Thursday, December 13, 2012

দোহার দিকে তাকিয়ে বিশ্ব :: দৈনিক ইত্তেফাক


জলবায়ু সম্মেলন-২০১২
দোহার দিকে তাকিয়ে বিশ্ব
সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাস
খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। এর প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করেছে প্রায় সর্বত্রই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও সমস্যা মোকাবিলায় জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করে আসছে বিশ্ব সম্মেলন। এরই অংশ হিসেবে এবার কাতারের রাজধানী দোহায় সম্মেলন শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের ১৮তম এবং এর কনফারেন্স অব পার্টির অষ্টম অধিবেশন শুরু হয়েছে গত ২৫ নভেম্বরে, চলবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে আয়োজিত এ অধিবেশনে বিশ্বের ২০০টি দেশের প্রায় ১৭ হাজার প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। ধনী ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কার্বন নিঃসরণ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও প্রতিনিধিরা জলবায়ু বিষয়ে নতুন একটি সমঝোতায় পৌঁছাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

কনফারেন্স অব পার্টির (কপ) বর্তমান সভাপতি ও দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইতি নাওয়ানা-মাসাবানের আনুষ্ঠানিকভাবে সভাপতির দায়িত্ব কাতারের উপপ্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন হামিদ আল-আতিয়ার কাছে হস্তান্তর করেছেন। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অধিবেশনের সূচনা হয়।

কপের নতুন সভাপতি আতিয়া অধিবেশনের শুরুতে বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, সে সম্পর্কে আমরা সচেতন।' তিনি বলেন, 'আমরা আশা করি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা আরও সুস্পষ্ট হবে।'

গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

কার্বন-নির্গমন কমানোর একমাত্র আইনগত চুক্তি কিয়োটো প্রোটোকলের দ্বিতীয় দফা মেয়াদবৃদ্ধির ইস্যুটিই এখন পর্যপ্ত সম্মেলনের বার্নিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক সমস্যায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কিয়োটো প্রটোকলের প্রথম পর্যায়ে যেটি আগামী ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে, সেটির দ্বিতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছে ইইউ। পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দিক থেকে। কয়েক দিন আগে তারাও তাদের দায়িত্ব পালনের কথা মেনে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো অবস্থান পরিবর্তন করেনি। পিছু হটছে জাপান, রাশিয়া ও কানাডা। কিয়োটো প্রটোকলে উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা অনুন্নত বিশ্বের কোনো দায় অর্পিত হয়নি। সেই সুযোগে বর্তমানে প্রধান দূষণকারী দেশ চীন ও ভারত প্রশমনের ক্ষেত্রে কোনো দায় নিচ্ছে না। জাপান ও রাশিয়া এ বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে সরে যাচ্ছে। আগামী জানুয়ারি থেকে কিয়োটো প্রোটোকলের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হবে। কিছু দেশ না এলেও ৩২ থেকে ৩৫টি দেশ কার্বন-নির্গমন কমানোর এ চুক্তিতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিয়োটো প্রোটোকলের মেয়াদবৃদ্ধি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেলেও আসলে মেয়াদ কতটা বাড়বে সেটা নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাইছে—মেয়াদ আট বছর বাড়াতে। এতে ২০২০ সালে নতুন আইনগত চুক্তি কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যপ্ত তা বহাল থাকতে। গত ডারবান সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো কিয়োটোর মেয়াদ ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন জলবায়ু আলোচনার মূল নিয়ামক ইউরোপীয় ইউনিয়ন তা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করতে চাইছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একমত হলেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ চাইছে কিয়োটোর মেয়াদ অতিরিক্ত তিন বছর বাড়ানোর সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর কার্বন-নির্গমন হরাসের প্রতিশ্রুতিও বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলো ২০১৭ সাল পর্যপ্ত কিয়োটোর দ্বিতীয় মেয়াদে কার্বন নির্গমন ২০ শতাংশ হারে কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ দাবি তুলেছে ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যপ্ত উন্নত দেশগুলোকে ২৫ শতাংশ হারে কার্বন-নির্গমন কমানোর হার ঘোষণা দিতে হবে। তা না হলে পৃথিবীর উষ্ণায়ন বন্ধ করা যাবে না। তবে ডারবানে সিদ্ধান্ত হয়েছে—২০১৭ সালের মধ্যে একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণীত হবে এবং এটি ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে দায়ভার পৃথিবীর সব দেশের ওপর বর্তাবে। তাহলে কি ২০২০ পর্যপ্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের উত্পাদন বাড়তেই থাকবে? দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কাছে কোনো ইতিবাচক অবস্থান আশা করা যাবে? সম্ভবত না। কারণ, চটজলদি তাদের পক্ষে অবস্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়। 

ডারবান জলবায়ু আলোচনায় কৃষি ও জলবায়ু উদ্বাস্তু ইস্যু দুটি বাদ পড়ে গিয়েছিল। দোহা সম্মেলনের আলোচনায় এ দুটি ইস্যু আবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে পানির ইস্যুটিও আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে।

ইতিহাস থেকে

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে যে পরিবর্তন আসছে, সে বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা আইন তৈরি হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তখনো বিজ্ঞানীদের মনে কিছুটা দ্বিধা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা নিয়ে। তবু সতর্কতামূলক নীতির অধীনে দুটি ধারা সংযোজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে কাজকর্ম শুরু হয়। এর একটি ধারা হচ্ছে আইপিসিসি ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে আইপিসিসির প্রতিবেদন প্রণীত হয়। পাঁচ-সাত বছর পরপর। চতুর্থ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে ২০০৭ সালে। মনুষ্যসৃষ্ট কয়েকটি গ্যাস উদ্গিরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই যে এ ঘটনা, ওই প্রতিবেদনে তা নিশ্চিত করা হয়।

২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি হতে থাকে। দ্রুত শব্দটা অনেকের অপছন্দ হতে পারে। কারণ, অনুন্নত বিশ্বের কাছে মনে হচ্ছে যে, এ বিষয়ে অগ্রগতি খুবই ধীরমাত্রা। কিন্তু মনে রাখতে হবে—বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৫টি দেশ জড়িত এবং এই আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। আইপিসিসির পরের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে ২০১৪ সালে। আমাদের আশঙ্কা—পৃথিবী যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ পঞ্চম প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রণীত দ্বিতীয় ধারাটি রাজনৈতিক। ইউএনএফসিসিসি এই ধারাটির বাহক। এর অধীনে আবার প্রথমে দুই ধরনের আলোচনা শুরু হয়। একটি হচ্ছে মিটিগেশন বা প্রশমন অর্থাত্ যে কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। অপরটি হচ্ছে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন। অর্থাত্ যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, তা মোকাবিলার পদ্ধতি।

প্রথমে নজর দেওয়া হয় মিটিগেশনের দিকে। এ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয় কিয়োটো প্রটোকল। ওই প্রটোকলের মধ্য দিয়ে উন্নত বিশ্বের ওপর দায়িত্ব বর্তায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে যায় তাদের দায়িত্ব থেকে। তারা কিয়োটো প্রটোকলে অংশ নেয়নি। আরও কয়েকটি উন্নত দেশ গড়িমসি শুরু করে।

তবে ২০০৭ সালে আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশের পর জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় নতুন জোয়ার আসে। এই ধারাতে ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুন, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বৈশ্বিক পর্যায়ে সম্মেলন হয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ২০১২ সালের সম্মেলন, কাতারের রাজধানী দোহায়।

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.