Monday, December 31, 2012

স্বৈরশাসকের হয়ে রাজনীতির মাঠে ফাউল খেলা --- দৈনিক ইত্তেফাক


স্বৈরশাসকের হয়ে রাজনীতির মাঠে ফাউল খেলা
ফারাজী আজমল হোসেন
'একটি শাসন ব্যবস্থা যদি গুটিকয়েক লোকের পরিবর্তে অনেক লোককে সুবিধা দেয় তার নাম গণতন্ত্র।'- ৪৬০ খৃষ্টপূর্বাব্দে গণতন্ত্রকে এভাবেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন এথেন্সের শাসক পেরিক্লেস। পেরিক্লেসকে সামনে রেখেই গরীব লোকেরা সেসময় এথেন্স-এর সরকারি অফিস দখল করেছিলো। এথেন্সবাসী প্রকৃতপক্ষে বাঁচার জায়গা খুঁজে পেয়েছিলো পেরিক্লেসকে পেয়ে। বলা হয়ে থাকে, এই পেরিক্লেসই সেসময়ে এথেন্সের সবচেয়ে চৌকষ গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন।

উপরের প্রসংগটি অবতারণা করার পেছনে বড় যুক্তি কি থাকতে পারে? বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের যে জোয়ার বইছে সেসময় ৪৬০ খৃষ্টপূর্বাব্দের প্রসংগ টেনে আনা অবান্তর নয়কি? এইতো কিছুদিন আগে লিবিয়ায় যে ঘটনা ঘটে গেলো তা কি সেখানকার লৌহমানব গাদ্দাফী অনুমান করতে পেরেছিলেন? কি ছিলো না লিবিয়াবাসীর। বিনা খরচে পড়াশোনা, চিকিত্সা ব্যয়, পড়শোনা শেষে চাকরির নিশ্চয়তা, চাকরি দিতে না পারলে মাসিক ভাতা। সবই ছিলো। কিন্তু এত সুখও লিবিয়াবাসীর সইলো না। আরব বসন্তের জোয়ারে এক হ্যাঁচকায় পড়ে গেলেন সেই লৌহমানব গাদ্দাফী। লিবিয়াবাসীর মনে যে বিষয়টি সবসময় নাড়া দিয়েছিলো তা হলো এতটুকু গণতন্ত্র, কথা বলার সামান্য স্বাধীনতা। পরের পরিস্থিতি কি হয়েছে তা হয়তো সবার জানা। যে গণতন্ত্রের জন্য সারা বিশ্বের দেশগুলোর অগণিত সৈনিক লড়াই করছে, রক্ত দিচ্ছে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে সে গণতন্ত্রকে কিভাবে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি?

আমাদের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই ভূমি নিজেদের করে নিতে আমরা কম রক্ত ঝরাইনি। কত প্রাণ অকাতরে ঢেলে দিয়ে আমরা এই সুমিষ্ট শব্দ গণতন্ত্রকে নিজের করতে পেরেছি তা কারো অজানা নয়। এথেন্স এর মতো সেরকম অতীতে না গেলেও যদি ব্রিটিশ আমলকে মূল্যায়নে নিয়ে আসি তবে দেখা যাবে, সেই সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতাদের আত্মবলিদান আমাদের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই উপমহাদেশের বাসিন্দাদের স্বাধীনতার স্বাদ দেখিয়েছিলেন কিন্তু রাজনীতিবিদরাই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা ভাসানীসহ অনেক রাজনীতিবিদ ব্রিটিশের করতল থেকে এ উপমহাদেশকে মুক্ত করতে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ভারতীয়দের বাপু মহাত্মা গান্ধী তার অহিংস আন্দোলন দিয়ে সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে 'একসাগর রক্তের বিনিময়ে' পাকিস্তানি শাসন থেকে পূর্ববাংলাকে আলাদা করতে হয়েছে আমাদের। পাকিস্তানের মিলিটারি জান্তা থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে বাংলার মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিকাংশ সময় যদি বেসামরিক সরকার থাকতো তাহলে হয়তো বাংলার ওপর এত বৈষম্য থাকতো না। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও যে এদেশে গণতন্ত্র মজবুত হয়েছে তা বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়ে এদেশের শাসন ব্যবস্থায় জেঁকে বসা সামরিক শাসন কিংবা সামরিক সরকারের আদলে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার এদেশ শাসন করেছে। দীর্ঘ সময়ে স্বৈরতন্ত্র চেপে থাকার কারণে আমাদের অনেকের মানসিকতায়ও কিছুটা বিকৃতি ঘটেছে বলে মনে হয়। যে বিশ্বে গণতন্ত্রই শেষ কথা সেখানে বিশ্ব পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে গণতন্ত্রকেও আমরা কেউ কেউ অবজ্ঞা করতে শিখেছি। হরহামেশা গণতন্ত্রের সাথে স্বৈরতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলছি। বলা হচ্ছে- সামরিক শাসকের চেয়ে গণতান্ত্রিক নেতারা খারাপ। হঠাত্ করে এ ধরনের কথার যারা অবতারণা করছেন তাদের উদ্দেশ্য কি- সে বিষয়ে আমরা হয়তো বিস্তারিত জানি না। কিন্তু জাতিকে যে বিষয়টি পীড়া দিচ্ছে তা হলো- গুটিকয়েক সুবিধাভোগী সমাজব্যবস্থার প্রশংসা করে দেয়া নানা বক্তৃতা। গত কয়েকদিন ধরে এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পেছনে নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য আছে। 

বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখনই কোন সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা বিভিন্ন খাত থেকে দক্ষ কিছু লোক নিয়ে সরকার চালিয়েছে। এদের প্রধান যোগ্যতা হলো বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে দেশে ফিরে আসা। টাই-এর নটটা যুত্সইভাবে বাঁধতে শেখা। সামরিক এবং বেসামরিক সরকারের মধ্যে পার্থক্যটা তাদের কাছে স্পষ্ট হলেও তারা তা বলতে চান না। 

সাম্প্রতিককালে দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের তুলনা করে একজন বিদগ্ধ শিক্ষক যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আমাদের সমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণীর চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। একটি সেমিনারে এমন বক্তব্য দেয়ার পর চারিদিকে সমালোচনার ঝড় উঠলে ওই শিক্ষক আত্মপক্ষ সমর্থন করতে মাঠে নেমেছেন। তিনি এখনো বলছেন, তার বক্তব্য ঠিক। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে-কেন হাসিনা এবং খালেদার চাইতে এরশাদ ভালো? একজন পতিত স্বৈরাচারের সাথে গণতান্ত্রিক দুটি শীর্ষ দলের নেত্রীকে মিলিয়ে দেখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা দেশবাসী গভীরভাবে বিবেচনা করবে। তবে একথা বলা যায় যে, সোনা এবং পিতল, রুপা এবং লোহায় যেমন মিলে না, তেল এবং পানি যেমন মিশে না তেমনি স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে তুলনা কিভাবে চলে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক দুর্বলতা থাকতে পারে, যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেন তারা ভালো প্রশাসক না হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে স্বৈরশাসকের সাথে দুজন গণতান্ত্রিক নেত্রীর তুলনা একটি সভ্যসমাজে কিভাবে আসতে পারে?

বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে নানা প্রতিকূলতাকে সামনে রেখে দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। কিন্তু এর মধ্যে যে সফলতাগুলো আছে তাকে খাটো করে দেখার সাহস আমাদের কিভাবে আসে? গত কয়েকটি সাধারণ নির্বাচনে মানুষ যে হারে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এমনকি শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এ হারে ভোট পড়েনি গত নির্বাচনে। এখানে একেবারে স্থানীয় সরকারের দোরগোড়া থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সংসদ সদস্য নির্বাচনেও মানুষ ভোটের দিনকে উত্সব মনে করে। নিজেদের কাজকর্ম বাদ দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে নিজের পছন্দে। নির্বাচন ব্যবস্থায় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ৪৯ হাজারেরও বেশি স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অন্তত এ নির্বাচন নিয়ে কোন পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়নি। এখানে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র রয়েছেন। যে এলাকার আড়াই হাজার লোক তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে একজনকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচন করেছেন সেই সদস্যকে অপমান করার মানেই হচ্ছে আড়াই হাজার ভোটারকে অপমান করা। 

