Wednesday, October 17, 2012

শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ



লেখক: হায়দার আহমদ খান  বুধবার, ১৭ অক্টোবর ২০১২, ২ কার্তিক ১৪১৯

মা নবসম্পদ উন্নয়ন নির্ভর করে সমাজের সার্বিক পরিকল্পনা, তার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সমাজে সুশাসনের উপর। সমাজ উন্নয়ন একদিনে সম্ভব নয়; কিন্তু প্রতিদিনের কার্যকলাপের প্রভাব পড়ে উন্নয়নের উপর। মানুষ জন্মসূত্রে শিক্ষিত হয় না। তবে জন্মসূত্রে জ্ঞানী এবং সম্পদশালী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সমাজপতিদের চিন্তা-চেতনা, যোগ্যতা-ক্ষমতা, সততার উপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সমাজের মানুষের জীবনযাত্রা। সমাজের বেশ কিছু কাজ আছে যা ব্যক্তি পর্যায়ে সম্ভব নয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রাইমারি শিক্ষা। অবশ্য উন্নত বিশ্বে তার ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে। যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশ, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা, গরিবের সংখ্যা, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সমসাময়িক সময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন অন্য দেশের মানুষের জীবনমান তুলনায় বড় কষ্ট পেতে হয়, লজ্জা পেতে হয়। জাতীয় উন্নয়নের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় বহির্বিশ্বের বন্ধুদের সাহায্যের উপর। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে অর্থ আসবে এবং তা ব্যবস্থাপনার জন্য মানবসম্পদও আসবে এমন চিন্তা করতে হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪১ বছর পরেও।
আমার এই আলোচনার সূচনায় একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাই। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের যোগ্যতা এবং ক্ষমতা নিয়ে, যাদের উপর অর্থাত্ আমাদের মানবসম্পদের উপর নির্ভর করছে সমাজের সার্বিক উন্নতি। পেশাগত কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটি অংশের সাথে আমি জড়িত। ফলে তাদের চাকরি বাজারের খবর আমার কাছে থাকে। মানসম্মত শিক্ষার সমস্যার সাথে বাংলাদেশের ৮৭,৩৭২টি গ্রামের মধ্যে আজ পর্যন্ত  ১৫০০ গ্রামে কোন প্রাইমারি স্কুল নেই। বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রাথমিক এবং গণশিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় দেশের ৪৭ ভাগ মানুষ এখনও নিরক্ষর। বাংলাদেশের বর্তমান ১৬ কোটি মানুষের উন্নয়ন ছাড়া সার্বিক উন্নতি অসম্ভব। আমাদের অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বর্তমানে আমাদের শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। অবশ্য শহর এলাকার মায়েরা যে কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করেন তাদের সন্তানের জন্য সে তুলনায় আমার মনে হয় শহরকেন্দ্রিক ছেলেমেয়েদের ফলাফল আরও ভালো হওয়া উচিত। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস হয় বছরে ২৩৮ দিন; কিন্তু ক্লাসের শ্রমঘণ্টার অপচয় কত হয় তা মনে হয় আমরা সবাই জানি। ক্লাসের শ্রমঘণ্টার শতভাগ ব্যবহার ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানদানের আর কোন সহজ পন্থা আছে কিনা আমার জানা নেই। আমার মূল আলোচনায় ফিরে যাই।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকারের একতরফা সম্পৃক্ততা অনেক কমেছে। সরকারের কাজ দেশের আইন-শৃঙ্খলা এবং বিচার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতের দায়িত্বও সরকারের। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব। মনে রাখতে হবে অশিক্ষা এবং দরিদ্রতা জমজ দুই ভাই। দুইজনকেই একসাথে মানুষ করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় শিক্ষিত এবং ধনীর সন্তানের জন্য শিক্ষা অর্জন মোটামুটি সহজ। তার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার তেমন প্রয়োজন হয় না। সরকারের অযোগ্যতার জন্যই হোক বা সময়ের পরিবর্তনেই হোক এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল দেশেই সকল উন্নয়ন কাজ এখন করছে ব্যবসায়ীরা। কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারও করছে, তবে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই। যেমন বাংলাদেশের যমুনা সেতুর টোল আদায় করে তার বাণিজ্যিক সার্থকতা প্রমাণ করছে। অবশ্য জনগণও এই দৃষ্টিকোণকে সহজভাবেই নিচ্ছে সারাবিশ্বে। কারণ জনগণও চায় মানসম্মত সেবা এবং তার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সুবিধা।
