Tuesday, October 16, 2012

দুর্নীতির রাজনীতি বাংলাদেশ বনাম বিশ্বব্যাংক বিতর্ক


দুর্নীতির রাজনীতি বাংলাদেশ বনাম বিশ্বব্যাংক বিতর্ক

লেখক: কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান  |  মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর ২০১২, ১ কার্তিক ১৪১৯
রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি প্রবৃত্তি এবং রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের রাজনৈতিক ব্যবহার রাজনীতির ইতিহাসের অত্যন্ত পুরাতন একটি বিষয়। গত শতাব্দীর শেষ অর্ধেক সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রধান রাস্তাই তৈরি হতো সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও তার প্রচারের মধ্যদিয়ে। তবে এখানে বলা হচ্ছে না যে, সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির এই অভিযোগ মিথ্যে ছিল। প্রকৃতপক্ষে, এই লেখার মাধ্যমে দুর্নীতির ‘সত্য-মিথ্যা’ উদঘাটন করা উদ্দেশ্য নয় বরং দুর্নীতির অভিযোগের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিশ্লেষণই উদ্দেশ্য। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপনের প্রাক্কালেও লর্ড ক্লাইভ গোষ্ঠী ও নবাববিরোধী দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও লাম্পট্যের অভিযোগ তুলেছিল এবং তা প্রচার করে জনমতকে উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে ছিল। গত শতাব্দীতে আলেন্দসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দেশপ্রেমিক সরকার প্রধানদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুর্নীতির অভিযোগে উত্থাপন করে এবং পরবর্তীতে উত্খাত করে। এ শতাব্দীতে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাশাপাশি গণহত্যা ও মানব বিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদের অভিযোগ  তোলা হয়েছে। গত শতাব্দীতে যারা ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. আহমদ সুকর্ণের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই জেনারেল সুহার্তো ক্ষমতায় আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সরকারের বিরুদ্ধেও সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ  তোলা হয়। গত দশকে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগের রাজনৈতিক ব্যবহার হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে উত্খাত হওয়া সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে এবং ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে দুর্নীতির মূলোত্পাটনের সংকল্প ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্ধারিত মেয়াদের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার যথার্থতা প্রমাণ করে ’৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর দুর্নীতি উত্খাতের নিমিত্তেই। অর্থাত্ গণতান্ত্রিক সরকারের সৃষ্ট দুর্নীতির বীজের মূলোত্পাটনেও সামরিক বাহিনীর পিঠে আরোহণ করা সরকারের আবশ্যকতা রয়েছে-এমন অগণতান্ত্রিক বক্তব্যও জনগণকে গিলতে হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ উঠেছে এবং তার অনেক প্রমাণও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও দুর্নীতির রাজনৈতিক ব্যবহার করে থাকে। পদ্মা সেতুর অর্থায়নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তি বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্নীতির রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে। শুরু হয় রাজনৈতিক বাদানুবাদের পালা। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিশ্বব্যাংকের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিশ্বব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদটিকেও বিতর্কিত করা হয় এবং অধ্যাপক ইউনূসকে এ পদে নিয়োগ দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আহবান জানান। ঐতিহ্য অনুসারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের থেকে এবং আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউরোপীয় নাগরিকদের থেকে নিয়োগ লাভ করে থাকেন। বিশ্বব্যাংকের সভাপতির পদ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি করায় এই প্রথম বিশ্বব্যাংকের সভাপতি নিয়োগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দিতে হয়। বিশ্বব্যাংকের ইমেজ রক্ষার্থে এ পদে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক জিম ইয়ং কিমকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের দু’টি দিক রয়েছে। একটি হলো বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ এবং অন্যটি হলো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অভিযোগ। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ হলো এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতু প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে এ প্রকল্পে সুপারভাইজিং কোম্পানির দায়িত্ব পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সাকোকে ঘুষের ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়োগের জন্য চাপ দেয়ার অভিযোগ  তোলা হয়। বিশ্বব্যাংক প্রথমে এই অভিযোগ এসএনসি লাভালিনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনা মালিকের যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি কোম্পানির নিকট থেকে ইমেইলের মাধ্যমে জানতে পারে। উল্লেখ্য যে, এ কোম্পানিটি এসএনসি লাভালিন যে কাজটি পেয়েছে সে কাজটি পাওয়ার জন্য দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে চায়। কিন্তু ভুয়া কাগজপত্রের অভিযোগে দরপত্র কমিটির প্রধান এ কোম্পানিটিকে অযোগ্য ঘোষণা করে। কানাডীয় পুলিশ লিবিয়া