Wednesday, August 29, 2012

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কিছু কথা - ড. মাহবুব উল্লাহ


 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রটির উদ্ভব ঘটেছে একটি জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জনগণের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী বহু ঘাত-প্রতিঘাত এবং রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ঐতিহাসিক নানা মাত্রার ঘটনা পরম্পরার তাত্পর্যে সৃষ্ট ও বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের আপামর মানুষ তাদের চেতনার মর্মে লালন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত চেতনা এবং ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের জীবনে বাস্তবায়ন দেখতে চায় স্বাধীনতার প্রায়োগিক ইতিবাচক ফলাফল, যার দ্বারা একদিকে দেশের অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অধিক শক্তিশালী ও অটুট হবে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে জনজীবনের মানোন্নয়ন ঘটানো হবে এবং সর্বোপরি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে ভিত্তি করে জাতীয় রাজনীতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করা হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব সমগ্র জাতির। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, কেননা, দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ একমাত্র দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ৯ মাসব্যাপী রক্তাক্ত সশস্ত্র সমরে অংশ নিয়েছে এবং লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণের এবং লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের জাতিরাষ্ট্র এই বাংলাদেশ। কাজেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়টি একদিকে যেমন জাতীয় আবেগের বিষয়, তেমনি জাতীয় সম্মিলনেরও বিষয়। সমগ্র জাতিকে সব ভেদাভেদ ও পার্থক্য ভুলে একদেহে লীন হয়ে যাবার চেতনা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা, কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র জাতি একটি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক অসাধ্য সাধন করে অর্জন করেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে এর ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে বিগত ৩৮ বছর যাবত্ স্থান করে নিয়েছে। আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখার স্বাধীনতা আমরা এখন পর্যন্ত অটুট রেখেছি নিঃসন্দেহে, যদিও আমাদের পরিসীমার তিন পাশের ভারত আমাদের ছিটমহল সমস্যার সমাধানে আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়ে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। ছিটমহল সংক্রান্ত ভারতের দাবি বাংলাদেশ বহু আগেই পূরণ করলেও ভারত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ছিটমহল সংক্রান্ত যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করেনি এবং পূরণ করার কোনো আলামতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৫৪টি অভিন্ন নদীর যৌথ পানি প্রবাহের অংশীদারিত্ব নিয়ে সমস্যা। ফারাক্কা চুক্তি অসম হওয়ায় ও এতে গলদ থাকায় বাংলাদেশ এর ন্যায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল খরার কারণে ও পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশীদের নিরন্তর অবাধে হত্যাযজ্ঞ, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা, সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের সমস্যা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সম্প্রতি বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভারতের স্বার্থে ও বাংলাদেশের স্বার্থপরিপন্থী ভারতের প্রতি নতজানু বৈদেশিক নীতি অনুসরণ। ফলে বিগত ৩৮ বছরের কর্মকাণ্ডে জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো জাতীয় উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি। এর ৩টি প্রধান কারণ দেশপ্রেমিক সচেতন মহলের কাছে পরিদৃশ্য।
প্রথমত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি এবং মতৈক্যের মেরুকরণ, যা রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় লক্ষণীয়ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ বিভ্রান্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সূচনাপর্ব নিয়ে মতানৈক্য এবং ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি ও চরিত্র বিশ্লেষণে ইতিহাস চেতনার ও ঐতিহাসিকতার অভাব। আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি খোঁজ করে ফিরছি, শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায় অভিষিক্তও করেছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের তথা ইতিহাসের পূর্ব বাংলার হাজার বছরের স্বাতন্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে আমাদের একটি বুদ্ধিজীবীমহল ও রাজনৈতিকমহল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সূচনাপর্ব বলে মনে করে। যদি তাই হয়, তাহলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সম্মান তো বাংলাদেশের মানুষ কাউকে দিতে পারে না এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি খোঁজার চেষ্টারও কোনো যুক্তি ও আবশ্যকতা থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি বড় বিভ্রান্তি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ইসলামী চেতনা এবং মুসলমানিত্বের বিরুদ্ধে প্রদীপ্ত করার দৃষ্টিভঙ্গিগত রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা। এর সূত্র ধরে আমাদের সংবিধানে ঢুকে পড়েছিল সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষও এই ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিরই ফসল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আরেকটি বিভ্রান্তিমূলক রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও কৃতিত্বকে দলীয়করণ করত সমগ্র জাতিকে এই চেতনা ও কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করে, একটি মহল কর্তৃক নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি নামে আখ্যায়িত করে বিগত ৩৮ বছর ধরে জাতি বিভক্তির রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডকে উত্সাহিত করা। জাতি বিভক্তির রাজনীতি যে আসলে জাতিকে দুর্বল করে এবং এর ফলে জাতির অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, এ বিবেচনা ও বোধ এতে স্থান পায়নি।
