Monday, March 31, 2014

শিক্ষায় বিভিন্ন ভাষা মাধ্যম :বিপর্যয় না সমৃদ্ধি :: দৈনিক ইত্তেফাক (ফজলুল আলম)

ফেব্রুয়ারি মাস চলে গেলেও ভাষা নিয়ে আলোচনা বহমান থাকা উচিত বলে আমি মনে করি ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ঐতিহাসিকতা পর্যালোচনা ছাড়াও আজকাল বিত্তবান সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা বাংলা লেখায় কথায় ইংরেজি শব্দের আগ্রাসন নিয়ে বেশ হাহাকার বিলাপ শোনা যায় কৃতবিদ্য আহমদ রফিক সম্ভবত অভিমানভরেই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকট শ্রেণী বিভাজনের কথা স্মরণ করে বললেন- উচ্চবিত্তদের সন্তানদের শিক্ষায় একটা 'ইংলিশ ভার্সন' থাকে থাকুক অপরদিকে 'বাংলা থাকুক তার বুলিতে, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় বিপুলসংখ্যক অশিক্ষিত বাঙালির জৈবনিক ভাষা হিসেবে' এভাবে সমস্যার সমাধান করে লেখক একটি 'আন্তর্জাতিক চেতনার বাঙালি' আশা প্রকাশ করলেন তাঁর বক্তব্য থেকে কয়েকটা পার্শ্বচিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে একটা হলো ইউরোপে গ্রামার স্কুল ( অনেক পাবলিক স্কুল নামে পরিচিত বেসরকারি স্কুল) সরকারি বিদ্যালয়ের বিভাজন গ্রামার পাবলিক স্কুল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তুখোড় ছাত্রছাত্রীরা 'ব্যুরোক্রেসী' 'ফরেন সার্ভিসে' যোগ দেয় অন্যান্য স্কুল থেকে বাধ্যতামূলক ষোলো বছর বয়সের পরে প্রায় ৬৫ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্র ত্যাগ করে বিলাতের সমাজ এই শিক্ষা বিন্যাসের ফলে প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যায়সেখানে শিক্ষার সংস্কৃতিতে সমাজের বিভাজন বজায় থাকে আমাদের দেশে শিক্ষা তিন মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে: ইংরেজি, বাংলা আরবি এতেও এক ধরনের সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হয় আকাশ সংস্কৃতি থেকে প্রাপ্ত ভিন্ন ভাষার কথা এখানে আর উঠালাম না স্বাভাবিকভাবেই এসবে একটি মিশ্র ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক বিভাজন আমাদের দেশে বিকশিত হচ্ছে খুব সুখপ্রদ না হলেও এটাই বাস্তব অবস্থা


আমাদের ভাষা ব্যবহারে দ্বিতীয় একটি বিব্রতকর বাস্তবতা হলো বাংলা বচনে ইংরেজি শব্দের ও কখনো কখনো বাক্যের ব্যবহার। এর জন্য আমি পুরোপুরি 'ইংলিশ মিডিয়াম' শিক্ষাকে দায়ী করি না। আমি নিজেও লজ্জিত যে ভাষা আন্দোলনের দিন একটি চ্যানেলের টক-শো'তে আমি নিজে 'ট্যাক্ল' শব্দটি ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। একবার একঝলক বাংলা শব্দ 'মোকাবেলা' বা 'বাগে আনা' বলব বলতে গিয়ে ভেবেছিলাম যে ওই দুটো বাংলা শব্দের কোনোটাতেই আমার ধারণা পরিষ্কার হবে না। এটা আমার ও অনেকের ভাষাচর্চার দুর্বল দিক তুলে ধরে। তবে দুর্বল দিক তুলে ধরলেও সেটাকে আমি অপরাধ মনে করি না। ভাব প্রকাশের জন্য যথাশব্দ যে কোনো ভাষা থেকে টেনে আনার অধিকার সব ভাষাভাষি নরনারীর আছে এবং সেটা করলে নিজের ভাষাকে অসম্মান করা হয় না। এর পিঠে বলা যায় একজন ইংরেজ ব্যক্তিকে আমি করুণা করি কারণ সে আমার মতো নিজ ভাষায় যথাশব্দ খুঁজে না পেয়ে শুধু 'আই মীন আই মীন' বলে খাবি খাবে, আমার মতো অন্য ভাষা থেকে শব্দ আনতে পারবে না, কারণ সে অন্য ভাষা জানেই না। ঔপনিবেশিকতার কারণেই হোক বা বর্তমানে আন্তর্জাতিকতার উদ্দেশ্যেই হোক, অন্য একটা ভাষা জানা থাকলে ও প্রয়োজনে সাবলীলভাবে ব্যবহার করতে পারলে কোনো ক্ষতি নেই—এটাকে অর্জন বললে ক্ষতি কী?

