Thursday, December 13, 2012

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য ও সুশাসন :: দৈনিক ইত্তেফাক


সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য ও সুশাসন
সম্প্রতি ঢাকায় একটি আঞ্চলিক (দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর) সম্মেলন সমাপ্ত হইয়াছে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়া। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্জিত সাফল্য ব্যাখ্যার পাশাপাশি ব্যর্থতাগুলির পর্যালোচনা করা এবং ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলিকে চিহ্নিত করিয়া তাহা সমাধানে করণীয় নির্ধারণ করা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সফলতা ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম হইবে তাহাই স্বাভাবিক। কারণ প্রত্যেকটা দেশ তাহার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমিত সম্পদ দিয়া ঐ লক্ষ্যসমূহ পূরণের চেষ্টা করিতেছে। তবে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার মধ্য হইতে কিছু সমস্যা বাহির হইয়াছে যাহা মোটামুটিভাবে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাহার উল্লেখযোগ্য একটি হইলো সুশাসনের অভাব। ফলে ২০১৫ সালের পর যখন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘোষণা আসিবে বলিয়া তখন যেন তাহার মধ্যে সুশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া দিকনির্দেশনা আসে সেই ব্যাপারে এই সম্মেলনে জোর দেওয়া হয়।

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের প্রথমটি ছিল দারিদ্র্য ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামাইয়া নিয়া আসা। বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেকটাই আগাইয়া। ২০১০ সালের জরিপে দারিদ্র্য ৩১.৫ শতাংশ নামিয়া আসিবে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। অতিদারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা গিয়াছে। তবে এই উন্নতি ধরিয়া রাখিতে হইলে অর্থাত্ দারিদ্র্য ক্রমাগত কমাইয়া আনিতে হইলে আমাদেরকে সুশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সরকারি সম্পদের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য জলবায়ু তহবিলের টাকার সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হইতে উপকূলীয় এলাকাগুলিতে নূতন করিয়া জন্ম লইতেছে দারিদ্র্য । ফলে একদিকে দারিদ্র্য কমিলেও অন্যদিকে প্রকৃতির বৈরি প্রভাবে দারিদ্র্য বাড়িলে লক্ষ্যে পৌঁছা খুবই কঠিন হইবে। ফলে দারিদ্য বিমোচনের নিমিত্ত যত সম্পদ বরাদ্দ দেওয়া হইবে তাহার সঠিক ব্যবহার হইলে দারিদ্র্য ক্রমাগত কমিতেই থাকিবে। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশি-বিদেশি সম্পদ গরিব জনসাধারণের স্বার্থে ব্যবহার হইবে কিনা তাহা নির্ভর করিবে সুশাসনের উপর।

সুশাসন হইলো একটি দেশের সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি কি প্রক্রিয়ায় নীতি নির্ধারণ করে এবং কিভাবে সরকারি সম্পদের সদ্ব্যবহার করিয়া জনকল্যাণ নিশ্চিত করে তাহার সমন্বিত রূপ। যখন সুশাসন থাকে না তখন সরকারি সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি দেশের স্বার্থ পরিপন্থি নীতি নির্ধারণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সুশাসনের অভাব ঘটিলে কোন একটা দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাইভেট খাতের জন্য যে সহযোগিতার দরকার হয় তাহার অভাব থাকে। মনে রাখিতে হইবে প্রাইভেট খাত কর্মসংস্থানের সিংহভাগ করিয়া থাকে। এই খাতের প্রয়োজনীয় প্রবৃদ্ধি না হইলে অর্থসংস্থান কমিয়া গিয়া বেকারত্ব বাড়িতে থাকিবে। আর বেকারত্ব বাড়া মানে দারিদ্র্য বাড়িয়া যাওয়া। ফলে সুশাসন থাকিলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাইয়া সরকারি সম্পদ যেমন দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখিবে, তেমনিভাবে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়িবে, অন্যদিকে সরকারি পর্যায়ে সুশাসন থাকিলে বেসরকারি পর্যায়েও সুশাসন আসিবে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে বেসরকারি পর্যায়েও সুশাসন দরকার। আজকে যে শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হইলো, সেই শ্রমিক উত্পাদনে অংশগ্রহণে নির্যাতনের শিকার হইতেছে কিনা তাহা দারিদ্র্য বিমোচনে প্রভাব ফেলিবে।

তবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সুশাসন নয়, আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলিত রহিয়া গিয়াছে। যেমন-জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা, কাঠামোগত পরিবর্তন, উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক পর্যায়ে দামের অস্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক মন্দা ইত্যাদি বিষয় ঐ লক্ষ্যে সরাসরিভাবে আসেনি। তাহার পাশাপাশি লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য উন্নত দেশগুলির যে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল তাহাও পুরোপুরি পাওয়া যায় নাই। ফলে এই সীমাবদ্ধতাগুলি বিবেচনায় নিয়া ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ স্থির করা হইবে তাহাই প্রত্যাশিত।

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.