থেকে এসএনসি লাভালিন কর্তৃক পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়। এ প্রসঙ্গে এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো দু’জন প্রভাবশালী ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়। এরা হলেন আবুল হোসেন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অভিযোগ ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রে সেতু নির্মাণে কাজ করেছে বলে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চীনা মালিকের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে বিশ্বব্যাংক সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশের অভিযোগটি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তার অভিযোগ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই এগুতে থাকে। এক পর্যায়ে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ নমনীয় হয় এবং এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকে ফিরিয়ে আনার জন্য চারটি কঠিন শর্ত বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে চলে। এই পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ সরকারকে তার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সরকারের মর্যাদার সাথে আপোস করে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের কথায় প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, যোগাযোগ মন্ত্রী ও প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজারকে প্রকল্প থেকে বিদায় করতে হয়। বিশ্বব্যাংক এখানেই থেমে যায়নি। সে দুর্নীতির অভিযোগের সঠিক তদন্ত দাবি করে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত কাজ শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের ‘অভিযোগটি দালিলিকভাবে প্রমাণ হয়নি’ বলে দুদক দাবি করলে দুদকের তদন্ত কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও বিশ্বব্যাংক প্রশ্ন  তোলে। এ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলকে সুযোগ দেয়ার শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ আরো নমনীয় হয় এবং এই শর্তও মেনে নেয়। শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন  দুর্নীতির দমন কমিশনের কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক খেলা। এতদিন জাতিসংঘ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ ও  আইন-শৃঙ্খলার বিষয় দেখ-ভাল করার জন্য প্যানেল পাঠিয়েছে। এখন এক্ষেত্রে একধাপ অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন কমিশনের তদন্ত কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ করছে। এর ফলে, নব্য উপনিবেশবাদের জটিল জাল আরো বিস্তৃত হয়েছে এবং ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বের মর্যাদা আরো ম্লান হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও কঙ্গো ইত্যাদি দেশে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন গিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এসেছে বিশ্বব্যাংকের প্রথম দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ দল। সাবাস সবাইকে যারা এভাবে রাষ্ট্রের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে চান!
বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ ম্যাচ জমে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের প্যানেল অব ইনভেষ্টিগেটিভ-এর সদস্যরা এখন বাংলাদেশে। তদন্ত পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্যানেল দুদকের সাথে ১৪ ও ১৫ অক্টোবর সভা করেছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির সংজ্ঞা, দুর্নীতির আইন ও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের চরিত্র পরীক্ষা করছে। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ অনুসারে। এই আইন অনুসারে অপরাধ নির্ধারিত হবে ‘দি প্রিভেনশন অব করাপশন এ্যাক্ট, ১৯৪৭’-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ এবং ‘দি পেনাল কোড, ১৮৬০’-এর ১৬১-১৬৯, ২১৭, ২১৮, ৪০৮, ৪০৯ এবং ৪৭৭এ-এর অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধসমূহ এবং অনুচ্ছেদ (ক) হতে (গ) তে বর্ণিত অপরাধসমূহের সহিত সংশ্লিষ্ট বা সম্পৃক্ত ‘দি পেনাল কোড, ১৮৬০’-এর সেকশন ১০৯ এ বর্ণিত সহায়তাসহ অন্যান্য সহায়তা, সেকশন ১২০বি-এ বর্ণিত ষড়যন্ত্র এবং সেকশন ৫১১-এ বর্ণিত প্রচেষ্টার অপরাধসমূহের আলোকে। বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক তদন্ত বিতর্কের জায়গাটি হলো এই পেনাল কোড ১৮৬০-এর সেকশন ১২০বি-এর বর্ণিত ষড়যন্ত্রের  বিষয়টি। এতদিন পর্যন্ত দুদক বলে এসেছে বাংলাদেশের আইনে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র অপরাধ নয়। কিন্তু প্রথম বৈঠকেই স্বীকার করতে হয়েছে যে, সেকশন ১২০বি-এর আলোকে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রও অপরাধ। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। প্রথম বৈঠকেই দুদককে নিজের ফেলে দেয়া থুতু নিজেকেই গিলতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত পর্যবেক্ষণের এই পথ-পরিক্রমায় আরো কত কিছু হবে-তা কে জানে। প্রথম দিনেই বিশ্বব্যাংক দুদকের তদন্ত কার্যক্রমের স্বচ্ছতার বিষয়ে যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল তা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন এই প্যানেলের পর্যবেক্ষণ পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। তদন্ত পর্যবেক্ষণের প্রথম দিনে বিশ্বব্যাংকই জিতে গেল।
বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ ম্যাচে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক অভিসন্ধির আইনী বিচার কতটা সার্থকভাবে করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। বিশ্বব্যাংকের এই খেলায় অক্টোবর, ২০১২ থেকে যুক্ত হয়েছে আইএমএফ। ইসিএফ-এর অধীনে আইএমএফ ৩ (তিন) বছর মেয়াদে ৭ কিস্তিতে প্রদত্ত এক বিলিয়ন ডলারের সাহায্যের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারিকেও যুক্ত করে দিয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারকে দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধ করার কথা। প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, সে হলমার্ক ও ডেসটিনির নিকট থেকে সরকারের অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। ২য় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে সরকারের অর্থ উদ্ধারের এই বিষয়টি আইএমএফ-এর বোর্ডসভায় আলোচিত হবে। এটি বাংলাদেশের আকাশে একটি নতুন অশনি সংকেত। দুর্নীতি বিষয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এই একই পথচলা আমাদেরকে আতঙ্কিত করে। সরকারের কতিপয় দুষ্টু লোকের (মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ভাষায়) কারণে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সরকারের মর্যাদা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণের অধীন হয়ে যায়নি তো? এ প্রসঙ্গে ‘ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স-এর একটি নিবন্ধের উল্লেখ না করে পারছি না। স্টর্ম সি. থেকার ‘দি হাই পলিটিক্স অব আইএমএফ লেন্ডিং’ নামে একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে আইএমএফ-এর ঋণ রাজনীতির সাথে জড়িত। থেকার দেখিয়েছেন যে, কীভাবে আইএমএফ ঋণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের পুরস্কৃত করেছে এবং ঋণ না দিয়ে বা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের শায়েস্তা করেছে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আইএমএফ সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে হাঙ্গেরী, যুগোশ্লাভিয়া এবং রোমানিয়াকে শুধুমাত্র সোভিয়েত ব্লক থেকে পৃথক করার জন্য। এক সময়ের জোট নিরপেক্ষ নেতা আর্জেন্টিনাকে দলে ভিড়াতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইএমএফ-এর ঋণ বণ্টনের রাজনৈতিক ব্যবহার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য যে, যে ভোটাভুটির মাধ্যমে কোন প্রজেক্টে অর্থ বরাদ্দ হয় সে ভোটাভুটিতে ১৭.৮৩% ভোট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ ঋণ প্রদানের যে কোনো সিদ্ধান্ত পাস করতে হলে ভোট প্রয়োজন ৮৫%। একইভাবে, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নকারী বিশ্বব্যাংকের ঋণ বণ্টনের বিষয়ে রাজনীতির অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭০-৭৩ সময়ে চিলির আলেন্দ সরকারকে এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ঋণ প্রদান স্থগিত করার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্র্বের ট্রেজারি বিভাগের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে নিকারাগুয়াকে এবং ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে ইরানকে ঋণ প্রদান করেনি এই প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক বিবেচনায়। অধ্যাপক ইউনূস ইস্যু, বিশ্বব্যাংকের সংস্কার ও পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থানের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক নাখোশ। দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ সরকারের এই সম্পর্ক তদন্ত পর্যবেক্ষণকে প্রভাবিত করে কিনা?
সবশেষে বলতে চাই যে, বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ ম্যাচে সংশ্লিষ্ট হয়েছে আইএমএফ। ১৯৯৭ সাল থেকেই ‘সুশাসন’ ও ‘সংস্কারের উপদেশ’ নামে অনুদানের রাজনীতির খোলসে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ম্যাকিয়াভেলির ‘ধূর্ত’ নীতির যে প্রয়োগ এই দুই প্রতিষ্ঠান করেছে সে ধূর্ততা যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পেয়ে বসে তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক বিশ্বব্যাংকের অতিথিদের এই ‘আপ্যায়ন-আপ্যায়ন’ খেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হরণ করার ক্ষেত্রে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হবে। এই ‘আপ্যায়ন-আপ্যায়ন’ খেলার শেষ পরিণতি যদি এমন হয় যে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে তার আগের বক্তব্য ‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়নি’ প্রত্যাহার করতে হয় এবং সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীকে সরকারপ্রধান যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন সেটা কেড়ে নেয়া হয় তখনি দুর্নীতির রাজনৈতিক ব্যবহার চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে। অন্যদিকে, এমন না হয়ে যদি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে বিশ্বব্যাপী প্রকল্পগুলোতে বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে আসছে তা মানুষের নিকট হাস্যকর হবে। তাছাড়া, একটি স্বাধীন দেশের মন্ত্রী মহোদয়কে অনুদান প্রদানের নামে পদত্যাগে বাধ্য করায় বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের নিকট দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। তাই বলতে হয় ম্যাচ ড্র হবে না। গোল কাউকে দিতেই হবে। বাংলাদেশ বা বিশ্বব্যাংক কেউই তাদের অভিযোগ পুনরায় গিলতে পারবে না। দেখা যাক, কে জিতে? বাংলাদেশের জয় হোক-এই প্রত্যাশা রইলো।
n লেখক :শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রেটন ওড্স প্রতিষ্ঠান বিষয়ক গবেষক

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.