আমাদের সংস্কৃতিতে নেই তেমন কিছু ভাবপ্রকাশে আমরা ইংরেজি শব্দ বাধ্য হয়ে ব্যবহার করছি, যেমন প্লিজ, থ্যাংক ইউ (ও প্রত্যুত্তরে ওয়েলকাম), বাই, সি ইউ। আমাদের সংস্কৃতিতে কথায় কথায় ধন্যবাদ দিতে হয় না। হাস্যকর হলেও এটা সত্যি যে বিলাতে একটা সামান্য কিছু কিনতে বেশ কয়েকবার প্লিজ থ্যাংকু ও ওয়েলকাম বলা স্বাভাবিক। বাংলায় প্লিজের বদলে 'অনুগ্রহ করে' বললে বিসদৃশ শোনাবে। কিন্তু আমাদের ভাষার কেরামতিতে ও আমাদের অভিব্যক্তিতে বিনয় এমনিতেই প্রকাশ হয়। থ্যাংকুর বদলে আমরা ধন্যবাদ বলি না, আমরা স্মিত হেসে সেটার স্বীকৃতি দেই। তবে বাংলাভাষায় যত শব্দ আছে তার সবই কথায় ব্যবহূত হয় না। না হওয়ার কারণ অনেক হতে পারে, তবে প্রধান কারণ হচ্ছে চলতি ভাষায় কিছু শব্দের প্রয়োজন হয় না, এবং সাধু (বিশেষত লিখিত) ভাষাতেও অনেক শব্দের চর্চা হয় না। আবার এমনও হতে পারে যে অতি জটিল বিষয় আলোচনা করতে গেলে যেসব শব্দের প্রয়োজন হয় সেসব সর্বদা চর্চিত হয় না। ইংরেজি অনেক শব্দের চর্চা অত্যন্ত সীমিত। বাংলাভাষায় অনুরূপ অনেক শব্দ আছে যেসবের চর্চা হয় না। সেটা ভাষিক সমস্যা। তবে মজার কথা 'মেরুকরণ' শব্দটা আমাদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গেছে সহজেই, এর বদলে ইংরেজি পোলারাইজেশন আমরা ব্যবহার করি না, অপরদিকে 'চ্যালেঞ্জ' প্রায় সর্বত্র গৃহীত। আমরা অনেক ভাব প্রকাশে সহজ ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি একমাত্র সংস্কৃতিগত পার্থক্যের জন্য, এবং তাতে সংস্কৃতির পার্থক্য স্বীকার করা হয়। এই পার্থক্য স্বীকারের মধ্যদিয়ে আমরা ধরে নিতে পারি যে 'ইংলিশ ভার্সন' বিপর্যয় মনে হতে পারে, কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আগামীতে আমাদের ভাষা এভাবেই অন্য ভাষা চর্চায় সমৃদ্ধি অর্জন করবে, যেমন আমি এখনো খুঁজছি 'ট্যাকল' শব্দটার যথাযথ বাংলা কী হবে।

বিদেশি ভাষার আগ্রাসনকে সমৃদ্ধি ভেবে নিলে এমনও বলা যায় যে তিনটি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে আমাদের জাতীয় জীবন সমৃদ্ধ হতে পারে। তবে শর্ত থাকতে হবে এই তিনটি মাধ্যম একে অপরের সম্পূরক হতে হবে, একে অপর থেকে ভিন্ন বলয়ে থাকলেই বিপর্যয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপর্যয়ই হচ্ছে, কারণ তিনটি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্দেশ্য সামজিক বিভাজন বজায় রাখা—বিত্তবান, স্বল্পবিত্ত ও বিত্তহীনতার ভিত্তিতে শিক্ষার আয়োজন সমৃদ্ধি আনবে না। এর ফলে দেশে যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি হয় সেটা কি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত?

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতি গবেষক

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.