Thursday, October 18, 2012

সোনালী আঁশের নতুন সম্ভাবনা


সোনালী আঁশের নতুন সম্ভাবনা

লেখক: মোস্তাক আহমেদ ইমন  |  বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর ২০১২, ৩ কার্তিক ১৪১৯
একদা বিশ্ববাজারে ৮০% পাট রপ্তানি হতো বাংলাদেশ হতে। উনিশ শতকের দিকে দেশ থেকে নিয়মিত পাট ইউরোপে রপ্তানি হতো কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে পাট উত্পাদনের এই অঞ্চলটি থেকেছে বার বার অবহেলিত। শিল্পের স্থানীকরণের সকল শর্ত পূরণ করা সম্ভব হলেও পাট শিল্প কারখানা এ দেশে স্থাপিত হয়নি, উপমহাদেশে প্রথম পাটকলটি স্থাপিত হয় ১৮৫৫ সালে কলকাতায় হুগলী নদীর তীরে। এভাবে এ দেশের কাঁচামালকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডের ডান্ডি ও ভারতের কলকাতা নগরে পাট শিল্পের স্থানীয়করণ হলে আরও নিজ ভূমিতে পরবাসী ছিল পাট। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময়ও বেশিরভাগ পাটকল পড়ে ভারতের অধীনে। তবে ’৪৭-এর পর বেশ ক’টি পাট শিল্প দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়, যার বেশিরভাগেরই মালিকানা ছিল পাকিস্তানিদের হাতে। ফলে স্বাধীনতার পরে পাট শিল্প একটি অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে। এই মালিকানাহীন জটিলতা ও বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার মূল্য আমাদেরকে দিতে হয়েছে দীর্ঘদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে, ফলে সরকার বাধ্য হয়ে এক সময় বড় বড় পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়। পাটের উপর শুধু এই সব বিপর্যয়ই নয়, ১৯২৯ সালে “অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়” ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও পাট শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে বসেছিল। এতে নতুন করে ঢেউ লাগে পলিপ্রপাইলিনের (পিপি) আবিষ্কারের পর হতে। এই পিপি ও পাট এখন এক সাথে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববাজারে টিকে আছে। নানা সংকটময় পথ অতিক্রম করে টিকে থাকার লড়াই এ প্রাকৃতিক এই তন্তুর সুদিন দিনে দিনে মজবুত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশই আজ পাটের ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝতে পারছে।
সাম্প্রতিককালে পাটের বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের কারণে এবং দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা মজবুত না হওয়াতে পাট চাষে বিপাকে পড়েছে চাষিরা। পাট চাষ করে কৃষক সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। অথচ ১ কেজি ধান চাষ করতে ৩-৪ কেজি পানির প্রয়োজন হয়, তাই ধান একটি পানি খেকো খাদ্যশস্য। অপরদিকে পাট আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল এবং এটি চাষে তেমন বেশি পানির প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা জমিতে সেচ নির্ভর ধান চাষ করে ক্রমাগতভাবে জমির উর্বরা শক্তিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি অথচ কৃষকরা এক সময় মিলেমিশে জমিতে ধান ও পাট চাষ করতো। পাটের পাতা জমিতে উত্কৃষ্ট ‘সবুজ সার’ হিসাবে কাজ করে। ভালো মানের বীজ, পাট পচানোর জলাশয়, পুকুর ডোবা ও নালাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া অথবা শুকনো মৌসুমে পানি না থাকা, সেই সাথে পাট চাষে সঠিক দাম না পাওয়াতে কৃষক পাট চাষ করে হতাশ হচ্ছে। তারা দিনে দিনে সেচনির্ভর ধান চাষ করে ভূমি ও পানির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। সরকার পাট এর ক্রয়মূল্য প্রতিমণ ২ হাজার ২০০ টাকা বেধে দিলেও নির্ধারিত দামে কেউ পাট কিনছে না। বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিরা প্রতিমণ পাট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা বা কোন কোন অঞ্চলে তার চেয়েও কম দামে পাট বিক্রয়ের খবর আসছে। সরকারি পাট কলগুলোতে ও এবার পাটের চাহিদা কম, গতবার যেখানে পাট ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ লাখ ৬০ হাজার বেল তা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ বেলে কিন্তু পাট ক্রয় কেন্দ্রর সংখ্যা ১৩৭ থেকে ১৬৮ তে উন্নতি হলেও কৃষকরা সঠিক দাম পাচ্ছে না এবং তা মনিটরিং করার দায়িত্বও যেন কারো নেই।
এ কথা সত্য পাটের সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকেই কান্ডারির ভূমিকা পালন করতে হবে। এবার চাষীরা ধানের দাম কম পাওয়াতে পাটের দাম নিয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল, তাই ধানের পর পাটের দরপতন কৃষককে করেছে হতাশ। এবার শুধুমাত্র রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলাতেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১১ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। এই পরিসংখ্যানটি পাট চাষের উত্সাহ সম্পর্কে কৃষকদের আগ্রহের পরিচয় দেয়। কিন্তু পাট চাষে অতীত সমস্যাগুলো এখনো বিদ্যমান, চাষীরা এখনো পাট চাষে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল সেই সাথে আমদানী নির্ভর বীজের ব্যবহার পাটের মান ও ফলন কম দিচ্ছে এবং পাট পচাতে প্রয়োজনীয় পানি সংকট ইত্যাদি সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে। এমনকি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর উদ্ভাবিত “বিরন রেটিং” পদ্ধতিও চাষীরা গ্রহণ করছে না, এটি বেশি পরিমাণে নিয়ম মাফিক ব্যবহার করতে হয় তা না হলে ভালো ফল আসে না।
পাট শিল্পের সোনালী অতীতকে ফিরে পেতে চাইলে আমাদের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাটে উত্পাদিত প্রথাগত পণ্য যেমন পাকানো সুতা, শক্ত কাপড়, চটের ব্যাগ, টুইল কাপড়, কার্পেট ব্যাকিং, উলপ্যাক, দেয়ালের আচ্ছাদন, গালিছা ও বিভিন্ন ধরনের গৃহসজ্জার বস্ত্র ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নতুন নতুন কলাকৌশল প্রয়োগ করে এর বহুবিধ ব্যবহার বাড়াতে আরো বেশি কাজ করা প্রয়োজন। সেই সাথে বন্ধ পাটকলগুলো চালুকরণ, পাটের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারটি মজবুত করা, স্থানীয়ভাবে পাটের বীজ উত্পাদনে নজর দেওয়া, পাটশিল্পকে প্রয়োজনে আরো সহজে ঋণ বা আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, দক্ষ ব্যবস্থাপনাসহ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চত করা এবং সর্বোপরি প্রয়োজন কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। দেশে পাটকলগুলো আবার কর্মমুখর হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশায়।
n লেখক :শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.