তৃতীয়ত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরেকটি বিভ্রান্তি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভ্রান্তি। ভারত উপমহাদেশের সামিল একটি দেশ। ১৯৪৭ সালের ভারতবিভক্তি ও পাকিস্তানের সৃষ্টি ভারতীয় রাজনীতিকরা কখনও মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি এবং ভারত এখনও সেই অবিভক্ত ভারতের পুনরেকত্রীকরণে বিশ্বাসী। ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোতে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিদৃশ্য হচ্ছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। কিন্তু ভারত এসব আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আখ্যায়িত করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এদের দমন করছে। সেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ যা ছিল পাকিস্তানের সরকারের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে কেন সহযোগিতা করেছিল, কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত অংশগ্রহণ করেছিল এর যথার্থ ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিভ্রান্তি আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে রয়েছে। এই মহলটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি না তাকিয়ে কেবল বাংলাদেশকে ভারতের প্রতি নতজানু রেখে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সদা আগ্রহী ও ব্যস্ত। আমাদের জাতীয় জীবনে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত উল্লেখিত এই বিভ্রান্তিগুলোর মোচন ব্যতীত আমরা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে না পারব আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালীভাবে নিশ্চিত করতে, না পারব স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন ঘটাতে কার্যকর করতে, না পারব গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এবং জাতীয় সংস্কৃতিকে স্বাতন্ত্রিকভাবে বিকশিত করতে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মহলটি নিজেদের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি বলে মনে করে তারাই এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। জাতির সামনে একটি সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল দিনবদলের ইশতেহার উপস্থাপন করে দেশের মানুষকে সোনার বাংলাদেশ (যদিও এই মহলটি সোনার বাংলা বলতেই অধিক অভ্যস্ত) উপহার দেয়ার স্বপ্নে বিভোর করে ক্ষমতায় এসেছে বলে দাবি করে। অথচ তাদের চৌদ্দ মাসের দেশ পরিচালনায় দিনবদলের কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারা দলকে দেশ মনে করে সর্বত্র দলীয়করণ করছে, যা ফ্যাসিবাদের রূপ পরিগ্রহ করার সমূহ সম্ভাবনা। ভারতের স্বার্থে দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এরা ভিন্ন দেশের বাঙালি সংস্কৃতিকে যার মধ্যে বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতির কোনো প্রতিফলন নেই, তাকে বাংলাদেশের বাঙালির সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উত্সাহিত করছে, মামলা-হামলা করে বিরোধী দলকে উচ্ছেদ করার মহোত্সবে মেতে উঠেছে, বাংলাদেশের হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, পুকুর, ডোবা, নালা, নর্দমা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, বিমানবন্দর সর্বত্র জাতীয় সম্পদকে দলের করায়ত্ত করার লক্ষ্যে দলীয় সন্ত্রাস কায়েম করেছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, লুটসহ কলেজের ছাত্রীদের সম্ভ্রমহানির রাজনীতিতে নিপতিত করে তারা এখন দৌরাত্ম্যের সঙ্গে দলীয় রাজত্ব কায়েমের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে। রাজনীতি ও ইতিহাসকে তারা এখন আইন আদালতের রায়ের কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার মসনদে থাকার কারণে তারা এই মুহূর্তে মনে করছে রাজনীতি ও ইতিহাসকে আদালতের রায়ের কাছে ইজারা দিয়ে তারা লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি কী হতে পারে সে বিষয়ে তাদের এ মুহূর্তে কোনো আন্দাজ নেই। আদালতের রায়ের মাধ্যমে তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক এই গণ্যতা তাদের লাভ করতে হয়েছে। তারা এখনও বুঝতে অক্ষম যে, শেখ মুজিব তার কর্ম ও নেতৃত্ব দ্বারা দলীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতায় উত্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা এই জাতীয় নেতাকে শুধু দলীয় নেতার মর্যাদাতেই টেনে নামাচ্ছে না, এই মহান নেতার স্মৃতিময় ব্যক্তিত্বে বিতর্কের ও অশালীনতার কালিমা লেপন করে চলেছে। জাতীয় সংসদ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এই জাতীয় সংসদ সরকারি দলের চণ্ড আচরণের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। জাতীয় দুই মহান ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ জিয়াউর রহমান এই চণ্ড আচরণের শিকার। এই দুই মহান নেতা যদি কবর থেকে সশরীরে উঠে আসতে পারতেন তাহলে হয়তো বলতেন—তোরা ক্ষান্ত হ, তোদের অসম্মান প্রদর্শনে আমরা ক্ষত-বিক্ষত, স্বাধীনতার জন্য তোরা যোগ্য নস, তোদের স্বাধীনতার কোনো প্রয়োজন নেই, পরাধীনতাই তোদের ভাগ্যলিপি, পরাধীনতাই তোদের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা...।