অনেকে বলে থাকেন অমুক স্বৈরশাসক ভালো ছিলেন। অমুক স্বৈরশাসকের চেয়ে অমুক নেতানেত্রী ভালো নয়। তারা এটা কিসের বিচারে বলেন তা অনেকের কাছে বোধগম্য হয় না। কারণ যারা বলেন তারা কোন পরিসংখ্যানও দেন না, আবার শেষ পর্যন্ত তাদের কথাও ধরে রাখতে পারেন না। বলা যেতে পারে রাজনীতিকরা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করলেও প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে তারা দুর্বল। এটা মেনে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু যে পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক খাতে হয়েছে তা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। কাথায় বিপ্লব হয়নি বাংলাদেশের। শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ, নদী, অবকাঠামো, ব্যক্তিআয়, দক্ষ জনশক্তি সবদিক দিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এইতো ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের বাজেট ছিলো মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার বিদেশ থেকে ধার করতে হয়েছিলো ৩৭৫ কোটি টাকা। সে বাজেট ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলতি অর্থবছরে এক লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। আমাদের ১৯ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়, বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে ঊঁচু জায়গায় দেখছে বিশ্ববাসী। সে বিচারে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে খাটো করে দেখার দুঃসাহসের মধ্যে হয়তো অন্যকিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। 

তর্কের খাতিরে অনেক কথা বলা যায়। স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় থাকতে কিছু দৃষ্টিনন্দন কাজ করতে পারেন। কেননা তারা কাজ করেন গুটিকয়েক লোকের স্বার্থে এবং তাদের বিদেশি মনিবদের খুশি করার জন্য। কিন্তু নির্বাচিত নেতাদের কাজ করতে হয় দেশের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে। কেননা নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে তাদেরকে জনগণ তথা ভোটারদের কাছে ফিরে যেতে হয়। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেড়শটিরও বেশি দেশ স্বাধীন হয়েছে। বিদেশি শাসন শোষণের কারণে এসব দেশ গরীব এবং পশ্চাদপদ। সীমিত সম্পদ দিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রেখে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপরও বাংলাদেশের চার দশকের ইতিহাসে যে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বৃহত্ আকারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা নির্বাচিত রাজনীতিবিদদেরই অবদান। আমাদের সবার মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু এর ব্যত্যয় যেসব ব্যবস্থার কথা স্যুট-টাই ও খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তিরা বলে থাকেন তারা কোনদিন ভেবেছেন যে, তাদের চেয়ে গুণী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাও দেশ পরিচালনা করেছেন। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান এমনকি বাংলাদেশ হবার পরও অনেকে এরকম স্যুট-টাই পরে দেশ পরিচালনা করেছেন। তাদের পতনের পর দেশের সর্বক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য হয়েছে তার সাক্ষী হয়ে আছেন অনেকে। এ সব ব্যক্তি যে ব্যবস্থার কথা বলেন বা প্রকারান্তরে যে ব্যবস্থা সমর্থন করতে চান, তারা যে দু-একটি চোখ ধাঁধানো কার্যকলাপ করেন না তাও সত্য নয়। কিন্তু তাদের পতনের পর তার মূল্য দেশের মানুষকে দিতে হয়। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা বা নির্বাচিত প্রতিনিধির কোন বিকল্প আজো বের হয়নি। 

এ লেখা শেষ করা যাক একটি গল্প দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন, 'বুদ্ধিজীবীরা আমার বিরুদ্ধে কি লিখবে? আমি একটি দেশ এনে দিয়েছি। দেশের মানুষের জন্য আলাদা পরিচয়ের পাসপোর্ট দিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে হয়তো বুদ্ধিজীবীরা লিখবে আমি ভালো প্রশাসক নই। এটা তারা লিখুক।'

এই গল্প এই কারণে যে, স্বৈরাচার আর গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সবারই জানা আছে। যাদের জানা নেই তাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। রাজনীতিকদের পেছনে থাকে জনগণ। জনগণ ছাড়া তারা একেবারে অচল। আর স্বৈরাচারী সরকারের কাছে জনগণের প্রয়োজন হয় না। কারণ তাদের হয়ে গুটিকয়েক খেলোয়াড় মাঠে ফাউল খেলে।

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.