তাই সুফী সাধকরা সহজেই ধর্মান্তরকরণে সফল হয়েছিলেন। অথচ আজ ধর্মান্ধদের উন্মত্ততার পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের কাছে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পৌঁছে। তাই আজ আমেরিকার গোয়েন্দারা নেতিবাচক পথেই সমস্যার মোকাবেলা করতে চাইছে। যেখানে ভুল পথে হেঁটে জঙ্গীবাদের দিকে ঝোঁকা একজন শিক্ষার্থীকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সুপথে আনবে সেখানে ফাঁদ তৈরি করে নষ্ট পথে হাঁটার দিকে প্রলুব্ধ করছে। এভাবে আধা-জঙ্গী মানসিকতার একজন তরুণকে পুরো জঙ্গী বানাতে কিছুমাত্র দ্বিধা করছে না। নাফিস সম্পর্কে গণমাধ্যমে আসা রিপোর্টগুলো থেকে অমন ধারণাই তৈরি হতে পারে।  আমরা মনে করি ইসলামের প্রকৃত মানবিক শিক্ষা, জেহাদ সম্পর্কে ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা আর বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফীদের অহিংস প্রেমবাণীর সাফল্যের ইতিহাস প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা খুবই জরুরি। প্রজন্ম যত ইতিহাস বিচ্ছিন্ন থাকবে অন্ধকারের অপশক্তি ততটাই গ্রাস করবে।
[ লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ]

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.