Friday, December 14, 2012

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পৃথিবীতে প্রাণের মহাবিলুপ্তি :: দৈনিক ইত্তেফাক


জলবায়ু
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও পৃথিবীতে প্রাণের মহাবিলুপ্তি
কাজী জিশান হাসান
বৈশ্বিক উষ্ণতা সাধারণত সাগরের উচ্চতা ও খরা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান এখানেই থেমে থাকেনি, বিজ্ঞান উদঘাটন করেছে বৈশ্বিক উষ্ণতার আরো ভয়াবহ ও ক্ষতিকারক দিকসমূহ যেগুলো সম্বন্ধে পূর্বে সকলে ছিল অজ্ঞাত, এই অভূতপূর্ব বিষয়গুলোই পিটার ডি ওয়াই এর 'Under a green sky: Global warming, the mass extinction of the past and what they can tell us about our future (২০০৬ সালে Harper Collins কর্তৃক প্রকাশিত)' বইয়ের মূল আলোচ্য। প্রফেসর ওয়ার্ড সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান এবং পৃথিবী ও মহাজাগতিক বিজ্ঞান বিভাগে এবং নাসাতে কর্মরত আছেন। তিনি একজন অন্যতম বিজ্ঞানী যার ফসিল সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীদেরকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাণের মহাবিলুপ্তির কারণ উদঘাটনে সহায়তা করেছে।

প্রাচীন মহাবিলুপ্তিগুলোর অন্যতম ছিল ডায়ানোসর-এর বিলুপ্তি, ত্রিশ বছর আগে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, এটি বিশাল উল্কাখণ্ডের আঘাতের দরুন সংঘটিত, সেই মহা আবিষ্কারের পর থেকে বহু বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, অন্যসব বিলুপ্তির কারণও অভিন্ন। যদিও ভূতাত্ত্বিকরা এর প্রমাণ পেতে ব্যর্থ হন, সঙ্গতকারণে ডায়ানোসর-এর বিলুপ্তি ছিল অদ্বিতীয় একটি ঘটনা এবং অন্যান্য বিলুপ্তির জন্য একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা জরুরি হয়ে পড়ে। শেষতক প্রমাণিত হয় যে বৈশ্বিক উষ্ণতায় সৃষ্ট অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডই এর জন্য দায়ী। দেখা যায় যে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড অগ্ন্যুত্পাতের ফলে নির্গত হয়, বিশেষ করে টেক্টোনিক প্লেটের নড়াচড়ায়, যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ইউরোশিয়ার সংঘর্ষ (যার ফলে হিমালয়ের সৃষ্টি)।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সৃষ্ট মহাবিলুপ্তির কার্যকারণগুলো ওয়ার্ড তার বইয়ে অনুসন্ধান করেছেন, পার্মিয়ান বিলুপ্তির ঘটনা তার একটি, যেটি ২৫ কোটি বছর আগে বিশ্বের ৯৫% প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটায়। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে এই বিলুপ্তির বড় কারণ প্রচুর পরিমাণ হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস, যা ছিল গন্ধযুক্ত ও বিষাক্ত, এবং যা পচা ডিম থেকে নির্গত হয়। এই গ্যাস অক্সিজেনমুক্ত ক্যানফিল্ড সাগরে (আবিষ্কারক-এর নামে) উত্পন্ন হয়; অনেকটা বর্তমানের কৃষ্ণ সাগরের অবস্থার সাথে মেলে। ক্যানফিল্ড সাগর তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতায় অতিরিক্ত মেরু বরফ নিঃসরণের ফলে। এই অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পানি নির্গমনের ফলে সমুদ্রের তড়িত্ প্রবাহ ( যা পানিকে গভীর থেকে গভীরতর জায়গায় প্রবাহিত করে এবং সমুদ্রকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে) বাধাগ্রস্ত হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সাগরের মাছ ও অন্যান্য প্রাণী অল্প অক্সিজেন খুব দ্রুত নিঃশেষ করে ফেলে এবং দমবন্ধ হয়ে যায়, এছাড়া অবশিষ্ট যে অক্সিজেনহীন পানি থাকে তাতে শুধুমাত্র বেগুনি রঙের এনোরোবিক ব্যাকটেরিয়া জীবন ধারণ করতে পারে। এরা বংশবৃদ্ধি করে গোটা সাগরকে বেগুনি করে তোলে। ঐসব ব্যাকটেরিয়া ক্যানফিল্ড সাগরে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উত্পাদন করে, যা মাটিতে প্রবাহিত হয় এবং প্রাণীকুলকে বিষাক্ত করে তোলে। একই সাথে ওজোন স্তরের ক্ষতি করে প্রাণী জগতকে ভয়ঙ্কর অতিবেগুনি রশ্মির সম্মুখীন করে (এই গ্যাস আকাশকে সবুজ করে তোলে, যেখান থেকে এই বইয়ের শিরোনাম উদ্ভূত), বলা যায় বৈশ্বিক উষ্ণতা যে বিপুল বিলুপ্তি ঘটায় সাগর ও স্থলে- তা মহাবিপর্যয়।

কিন্তু আর কত? আমরা জানি না যে আর কতখানি মেরুবরফ গলিত হলে একটি ক্যানফিল্ড সাগর তৈরি হবে এবং আরেকটি মহাবিলুপ্তি ঘটবে। কিন্তু আমরা যা জানি তা হলো, কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমনের হার হিসাব করে, যা প্রতি শতকে ১২০ পিপিএম - আমরা ধারণা করছি যে এটি ২১০০ সালে ৫০০ থেকে ৬০০ হবে, এটি প্রায় তার সমপরিমাণ যা বিগত ৪ কোটি বছর ধরে বিদ্যমান, অথবা বলা যায়, যখন মেরুসমূহে বরফ ছিল বা নামেমাত্র ছিল তখনকার সমান। (পৃষ্ঠা ১৬৪-৫)

অন্য কথায় ২১০০ সালে দুই বা তিন প্রজন্ম পর, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এমন হবে যার ফলে মেরু বরফের নিঃসরণ নিশ্চিত হবে, তৈরি হবে আরেকটি ক্যানফিল্ড সাগর এবং মানব জাতি হবে এক দুর্নিবার মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। 

এই মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো আমাদের জৈব জ্বালানি যেমন কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করা, বদলে আগামী কয়েক দশকের মাঝেই সেগুলোর স্থলে পারমাণবিক, বায়বীয় ও সৌরশক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, এটাই মেরু বরফ গলন এবং ক্যানফিল্ড সাগরের মাধ্যমে সম্ভাব্য মহাবিলুপ্তি এড়ানোর একমাত্র উপায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনীতিবদগণ এবং সেই সাথে জনগণ বৈজ্ঞানিকভাবে অসচেতন, জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে উদাসীন। যারা মানব সভ্যতাকে পরবর্তী শতাব্দীতে টিকিয়ে রাখতে চান তাদের উচিত বৈশ্বিক উষ্ণতার মত এই মহাবিপর্যয় রোধ এবং সমাধানে দৃপ্ত পদক্ষেপ নেয়া।

লেখক : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসের গ্রাজুয়েট

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.