১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এই দেশ হতে পারে বিনিয়োগের জন্য বিশ্বে প্রধান স্থান। কারণ ব্যবসার প্রধান লক্ষ্য থাকে ক্রেতার কাছে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্য পৌঁছানো। বর্তমানের ১৬ কোটি মানুষকে আমরা যদি উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী এবং কর্মক্ষম করতে পারি তাহলে তারাই হবে ক্রেতাদের একটি অংশ এবং তারাই হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের চালিকাশক্তি। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য যাই বলি না কেন সব কিছুর জন্য প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। দক্ষ, কর্মক্ষম মানবসম্পদের অভাবে সমাজে শুধু দরিদ্র লোকের সংখ্যাই বৃদ্ধি পায় না, বরং শিল্প বাণিজ্য পরিচালনাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী দেশি হোক বা বিদেশি হোক তার প্রথম এবং প্রধান বিবেচ্য বিষয় উক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনের জন্য উপযুক্ত মানবসম্পদ পাওয়ার নিশ্চয়তা। সম্প্রতি শিল্পসমৃদ্ধ দেশ জাপানের পূর্ব ওসাকার ১৮ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এসেছিলেন বাংলাদেশে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এফবিসিসিআই আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থেকে তাদের সাথে কথা বলার। মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে আমাদের দেশের শ্রমিকের বেতন কম এই প্রসংগে তাদের বক্তব্য ছিল সস্তায় খারাপ উত্পাদনের চেয়ে উত্পাদন না করাই ভালো। কারণ উত্পাদনের উদ্দেশ্য উত্পাদিত দ্রব্য ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া নয়, ক্রেতার চাহিদা পূরণ করা। তাদের বক্তব্য থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তাদেরও সমস্যা আছে, তবে আমাদের সমস্যা যোগ্যতার, তাদের সমস্যা অতিযোগ্যতার। আমাদের সমস্যা চাহিদা মোতাবেক পুষ্টি গ্রহণের ক্ষমতা আহরণের যোগ্যতায়। আমাদের সমস্যা প্রাইমারি শিক্ষায়, তাদের সমস্যা শিক্ষায় সর্বশেষ পর্যায়ে অর্থাত্ থিসিস লেভেলে। আয়তনের দিক থেকে জাপান আমাদের দেশের দ্বিগুণের চেয়ে বড়। তারপরও জনসংখ্যা আমাদের ১৬ কোটির থেকে প্রায় চার কোটি কম। প্রাকৃতিক বিপর্যের দিক থেকেও জাপান আমাদের দেশের সমপর্যায়ে। মানুষের মতো বেঁচে থাকার সব উপকরণ জাপানের মানুষের জন্য সে দেশের সরকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে সফলকাম আর আমাদের দেশের মানুষকে কয়দিন পরপর আন্দোলন করতে হয় এসবের দাবিতে। এখনও আমাদের দেশের সোয়া দুই কোটি মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নেই। আমরা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি। আমাদের দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান হওয়ার পরেও অন্য একটি মুসলিম দেশে প্রবেশের জন্য ভিসা পায় না, অর্থাত্ ব্ল্যাক লিসটেড। বাংলাদেশ সরকারের শ্রমমন্ত্রীর ভাষায় এটা আমাদের ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য শাস্তি। আমার প্রশ্ন, ব্যবসায়ীরা কি এ দেশের সরকারের অধীনে নয়? সকল সমস্যার মূলে অভাব। চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অত্যধিক হওয়ায় নিয়োগ বাণিজ্যকরার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কথায় আছে অভাবে স্বভাব নষ্ট। গরিবের সুন্দরী বউ সবার ভাবী এ প্রবাদও আছে আমাদের সমাজে। আল্লাহও বলেছেন, ‘তোমরা দরিদ্রতা থেকে পানাহ চাও। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ তার ক্ষুধার জ্বালায় অমানুষ হয়ে যায়।   
 শেষ কথা, ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশের মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য সার্বিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত আউটপুট নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে প্রাইমারি শিক্ষায়। শিক্ষকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করার মতো বেতন কাঠামো করতে হবে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি এবং অনুপ্রাণিত করতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি মোটামুটি যথেষ্ট। বর্তমান সিলেবাসের সুফল ১০০% অর্জনের পরই আরও উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। পরীক্ষার পাসের হার বৃদ্ধি শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নের লক্ষণ নয়। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানোর অনেক পন্থা বুদ্ধিমান সরকারি কর্মকর্তাদের জানা আছে বা উপরের মহলকে খুশি করার জন্য তারা অনেক কিছু করার যোগ্যতা রাখেন। দেশে মানবসম্পদ নিশ্চিত করতে পারলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য প্রচারের যেমন প্রয়োজন হবে না, তেমনি এদেশের মানুষের বিদেশের মাটিতে শ্রমিকের চাকরির জন্য ভিসা প্রার্থীও হতে হবে না। ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য আমাদের বিদেশ গমন ব্যাহত হবে না। বৈদেশিক মুদ্রার জন্য কঠিন শর্ত মেনে ঋণ নিতে হবে না। মনে রাখতে হবে, দরিদ্রতা থেকে মুক্তি বা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির একমাত্র পন্থা হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান উপার্জন, যা সরকারের কর্মপরিকল্পনা এবং সুশাসনের উপর শতভাগ নির্ভরশীল। দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশও ব্যাহত হয় দরিদ্রতার জন্য।    
লেখক: এফসিএ
akc@akc-bd.com

No comments:

Post a Comment

Thanks for visiting.