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন। তারা একজন অন্যজনের প্রতিযোগী কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। একজন রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিকশিত হয়েছিলেন রাজনীতি করে ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে। অন্যজন রাজনীতিক ছিলেন না, কিন্তু দেশে সৃষ্ট ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দেশ ও দেশের মানুষের পক্ষে অসম সাহসিকতার সঙ্গে প্রবল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন বিধায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়ার জীবনে কেবলই সফলতা ছিল, ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতা ছিল না, একথা বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের সফলতা ব্যর্থতাকে ঢেকে দিয়েছে। দু’জনই জাতির কাছে এবং আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছেন। একজনকে অন্যজনের সঙ্গে তুল্য করার দৃষ্টিভঙ্গিটাই একটি বড় ভুল। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা খর্ব কিংবা খাটো হয়ে গেল এমন মনে করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জাগ্রত ও উদ্বেলিত না করলে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার দুর্লভ ওই ঐতিহাসিক সুযোগ পেতেন না, আবার মেজর জিয়া ওই সন্ধিক্ষণে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে জাতি ত্বরিতগতিতে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা পেত না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এখন আর কোনো দলের নন, সমগ্র জাতির। অথচ বিভ্রান্তি ও হীনতার কারণে আমরা এই দুই মহান ব্যক্তিকে বিতর্কিত করছি, তাদের স্মৃতি ও কর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি, ফলে দেশে জাতীয় ঐকমত্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জাতীয় বিভক্তিকে সম্প্রসারিত করছি।
এই দুই জাতীয় নেতাকে আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত দলীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার অসুস্থ ও অযৌক্তিক রাজনৈতিক কসরত্ থেকে নিবৃত্ত না হব ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের ইতিবাচক প্রভাব। জনজীবনে কার্যকর করা যাবে না। যখন যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম ও স্মৃতিকে, কেউই নাম বদল করে, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। আমাদের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই বোধোদয় না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের জীবনে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। দেশের কোনো উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হবে না। এই বোধোদয় সৃষ্টিতে সরকারি দলকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে, হিংসা ও বিদ্বেষকে পরিত্যাগ করতে হবে। সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদানকে স্বীকার করে নিয়ে সম্মান প্রদর্শনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সরকারি দলকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের মানুষের জীবনে স্বাধীনতা প্রাপ্তি অর্থবহ হয়ে উঠবে। আমাদের সবার মনে রাখা আবশ্যক যে, স্বাধীনতা অর্জন তখনই সার্থক হয় যদি তা রক্ষা করা যায়, নতুবা নয়।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু জাতীয় ব্যক্তিত্বের নাম ও অবদান। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবী, গীতিকার, সঙ্গীত শিল্পী, পেশাজীবী এবং দেশের সাধারণ জনগণ থেকে উঠে আসা অসাধারণ মানুষেরা। দেশের নাগরিকদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কার্যকর করতে হলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নবপ্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করতে হলে, এসব ব্যক্তিত্বের অবদানকেই প্রথমে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতি ও ইতিহাস চর্চায় তা ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনাকে অবশ্যই হতে হবে দলীয় রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের আবেগের প্রভাবমুক্ত। না হলে সেই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ ইতিহাস হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাদের সংশ্রব ও সম্পৃক্ততা ছিল, খুব স্বাভাবিক কারণেই এদের কলম দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচিত হবে না, কেননা যারা ইতিহাসে ঘটনা সৃষ্টি করেন তারা সেই ঘটনার নিরপেক্ষ ও সঠিক ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম নন। এটিই ইতিহাস রচনার শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচিত হবে আগামী প্রজন্মের ইতিহাস রচয়িতাদের হাতে, যারা ঘটনার পর্যবেক্ষণ ও তথ্যের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত লেখকরা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম যে যেভাবে দেখেছে, যেটি যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেগুলো তথ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করতে পারেন বটে, কিন্তু বিশ্লেষণে গেলেই নিরপেক্ষতা হারানোর সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর এ কারণেই আমরা আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিগত ৩৮ বছর তর্ক-বিতর্ক করছি, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছি, সঠিক ইতিহাসের নামে দলীয় কৃতিত্বের ইতিহাস রচনা করছি এবং এ প্রবণতার দ্বারা একদিকে জাতীয় নেতৃত্বের অবমাননা করছি ও জাতীয় ইতিহাসকে জাতির কাছ থেকে ছিনতাই করে দলের সম্পদ ও কৃতিত্ব রূপায়িত করতে চাচ্ছি।